“বৈষ্ণব কবিতাই হোক আর শাক্ত কবিতাই হোক–বাংলা কবিতায় সর্বত্রই মাধুর্য ভাবের প্রাধান্য।”—উপযুক্ত উদ্ধৃতির সাহায্যে উক্তিটির যথার্থ্য নির্ণয় করো।

শাক্তপদাবলি শক্তিসাধনার সঙ্গীত। তবে সে গান কেবল শক্তি-ঐশ্বর্যের গান নয়। রামপ্রসাদের শক্তিসাধনা তন্ত্রসাধনাভিত্তিক অবশ্যই কিন্তু তা কখনোই ভয়ংকর ক্রিয়া-মূলক সাধনা নয়। রামপ্রসাদের সাধনা ভাবের সাধনা “সে যে ভাবে ভাবী, ভাব ব্যতীত অভাবে কী ধরতে পারে?” তাই সেই ভাবসাধনায় স্বাভাবিকভাবেই এসে মিলিত হয়েছে শক্তিতন্ত্রের ভয়ংকরতার সঙ্গে ভক্তিভাবের মাধুর্য। শক্তি ও মাধুর্যের ঘটেছে মেলবন্ধন। রামপ্রসাদের হৃদয়ে তন্ত্রের ভয়ংকরী কালিকা দেখা দিয়েছেন 'নীলিমা হ্রদে নীলিম পদ্মের' মতো। শ্যামজননীরূপে অনন্ত আকাশের উদারতা যার সর্বাঙ্গে, অশুভদলনী অপ্রতিরোধ্য বলদৃপ্ততা যাঁর বাহুতে, দক্ষিণ হতে যার বরাভয়, বামহস্তে অসুর-মুণ্ডচ্ছেদী খড়্গড়ঙ্গ। অর্থাৎ একইসঙ্গে তিনি বাৎসল্যময়ী ও দৃপ্তশাসিকা শ্যামাশ্রী জগন্মাতা।


‘আগমনী-বিজয়া'র গান তথা উমাসংগীতে যেমন বাৎসল্য তথা মাধুর্যরসের আভাস, ভক্তের আকুতি আদি শ্যামাসংগীতে তেমনই দেবীর ঐশ্বর্য চিত্রিত। 'ভক্তের আকুতি’তে কোনো কোনো ভক্ত সর্বেশ্বরী দেবীকে একেবারে মায়ের আসনে বসিয়ে তার সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ফলত শাক্ত পদাবলিতে মাধুর্য ও ঐশ্বর্যের পার্বতী-মহেশ্বর রূপ স্থাপিত হয়েছে। দেবীর ঐশ্বর্য রূপের পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে মাধুর্য রূপটি। সেখানে দেবী বাঙালি জীবনের স্বভাব কোমলা, স্নেহকাতরা মাতৃকামূর্তিতে বিরাজমান। সেখানে ভক্তসত্তানরূপে অধিকারে আসীন হয়ে দেবী বাঙালি ঘরের মায়ের মূর্তিতে জীবন্ত-

মা খেলবি বলে ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে।

এবার যে খেলা খেলালে মাগো, আশা না পুরিল ॥

রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায় যা হবার তাই হল।

এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে ঘরে নিয়ে চলো।


কমলাকাস্তের এ উক্তি সত্যিই মাধুর্যগুণান্বিত। আগমনী-বিজয়া পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি কমলাকান্ত। তার পদে দেখিয়েছেন গিরিরাজ ও উমাকে মানবের রূপে।—

“গিরিরাণী, এই নাও তোমার উমাকে। 

কত না মিনতি করি, তুষিয়ে ত্রিশূলধারী,

প্রাণ উমা আনিলাম নিজপুরে।”


আগমনী পর্যায়ের অধিকাংশ গানে মাধুর্যরসের ধারা বয়ে গেলেও ঈশ্বরীমূর্তিতে তার ঐশ্বর্য বিকাশ ঘটেছে।—

“দেখো মনে রেখো ভয়, সামান্যা তনয়া নয়,

যাঁরে সেবে বিধি বিষ্ণু হরে। 

তরঙ্গচরণ দুটি হৃদে রাখেন ধূর্জটি

তিনার্ধ বিচ্ছেদ নাহি করে।।”


