‘মুক্তধারা' নাটকে সমকালীন পরিবেশের প্রতিফলন কী রূপে ঘটেছে তা ব্যাখ্যা করো।

১৩২৮ বঙ্গাব্দে মুক্তধারা রচিত হয়, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রবাসী পত্রিকায় তা মুদ্রিত হয়। আর এর প্রকাশকাল ১৯২২ খ্রিঃ এপ্রিল মাস, অর্থাৎ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ। তবে গ্রন্থটির রচনাকাল আরো তিনমাস পূর্বে অর্থাৎ ১৯২২ খ্রিঃ জানুয়ারি। এ সম্পর্কে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন— মুক্তধারা লেখা শেষ করেন কবি পৌষ সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি। এই নাটকটি রচনাকালে দেশে অসহযোগ আন্দোলন অত্যন্ত তীব্র হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে বারদৌলী সত্যগ্রহ শুরু হয়; কিন্তু এই সত্যাগ্রহের সফলতার মধ্যে লোকের যতখানি অহিংস্র হওয়ার প্রয়োজন ছিল, লোকে ঠিক ততখানি অহিংস ছিল না। ফলে চৌরাচৌরায় হিংসাত্মক দুর্ঘটনা ঘটলে গান্ধিজি এই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন এবং তাঁকে গ্রেফতার করে দুমাসের মতো কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।


এমনই এক পটভূমিকায় ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লিখেছেন দৈহিক শক্তির ওপর অধিকাংশ দেশের রাজনৈতিক শক্তি নির্ভর করে। তাকে জয় করবার কার্যকরী শক্তি যে অহিংসার আছে তা তিনি বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই অহিংসাবোধ আপনা থেকে চিত্তে জাগরিত হওয়া চাই। কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিছুকাল স্বভাবের গতিকে হয়তো রুদ্ধ করে রাখা যায়, কিন্তু যেখানে এক বিরাট জনতা যুক্ত এবং সংঘাত যখন বহুদিন ব্যাপ্ত তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই বিদ্বেষ দমন করা প্রায় অসম্ভব।


উল্লিখিত পরিবেশের কথা স্মরণ রেখে রবীন্দ্রনাথের 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকের কথা ধরা যেতে পারে।‘প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে আফিক্রায় গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনের কথা যেমন প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত, ‘মুক্তধারায়’ সেই জাতীয় আন্দোলন ঠিক ততখানি প্রত্যক্ষভাবে রূপায়িত না হলেও নাটকটির পটভূমিকায় সমকালীন 'ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে’র যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য নাটকে অহিংসা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবের পরিচয় প্রদান করেছেন, ধনঞ্জয় ও অভিজিৎ উভয়ের মানবতাবাদীই দুই চরিত্র এঁকেছেন।


মুক্তধারা নাটক রচনার প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ জাপান, আমেরিকা পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সেখানকার আগ্রাসী রাষ্ট্রনীতিতে কবি বড়ো বিচলিত বোধ করেছিলেন। জাতীয়তাবাদের যে দিকটিতে বণিকবৃত্তি এবং সৈনিকবৃত্তি আছে সেই দিকটি ব্যক্তিকে ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয় না। রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্বের বিরোধিতা করে ব্যক্তিরূপে ব্যক্তির মূল্য নির্ণয়ের জন্য আবেদন জানালেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবোধের বিশ্বমূল্য নিরূপণের জন্য আহ্বান জানালেন। জাতীয়তাবাদ যে মানুষকে লোভের পথে, ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয় এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ পূর্ণ সচেতন ছিলেন। জাপান, আমেরিকা জাতীয়তাবাদের যে উগ্রমূর্তি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন 'মুক্তধারা' নাটকে তার প্রতিবাদ আছে।


ভোগের আকাঙ্ক্ষা আত্মিক জগৎকে নির্বাসিত করতে চায় তাকে অস্বীকার করে। যেখানে মানুষ জড় শক্তিকে আয়ত্ত করেছে সেখানেই তার ভোগলালসার লেলিহান জিহ্বা বীভৎসতা সৃষ্টি করেছে ৷ ‘জাপান যাত্রীতে’ তিনি লিখেছেন— “সমুদ্রের তীরে তীরে বন্দরে বন্দরে মানুষের লোভ কদর্য ভঙ্গিতে স্বর্গকে ব্যঙ্গ করছে।" মুক্তধারা' নাটকেও যন্ত্র দানবের সেই আস্ফালন পরিচয় আছে। এখানে যন্ত্র মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত নয়—সে শক্তির দম্ভে ফড়িং-এর মতো আকাশে লাফিয়ে উঠেছে। “যেন মস্ত একটা লোহার ফড়িং আকাশে লাফ মারতে যাচ্ছে।” যেখানে সামঞ্জস্য হয় না সেখানে ভয়ংকরতা প্রকট হয়ে ওঠে। চিরকাল দুটি বিপরীত ব্যাপার পাশাপাশি টিকে থাকতে পারে না। দুয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হবে–“ওটাকে অসুরের মতো দেখাচ্ছে মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা। তোমাদের উত্তরকূটের শিয়রের কাছে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে দিন-রাত্রি দেখতে দেখতে তোমাদের প্রাণপুরুষ যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।” মানুষের ক্ষতিসাধন করে বলেই যন্ত্র দেখায় অসুরের মাথার মতো।


রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রকে বিজ্ঞানকে কখনও অমঙ্গল বলে মনে করেননি, কিন্তু সেই শক্তিকে মানবতার উন্নতির কাজে প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে তিনি ক্ষুদ্ধ। সঞ্জয় এবং ফুলওয়ালীর সংলাপে রবীন্দ্রনাথ এই চিন্তাধারা ব্যক্ত করেছেন। যে বিভূতি দেবতার কাজের জন্য যন্ত্র সৃষ্টি করেননি, দেবতার হাতে বেড়ি পরাবার চেষ্টা করেছে তাকে ফুল দিতে যাওয়া ফুলওয়ালীর পছন্দ নয়। অবশ্য যন্ত্র সম্পর্কে গান্ধিজির বিভিন্নতর ধারণা ছিল। তিনি জটিল যন্ত্র পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। ‘মুক্তধারা’ নাটকেও এই মানসিকতার পরিচয় আছে। যন্ত্রশক্তিতে শক্তিমান বিভূতি শেষ পর্যন্ত রাজাকে অবিশ্বাস করে তুচ্ছ করে নিজের হাতে কর্তৃত্ব নিয়েছে ; দেবতাকে ছুটি দিয়ে তার কাজ নিজেই চালিয়ে নেবে বলে মনে করেছে। বিভূতি আজ যন্ত্রশক্তির বলে শীর্ষস্থান পেয়েছে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ বিভূতির মাধ্যমে যন্ত্রযুগের আধিপত্যের কথা ঘোষণা করেছেন।


সর্বোপরি, যুদ্ধোত্তর ইউরোপ এবং আমেরিকাই রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকের মানস পটভূমি। ইউরোপের পররাজ্য লোলুপ রাষ্ট্রনীতি, সংকীর্ণ জাতীয়তা ও তার যান্ত্রিক সভ্যতা সম্বন্ধে ভাবনাচিন্তা অনুভূতি এবং বিদেশি পাশ্চাত্য শক্তির শাসন ও শোষণ যন্ত্রে স্বদেশবাসীর শোচনীয় অবস্থা জ্ঞান এবং তার বিশিষ্ট মানবতাবাদ একত্র মিলে রবীন্দ্রনাথের কবি-চিত্তে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে 'মুক্তধারা' নাটকটি তারই শিল্পরূপ।