বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা, অভিনীত নাটক ও অভিনেতা সম্পর্কে এবং বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে এর গুরুত্ব পর্যালোচনা করো। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার কীভাবে গঠিত হয়? এঁদের অভিনীত নাটক কী এবং প্রধান অভিনেতা কে? এই দলের নামান্তর কী হয়েছিল? এদের নাটক কোথায় কোথায় কীভাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল এবং জাতীয় নাট্যশালা স্থাপনের পশ্চাতে এঁদের অবদান নির্ণয় করো।

ধনী ব্যক্তির বাড়িতে অভিনয়ের মাধ্যমে নতুন থিয়েটার ও নাটকের সঙ্গে কিছু বাঙালির পরিচয় হয়। এবার এই শিক্ষিত তরুণেরা ধনীর ছত্রছায়ায় না থেকে ক্রমে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে অনিভয়ের আয়োজন শুরু করে। পাড়ার লোকের কাছে চাঁদা তুলে ধনী ব্যক্তির অর্থ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে তারা অভিনয়ের প্রচেষ্টা চালায়, এদের কেউ কেউ ধনী ব্যক্তির বাড়িতে নাটকাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেউ কেউ এইসব নাটক দেখেছে। অনেকে কলকাতায় তখন সাহেবদের থিয়েটারে যাগাযোগ রেখেছিল। এদের প্রচেষ্টায় ক্রমে ক্রমে বাংলা থিয়েটার ধনীর প্রাসাদ-মঞ্চ ছাড়িয়ে বৃহত্তর বাঙালির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে পেরেছে। বাগবাজার অঞ্চলের যুবক সম্প্রদায়ের 'বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার' আন্তরিকভাবে এই উদ্যোগ নেয়। এরাই পরে 'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ' নামে অভিনয় শুরু করে। এদের প্রচেষ্টাতেই পরবর্তীকালে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে সাধারণ রঙ্গালয় যুগের সূত্রপাত ঘটে।


১৮৬৭ খ্রিঃ বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হয়। এই দলে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামাধব কর, অরুণচন্দ্র হালদার। পরে এসে যোগ দেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি। তবে থিয়েটার করার অভিপ্রায় তাঁদের থাকলেও ব্যয়বহুল মঞনির্মাণ ও সাজসজ্জার জন্য আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় তাঁরা যাত্রা করতেই মনস্স্থ করেন। মধুসূদনের মঞ্চ সফল 'শর্মিষ্ঠাকে' পালা হিসেবে তাঁরা নির্বাচনও করেন। কিন্তু প্রায় একবছর পরে আবার তাঁদের 'থিয়েটার' করার ইচ্ছা প্রবলভাবে পেয়ে বসল। গিরিশচন্দ্র ঘোষ অভিনয়ের জন্যে দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' নাটকখানি বেছে নিলেন। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের দুর্গাপূজার দিনে এর প্রথম অভিনয় হল বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে। শুধু একবার নয়, কয়েকবারই সধবার একাদশীর অভিনয় নানা জনের বাড়িতে হয়েছিল। এই দলের যুবকদের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নাটকের চতুর্থ অভিনয়ে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। এ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেনঃ গিরিশচন্দ্র—নিমচঁাদ, অর্ধেন্দুশেখর–কেনারাম, নগেন্দ্রনাথ—অটল, ঈশান নিয়োগী—জীবনচন্দ্র, অমৃতলাল–কুমুদিনী ইত্যাদি।


এরপর এক বছর অতিবাহিত হয়েছে, সধবার একাদশীর পর অন্যকোনো নাটক বাগবাজার থিয়েটারে অভিনীত হয়নি। তারপর দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের অভিনয় হয়। তখন বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার নাম পালটে 'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ' নামে পরিচিত হয়। দীর্ঘসময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে ১৮৭২ -র ১১মে ‘লীলাবতী’র অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। পরপর দুটি শনিবারেও আবার এর পুনরাভিনয় হয়েছিল একই মঞে। এ দলের আর্থিক ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং পূর্বগামী অন্যান্য সখের দলের থিয়েটারের মতো এঁদের মঞ্চ সজ্জাও ছিল না। তথাপি এঁদের অভিনয় এমনই উচ্চাঙ্গের হয়েছিল যে অসংখ্য দর্শক সমাগম হয়। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন : “শ্যামবাজারের রাজেন্দ্রনাথ পালের বহির্বাটীর প্রাঙ্গণে রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত ; দৃশ্যগুলি ধর্মদাসবাবুর তুলিতে অঙ্কিত, সামান্য চাঁদার অর্থে কার্যসম্পন্ন হইয়াছে, কিন্তু অভিনয়ের সুখ্যাতি এত বিস্তৃত যে দলে দলে লোক টিকিটের জন্য উমেদার।” ময়দানে সাহেবদের অলিম্পিক থিয়েটারের অনুকরণে এর মঞ্চদৃশ্য ও দৃশ্যসজ্জা করা হয়েছিল। এর আটখানি দৃশ্যই সুন্দর হয়েছিল।