আবার কোনো কোনো পদে উমা চৈতন্যরূপিনী ব্রহ্মময়ী—

“মাগো, রজনী প্রভাত হয়েছে। 

ওমা ডাকিছে বিহঙ্গ পবন-তরঙ্গ

গল্ব ভরে মন্দ মন্দ যে বহিছে 

....চৈতন্যরূপিনী তুমি ব্রহ্মময়ী।”


গিরিরাজ গমন করেছেন হরপুরে। পিতাকে দেখে ছুটে এলেন উমা যিনি জগজ্জননীরূপে শিবের গৃহিণী—

জগজ্জননী তায় প্রণাম করিতে চায়

নিষেধ করয়ে গিরি ধরি দুই বারে।


উমা নিজের সস্তান হওয়া সত্ত্বেও আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি, পিতা হিমালয় কিন্তু এই ধারণাটি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি বলেই কন্যার প্রণাম গ্রহণ করলেন না। এখানে ঐশ্বর্যরস ও মাধুর্যরসের মিলন ঘটেছে।


সেকালে কুলীন ঘরে প্রচলিত ছিল বহুবিবাহ। সে বাঙালি ঘরের কথা স্বীয় অভিজ্ঞতাতেই কবি বর্ণনা করেছেন—

প্রসাদ বলে এই কথা, বেদাগমে আছে গাঁথা। 

ওমা যে জন তোমার নাম করে

তার কপালে ঝুলি গাথা।


বাঙালি ঘরের পুত্রের যে কী দুরবস্থা তার চিত্র ফুটে উঠেছে। শিবের অর্ধাঙ্গিনী উমার সাথে সাথে গঙ্গার উপস্থাপনায় বহুবিবাহের রীতি অনুসৃত হয়েছে যা মাধুর্যগুণে উদ্ভাসিত। আরও একটি পদে লক্ষ্য করা যায়—

“ওই দ্বারে বাজে ডম্বুর, হর বুঝি নিতে এল 

নবমী না পোহাইতে অমনি এসে দেখা দিল।”


তৎকালে জামাতা শ্বশুরগৃহে আমন্ত্রিত হলেও বেশি দিন থাকতে হতে পারে বলে পীর সঙ্গে যেতনা পীকে পরে আনতে যেত। এর মধ্যেও মাধুর্যের ঘনঘটা লক্ষ্য করা যায়। শাক্তদেবী এই পর্যায়ে মাধুর্যে ভরপুর হয়ে পরিণত হয়েছে অভিমানিনী কন্যারূপে—

‘কই মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে’

তাঁর এই উক্তিতে সত্যি বিস্মিত হতে হয়।


সস্তানের জন্য বাঙালি মাতৃহৃদয়ে যে স্নেহবুভুক্ষা, যে আকুলতা, যে উদ্বেগ, ব্যাকুলতা, সস্তানের কল্যাণের চিন্তায় মগ্ন সেই মেনকার আচরণে মাধুর্য রূপেরই প্রকাশ মেলে–

“আছে কন্যাসস্তান যার, দেখতে হয় আনতে হয় 

সদাই দয়ামায়া ভাবতে হয় হে অন্তরে।”


মেনকার–

“তার নাই সে বরণ, নাই আভরণ

হেমাঙ্গী হইয়াছে কালীর বরণ।”


কন্যার রূপের প্রতি এ উক্তি সত্যিই মাধুর্যের। শাক্ত কবিগণও আরাধ্যা দেবীকে দেখতে চেয়েছে পরম মাধুর্যরূপে। সমকালীন বৈষ্ণব ভাবনায় আপ্লুত হয়ে কবিগণ তাঁদের হৃদয়ের আর্তি জানিয়েছেন–

“হৃদয়-রসমন্দিরে দাঁড়াও মা ত্রিভঙ্গ হয়ে ;

একবার হয়ে বাঁকা দেখা দেখা 

শ্রীরাধারে বামে লয়ে।”


এরূপ ধর্মসমন্বয় আধ্যাত্মিক কল্পনা শক্তি ও মাধুর্যের মিলন ভাবনাতেই সম্ভব হয়েছে। শাক্ত ভক্তিসঙ্গীতের রসধারায় এসে মিলেছে বৈষ্ণব ভক্তির পরম মধুর রমণীয়তা।


সাংস্কৃতিক, ধর্মনৈতিক প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বাঙালি সমন্বয় ঘটিয়ে শক্তি সাধানায় রত হয়েছে।