“বর্ণোজ্জ্বল ঘটনা বর্ণনা নয়, মানুষের মনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া সন্ধানই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র বিশেষত্ব”—আলোচনা করো।

মনোস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসাবে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'


উপন্যাস সাহিত্য তার বৃহৎ পরিসরে নরনারীর অখণ্ড জীবনের কথা কাহিনি উপস্থাপন করে। স্বাভাবিকভাবে উপন্যাসের দর্পণে কেবল পুরুষ চরিত্রই প্রতিবিম্বিত হয় না, নারী চরিত্রও উপন্যাসের অনন্ত পরিসরে তার সবিশেষ দাবি সহযোগে হাজির হয়। পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী ডাক্তার যেমন অসাধারণ একটি পুরুষ চরিত্ররূপে চিত্রিত তেমনি কুসুম একটি অসাধারণ নারী চরিত্ররূপে সুঅঙ্কিত। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত এই দুই মানব-মানবীকে কেন্দ্র করেই মনুষ্য জীবনের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়াগুলি মূর্ত করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষত নারী চরিত্রের জটিল মনস্তত্ত্ব কুসুম চরিত্রকে অবলম্বন করে এরূপ মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। এককথায় মনস্তত্ত্ব নির্ভর উপন্যাস এই 'পুতুল নাচের ইতিকথা'। এখানে ঔপন্যাসিক মানুষের মনের কারখানা ঘরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে তাঁদের আঁতের কথাকে টেনে বের করে এনেছেন। সমস্যা জর্জরিত জীবনের কথা বলা হলেও সেই সমস্যার মূলীভূত বিষয় খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় মনস্তত্ত্বগত দিকে জট জটিলতা। ঔপন্যাসিক মানুষের মনের ওপর ঘটনার প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধানে সমধিক ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছেন। সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় যথার্থই বলেছেন : “মানিকবাবু জীবনের বর্ণবহুল মুহূর্তগুলিকে পরিহার করতে চান। মানুষের হাসিকান্নার প্রেম বিরহের উপরিতলশায়ী সমস্ত বিকাশের অপেক্ষা চৈতন্যের গভীরতর প্রশ্নকে তিনি ধরার পক্ষপাতী ... সেইহেতু ঘটনার প্রোজ্জ্বল রং চড়ানো বর্ণনা অপেক্ষা মানুষের মনের উপর ঘটনার প্রতিক্রিয়া সন্ধানের জন্য তিনি বেশি উৎসুক"।


উপন্যাসের কাহিনি পর্যালোচনায় দেখা যায় মূল কাহিনিধারা এখানে শশী নির্ভর। শশীকেন্দ্রিক কাহিনিধারার মূল স্রোত প্রবাহিত। পল্লিসমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপটে শশীর যন্ত্রণাদীর্ণ জীবন, সমস্যা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই মূল কাহিনিধারা গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“শশীর জীবনে প্রধান সমস্যা তাহার এক প্রতিবেশির স্ত্রী কুসুমের তাহার প্রতি এক প্রকারের অবর্ণনীয়, দুর্বোধ্য আকর্ষণ। শশী দীর্ঘকাল তাহার এই অনুচ্চারিত ভালোবাসা লইয়া খেলা করিয়াছে, তাহার ডাকে কোনো সাড়া দেয় নাই। যখন প্রতিদান বঞ্চিত ভালোবাসা শীর্ণ শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, তখন একদিন বিস্মিত বেদনীর সহিত সে ইহার আবেদন উপলব্ধি করিয়াছে, কিন্তু অনাদৃত প্রেম অকাল সিঞ্চনে বাঁচিয়া উঠে নাই।” অবহেলিতা প্রেম সার্থক মর্যাদা না পেলেও শশী ও কুসুমের মধ্যেকার এই টানাপোড়েনের মধ্যেই নিহিত মনস্তাত্ত্বিকতা। বিশেষ করে কুসুম চরিত্রের দোলায়মানতা পাঠকচিত্তকে বড়ো আকর্ষণ করে। শশী চরিত্রটি সামাজিক নানা জটিলতা যুক্ত হয়ে মনস্তাত্ত্বিকতার দিক থেকে দৃষ্টির আড়ালে পর্যবসিত হলেও কুসুম যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছে তা সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যে তুলনা রহিত।


কুসুম চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ গল্পের মধ্যেই অভিনিবিষ্ট। অজস্রবার সে নানাভাবে আত্মনিবেদন করেছে শশীর কাছে। মিথ্যা হাতভাঙা, কোমর ভাঙা অসুখের অজুহাত দিয়ে সে শশীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করতে সচেষ্ট হয়েছে, কিন্তু শশীর কাছে সে নিজেকে তুলে ধরতে গিয়ে থেকে গেছে উপেক্ষিত-অবহেলিত। কিন্তু কুসুম তবুও ভালোবেসে যায় শশী ডাক্তারকে। শশীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে এক দুর্বোধ্য জটিল সম্পর্কের বন্ধনে। বিবাহিত জীবনেই পরাণ পত্নী কুসুম একপ্রকার সংসারের সকল বিষয় কামনা বাসনা থেকে প্রবঞ্চিতা নারী তাই শশীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তৃষ্মার্ত মনকে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতে। কিন্তু শশী কুসুমের অভিব্যক্তি সমস্তই বুঝেও না বোঝার ভান করে দীর্ঘকাল অতিক্রম করলে জাগতিক নিয়মেই কুসুমের মধ্যেকার অদম্য আকুলতা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে। ব্যর্থতাকে উপজীব্য করে শশীর সান্নিধ্য থেকে মুক্তি নিতে সে যখন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তখন শশীর মধ্যে জাগ্রত হল কুসুমের প্রতি সুপ্ত প্রেম বাসনা। কিন্তু সময় তখন অনেকখানি অতিবাহিত হয়েছে। পিছনে ফিরে দেখার অবকাশ আর কুসুমের ছিল না। প্রবঞ্চিত জীবনের দীর্ঘশ্বাসকে পাথেয় করে তাই কুসুমকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করতে হয়েছিল গাওদিয়া গ্রাম।


