কবিকঙ্কন মুকুন্দের কাব্যে হাস্যরস সৃষ্টির আড়ালে যে গভীর জীবনবোধ নিহিত ছিল, সে সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিশেষ প্রতিভাধর শিল্পী না হলে সাহিত্যে হাস্যরস সৃষ্টি করা কঠিন। বাস্তব জীবনবোধ থেকেই হাস্যরসের উৎপত্তি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম নির্মল ও শুভ্র হাস্যরসের উপস্থাপনা করেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, হাস্যরস আদিরস থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বস্তুত হাস্যরসিকের জীবনদৃষ্টি এক উদার কৌতুকমিশ্রিত জীবনদৃষ্টি হাস্যরসিক তাঁদের রঙ্গ রসিকতার মধ্য দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বৈষম্য আর অসঙ্গতির ছবিকে। মুকুন্দরামের কাব্যে এই কৌতুকপ্রিয়তা বিশেষ লক্ষণীয়। এর আগে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এমন রঙ্গ-রসিকতা প্রকাশ পায়নি।


মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে হাস্যরস নারীগণের পতিনিন্দা শীর্ষক আখ্যান অংশে স্পষ্টই প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরকন্নার তুচ্ছাতিতুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয় উপস্থিত হয়েছে। এখানেই জীবনরসিক মুকুন্দরামের রচনার বিশিষ্টতা। কাব্যে কবি প্রথম হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গের বর্ণনায়। যজ্ঞ ব্রতী ব্রাহ্মণগণ বীরভদ্র ও তার চেলা চামুণ্ডের হাতে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে তা সত্যিই হাস্যোদ্রেক না করে পারে না।-

“যেই জন পালায়    দানা ধরিয়া তায়

পড়িয়া উপাড়ে দাড়ি।

ছিণ্ডিল বসন   ভাঙ্গিল দশন

ভ্রুবের মারিয়া বাড়ি।?


শিব-পার্বতীর বিবাহ-উপলক্ষে কবি বেশ কিছু কৌতুকজনক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। মহাদেব যেন ইচ্ছা করে ছাই-ভস্ম মেখে বিবাহ-সভায় উপস্থিত হয়েছে যা দেখে মেনকা ও পাড়াপড়শি বিরূপ মন্তব্য করেন—

বর দেখি আয়াগণ করে কানাকানি।

মরুক কন্যার পিতা চক্ষে পড়ুক ছানি।।”


বিবাহের পরে শিব ঘর জামাই হয়ে হিমালয় গৃহে রয়ে গেল, মেনকার সংসারে টানাটানি পড়ল। কন্যা পার্বতীর সাথে কথা কাটাকাটি, মেনকা বলেছিলেন—

“রান্ধি বাড়ি আমার কাঁকাল্যে হইল বাত।

ঘরে জামাই রাখিয়া জোগাব কত ভাত।।”


এর উত্তরে পার্বতী মায়ের সাথে কোমর বেঁধে বচসা, ঝগড়া করে। এখানে যে অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যেই হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে। কালকেতুর কৌতুকপূর্ণ মজাদার ভোজন-বর্ণনাও এই ভাষায় দিয়েছেন—

“মোচড়িয়া গোঁফ ছুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে। 

এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।

চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ। 

ছয় হান্টি মুসুরী সুপ মিশ্যা তথি লাউ৷৷


আবার পশুশিকার, পশুক্রন্দন ও চণ্ডীর নিকট দুঃখ নিবেদনের মধ্যে দুঃখের চেয়ে হাস্যরসিকতা বেশি করে ফুটে উঠেছে। ভালুক যখন কেঁদে বলে ওঠে—

“উই চারা খাই আমি নামেতে ভালুক। 

নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক।।"


বা বানর যখন বলে—

“হুক হুক কান্দে বানর মর্কটে। 

নিরাসে নাহিক কাজ বীর সনে হটে।।”

তখন এত দুঃখের মধ্যেও ওদের বাক্যালাপে আমরা না হেসে পারি না।


ছদ্মবেশিনী চণ্ডী ফুল্লরার বাড়িতে থাকার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করলে ফুল্লরা হাটে চলে স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে। এই কাহিনি অংশে মনোরম কৌতুক রসের পরিচয় মেলে। শেষে আত্মপরিচয় দানের পর দেবী কালকেতুকে একটি অঙ্গুরী (মাণিক্যের) প্রদান করলেন—

‘অভয়া দিলেন তারে মাণিক অঙ্গুরী।

লইতে নিষেধ করে ফুল্লরা সুন্দরী।।


ফুল্লরার নিবুদ্ধিতা ও প্রকৃত ধনের মূল্যবোধে অক্ষমতা আমাদের মুখে মৃদুহাসি এনে নেয়। ধনপতি সদাগরের উপাখ্যানেও মুকুন্দরামের হাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যায়। লহনা খুল্লনার কলহ কৌতুকের স্রোত বয়ে নিয়ে আসে—

“কোপে মারে লহনা ভীমের মত কিল। 

ভাদ্রমাসে ফাঁকা তাল তার সম কিল।। 

চুলে ধরি কিল লাথি মারে তার পিঠে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে গোয়ালা গোয়ালি যেন পিটে।।


পরিশিষ্টাংশে বলতে হয়, চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবির আত্মজীবনী অংশে, পশুগণের দুঃখ বর্ণনায়, কালকেতুর ভোজন পর্বে, নারীদের পতিনিন্দা প্রভৃতি পর্বে মুকুন্দরামের লঘু রসিকতা স্বতঃস্ফূর্তভাব বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তাতেও ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা ও কবির মানবতা বিশেষভাবে রূপায়িত হয়েছে। সবশেষে সমালোচকদের ভাষায় বলতে হয়—“কষ্টের খনিত্র দিয়া তিনি জীবনের শ্লেষবন্ধুর ভূমিকে কর্ষণ করিয়া তাহার মধ্যে স্নিগ্ধ সমবেদনা ও সরস কৌতুকের ভোগবতী ধারা প্রবাহিত করেছিলেন।”