দীনবন্ধু মিত্রের এই লীলাবতী নাটকে যে সকল অভিনেতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন—অর্ধেন্দুশেখর— হরিবিলাস, গিরিশচন্দ্র–ললিত, নগেন্দ্রনাথ – হেমচাঁদ, মহেন্দ্রলাল— ভোলানাথ। অর্ধেন্দুর হরিবিলাস গিরিশের ললিতমোহন রাধামাধবের ক্ষীরোদবাসিনী এবং সুরেশচন্দ্রের লীলাবতী উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল, গিরিশচন্দ্র একদা লিখেছেন : নাট্যকার দীনবন্ধু অর্ধেন্দুর জীবনচন্দ্র দেখে খুশি হয়েছিলেন কিন্তু লীলাবতীতে হরিবিলাস দেখে একেবারে চমৎকৃত হয়ে যান। তাঁর মুখে আর প্রশংসা ধরে না। এই দলের অভিনয় তাঁর চুঁচুড়ার বঙ্কিম—অক্ষয় সরকারের অভিনয়ের চেয়ে ভালো লেগেছিল বলে তিনি জানান। বলেছিলেনঃ তোমাদের অভিনয়ের সহিত চুঁচুঁড়া দলের তুলনাই হয় না—আমি পত্র লিখিব—“দুয়োবঙ্কিম।”


লীলাবতী পরপর কয়েকটি শনিবার একই মঞ্চে অভিনীত হল। এই অভিনয়ের খ্যাতি এতই বিস্তৃত হয়ে পড়ল যে, দর্শক সংকুলান অসম্ভব হয়েছিল। তখনই দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট' দেখে তবেই প্রবেশপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা হল। তাতে ভীড় কমল না। তখনই টিকিট বিক্রি করে অভিনয় ব্যবস্থার কথা ভাবা শুরু হল। পত্র পত্রিকাতেও এই টিকিট বিক্রির প্রস্তাব আসতে লাগল। 'এডুকেশন গেজেট' পত্রিকার এক দর্শক লীলাবতীর সাফল্য প্রসঙ্গে লিখলেন : “এইসব নাট্যাভিনেতৃগণ মনোযোগ করিলে এমন একটি দেশীয় নাট্যশালা স্থাপন করিতে পারেন, যেখানে লোকে ইচ্ছা করিলে টিকিট ক্রয় করিয়া যাইতে পারেন এবং দেশের অনেকটা সামাজিকতার পরিচয় হয়।"


মনে রাখতে হবে, ধনীদের পয়সার অভাব ছিল না। তাঁরা অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাই জাঁক জমকের দিকে জোর দিতেন। অথচ নাট্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ এই যুবক সম্প্রদায়ের বহুল খরচের সামর্থ্য ছিল না। আর্থিক ব্যয়-বাহুল্যের সমস্যা অনেকে গীতাভিনয়ের মধ্যে মিটিয়ে ছিল বাগবাজারের দলও প্রথমে যাত্রা করেছে। কিন্তু এতে নাট্যাভিনয়ের আমেজ আসেনি। পুরোপুরি নাট্যাভিনয় করতে গিয়ে তারা তাই ব্যয়বহুল নাটক বাদ দিয়ে সহজসাধ্য সাজপোষাক, দৃশ্যসজ্জা এবং দৃশ্যপট বেছে নিয়ে অল্প খরচেই নাটক করতে চেয়েছে। তাই এদের কাছে দীনবন্ধুর সামাজিক নাটক প্রহসনগুলি এত সমাদৃত হয়েছে। তাছাড়া দীনবন্ধুর নাটকের বাস্তবধর্মিতা, অভিনয় উপযোগী দৃশ্য ও চরিত্র থাকাতে এবং বিষয়বস্তু প্রগতিশীল সমাজ মনস্ক ছিল বলে এই তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে সহজেই গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র তাঁর ‘শাস্তি কি শান্তি' নাটকের উৎসর্গপত্রে দীনবন্ধুর কাছে এই ঋণ স্বীকার করে তাঁকে ‘রঙ্গালয় স্রষ্টা’ বলে প্রণাম জানিয়েছেন। তবে সখের নাট্যশালার যুগে দীনবন্ধুর নাটকগুলি লিখিত হলেও সে সময়ে তিনি সেখানে গৃহীত হননি উদ্যোক্তাদের শ্রেণিমানসিকতার কারণেই। আবার মধ্যবিত্ত তরুণ সম্প্রদায়ের মানসিকতা ও সঙ্গতির সঙ্গে সাযুজ্যলাভ করাতে সেই সময় এবং পরবর্তী ন্যাশানাল থিয়েটার পর্বে দীনবন্ধুই সবচেয়ে আদৃত, গৃহীত ও সম্মানিত নাট্যকার। সেদিক দিয়ে ভাবলে বাগবাজার থিয়েটারের বিশেষত্ব থেকেই যায়।