কুসুমের মনস্তত্ত্ব পর্যালোচনায় সমালোচক সরোজ মোহন মিত্র লিখেছেন : "পরানের বউ কুসুম তাদের ছোটোবাবু শশীকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে। কুসুমকে পাড়ার লোকে বলে পাগলাটে, আসলে কুসুম পাগল নয়, মনস্তত্ত্বের একটি জীবন্ত প্রতিমূর্তি। মনস্তত্ত্বের মনের যে স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে কুসুমের মধ্যে আছে তারই সুন্দর প্রকাশ।” তাইতো মতির অসুখে শশীর ব্যাকুলতা কুসুম সহ্য করতে পারেনি। মতির জ্বর হলে শশী ডাক্তারি করতে এলে কুসুমের মনে যে ঈর্ষা দানা বেঁধে ওঠে তা শশীর প্রতি তার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ফলে শশীর যাতায়াতের পথে কুসুম অপেক্ষা করে। নানান মিথ্যা কথা বলে শশীর সান্নিধ্যে আসে। প্রেমের আর কটি স্বরূপ হল মান অভিমান, দ্বন্দ্ব। ভালোবাসার গভীরতায় কুসুম প্রায়ই শশীর সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। ঝগড়ার পর কুসুম স্থির থাকতে পারে না। নিষিদ্ধ প্রণয়ের তাড়নায় দিন চারেকের মধ্যেই কুসুম এক দুপুরবেলা চুপি চুপি একরকম চোরের মতো শশীর ঘরের জানালার কাছে এসে হাজির। কুসুমের এই অপ্রত্যাশিত আগমনে বিশেষত নির্জন মধ্যাহ্নে শশী অস্বস্তি অনুভব করলেও তার আচার-আচরণে প্রকাশ পায় শশী বোধকরি এতক্ষণ কুসুমের প্রতিক্ষার প্রহর গুনছিল। কিন্তু সরাসরি সে তাকে আহ্বান জানাতে পারেনি। কারণ, শশী সমাজবদ্ধ জীব। তার উপর কুসুম তার বন্ধুর স্ত্রী, তার সঙ্গে প্রেমবিনিময়! অযৌতিক ভেবেই শশী নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু অবশেষে সে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি।


দীর্ঘদিনের ভাবে আচরণে ইঙ্গিতে কুসুম আপন সাধকে শশীকে অবগত করাতে না পেরে মুখেই প্রকাশ করতে দ্বিধা করল না। সে বলে “এমন চাঁদনী রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ যায় ছোটোবাবু।” এতেও ক্ষান্ত নয়, অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল : “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শশীর এমন করে কেন ছোটোবাবু।” শশী কুসুমের এসকল বাসনা সাধকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। সমাজের নিষ্ঠুর অনুশাসনে নিজেকে বেঁধে রেখেছিল কিন্তু শুরুরও একটা শেষ আছে। কুসুম একদা নিজে থেকেই শুরু করেছিল সে সাড়া না পেয়ে যখন সমস্ত ভুলতে বসেছে শশী তখন হয়ে উঠেছে সজাগ। সরাসরি কুসুমকে পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু কুসুমের উচ্ছ্বাসে তখন যে ভাটা পড়েছে। সে বলে “আকাশের মেঘ কমে নদীর জল বাড়ে নইলে কি জগৎ চলে ছোটোবাবু ?” অর্থাৎ একের যবে শেষ অন্যের তখন শুরু। শশীর ডাকে তাইতো কুসুম বলে উঠলে—“কতবার যেচে এসেছি, ভেবেছিলেন যেদিন সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে চলে যাব, কেউ তা যায়?” সুদীর্ঘ বৎসর ব্যাপী কুসুম শশীর জন্য পাগল হয়ে অপেক্ষা করেছে, ডাক পায়নি, পেলে নিশ্চিতভাবে সে চলে যেত। কিন্তু এখন পড়তি বেলায় তা আর সম্ভব নয়। আপন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে সে বলে: “লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়।” কুসুমেরও অনুরূপ দশা, তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা সমাধিস্থ হয়েছে। স্পষ্টভাবেই শশীকে সে জানিয়ে দেয়—“কাকে ডাকছেন ছোটোবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে ? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।”


কুসুম চলে গেছে। কুসুম বিহনে গাওদিয়া গ্রাম শূন্যময়। শশী যেন নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত। কুসুমের নিকট প্রত্যাখ্যাত হয়ে বড়ো আঘাত পেয়েছে, প্রকৃত সত্য সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। বুঝতে পারে কুসুমের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অতলান্তিক গভীরতার কথা। গ্রাম্য এই নিরুত্তপ্ত জীবনে শশী ভালোবাসার স্নেহবশে সুধায় পরিপূর্ণ সুরভি সৌরভময় পুষ্পটিকে যথার্থ ঝরে গেল নিঃশ্বব্দে। কুসুমের মৃত্যু ঘটেছে, চপল রহস্যময়ী, জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম আর জীবিত নেই। দেহের অস্তিত্ব বজায় থাকলেও মরে মনকে নিয়ে। গ্রাম্য জীবনকে নিয়ে সর্বোপরি কুসুমকে নিয়ে। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই পুতুল নাচের ইতিকথা মনস্তাত্ত্বিকতার চরম শিখরে উন্নীত।