চৈতন্যচরিত সাহিত্য : বৃন্দাবন দাস, লোচনদাস, চূড়ামণি দাস, জয়ানন্দ, গোবিন্দদাসের কড়চা

বৃন্দাবন দাস (আনু. ১৫১৯ খ্রীঃ) :

বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম চৈতন্যচরিত গ্রন্থ বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত'। পরবর্তীকালে কোন কোন কাব্যে গ্রন্থটির নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’ও পাওয়া যায়। যেমন ‘প্রেমবিলাস' কাব্যে এই গ্রন্থের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে “বৃন্দাবন মহান্তেরা ভাগবত আখ্যা দিল।” বৃন্দাবন দাসের গ্রন্থে নবদ্বীপে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলিত রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। কবির ঐশ্বর্যমিশ্র ভক্তির দৃষ্টিতে শ্রীচৈতন্যদেব কৃষ্ণ এবং রামচন্দ্রের অবতার রূপে কল্পিত। এই অবতার কল্পনার কারণ, যুগসঙ্কটের কালে পাষণ্ডী দমন ও সাধুদের পরিত্রাণের জন্য শ্রীচৈতন্যদেবের অনিবার্য আবির্ভাব।


বৃন্দাবন দাস প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যলীলা দর্শন করেন নি। কারণ কবির নিজের উক্তি “হইল মনুষ্যজন্ম না হইল দরশন।” নিত্যানন্দ-শিষ্য বৃন্দাবন দাসের জীবন সম্পর্কে সবিশেষ জানা যায় না। গ্রন্থ সাক্ষ্যে বোঝা যায়, শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী নারায়ণী দেবী ছিলেন কবির মাতা। কবির পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত। ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, নবদ্বীপে আনুমানিক ১৫১৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে কবির জন্ম হয়। পরে দেনুড় গ্রামে কবি বসবাস করেন।


চৈতন্যভাগবতের রচনাকাল, ড. মজুমদারের মতে ১৫৪৮ খ্রীস্টাব্দ। আদি, মধ্য ও অস্ত্য এই তিনটি খণ্ডে গ্রন্থটি লেখা হয়। আদিখণ্ডে ১৫ অধ্যায় চৈতন্যের গয়া প্রত্যাগমন পর্যন্ত বর্ণিত। মধ্যখণ্ডে আছে ২৭ অধ্যায়, চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণ পর্যন্ত বিবরণ। অস্ত্য খণ্ডে দশ অধ্যায়, গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন ও গুণ্ডিচা-যাত্রা মহোৎসব বর্ণিত। বিশ্বাসের-বন্দর ছাড়িয়ে ব্যাকুলতার হাওয়ায় পাল তুলে কবির জীবনতরী ভক্তির স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলেছে। তাই তাঁর হ্লাদৈকময়ী উপলব্ধিতে চৈতন্য-নিত্যানন্দ কৃষ্ণ বলরামের অবতার। আদিলীলা বর্ণনার সময়েও কবি অবিস্মৃত “বিদ্যারসে বৈকুণ্ঠের নায়ক বিহারে।” দাস্যভাবের উপাসক কবি সমর্পণের তর্পণে তনু-মন উৎসর্গ করে মহাপ্রভুর জীবনকে ঐশ্বর্যরাগে চিত্রণে প্রয়াসী। তবু চৈতন্যদেবের মানবিক পরিচয়ে গ্রন্থটি আদ্যন্ত উদ্দীপ্ত। মধ্যযুগের সাহিত্য যখন একান্তভাবে দেবপ্রধান, মাটি ও মানুষের স্থান যখন সঙ্কুচিত, তখন এহেন কাব্যে মানুষী ভাবের পরিচয় অবশ্যই প্রশংসার্হ। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে চৈতন্যদেবের মানবিক পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে

“আমি যে বাখানি সূত্র করিয়া খণ্ডন। 

নবদ্বীপে তাহা স্থাপিবেক কোন জন ৷৷ 

নগরে বসিয়া এই পড়াইব গিয়া 

দেখি কার শক্তি আছে দুষুক আসিয়া ৷৷”


কোমলতা-জড়িত পৌরুষে তার চৈতন্য-চরিত্র অনশ্বর। তাঁর কাব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য-ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবরণ। চৈতন্যপূর্ব নবদ্বীপ বর্ণনায় ব্যভিচার-উন্মত্ত সমাজের যে চিত্রাল্পনা পরিস্ফুট, তা বাংলার তামসিক পরিবেশ-শাসিত ঐতিহাসিক নিষ্ঠার ফসল :

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের মোহনায় হোসেন শাহর রাজত্বকালের চালচিত্রে নৈতিক ধ্বংসস্তূপের উপরে সামাজিক জীবনে ব্যভিচারের যে ধ্বস্ নেমেছিল, এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় তা বাস্তবজীবনের এক রঙীন রেখাচিত্র, “হঠাৎ আলোর ঝলকানি।”


তবু তার গ্রন্থটি ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ—(১) এ কাব্যে চৈতন্যজীবনের অসমাপ্ত জীবনবর্ণনা পরিলক্ষ্য। চৈতন্যজীবনের শেষ পর্যায় অপরিচয়ের নীরবতায়। (২) গ্রন্থটি অলৌকিকতার নাগপাশে আবদ্ধ। (৩) বৈষ্ণব বিদ্বেষীদের প্রতি কবির অসহিষ্ণু মনোভাব মানবিকতা ও বৈষ্ণবতার দিক দিয়ে অসমৰ্থনীয়। যেমন—“এত পরিহারেও যে পাপী নিন্দা করে। তবে লাথি মারো তার শিরের উপরে ।”


লোচনদাস :

“নদীয়া-নাগর-ভাবের” উপাসক নরহরি ঠাকুরের স্তাবক লোচনদাসের কাব্যটির নাম 'চৈতন্যমঙ্গল'। রাগরাগিণীর স্বরঝঙ্কারে এ কাব্যের কাহিনীপট ঝঙ্কৃত। ফলে জীবনী-কাব্যের আসরে এক গীতি-আলেখ্য রচনার প্রয়াস এখানে লক্ষ্যণীয়। তাই এখানে অধ্যায় পরিচ্ছেদ অনুপস্থিত। শুধুমাত্র সূত্রখণ্ড, আদিখণ্ড,‌ মধ্যখণ্ড, শেষখণ্ড নামে চারিটি খণ্ড আছে। সূত্রখণ্ডের বিষয় অবতারের স্বরূপ-নির্ণয়, আদিখণ্ডে আছে গয়াগমন পর্যন্ত বর্ণনা, মধ্য খণ্ডে নীলাচলে বাসুদেব সার্বভৌমের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন শেষখণ্ডে তীর্থযাত্রার বর্ণনা, প্রতাপরুদ্রের প্রতি অনুগ্রহ, মহাপ্রভুর তিরোধানে হয়েছে কাব্যের পূর্ণচ্ছেদ।


অসংখ্য খণ্ডবিচ্ছিন্ন মুহূর্তকে, জীবনের কথাকে জীবনীরসে সমৃদ্ধ করার মধ্যে লোচনের কবিত্ব-শক্তির পরিচয় পরিলক্ষিত হয়। যেমন, নির্বাসিত কামনার বেদনায় বিরহিণী বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবনচ্ছবি মাত্র দু’একটি কথার মধ্য দিয়ে রেখায়িত হয়েছে

“হলুদ বাটিতে গোরি বসিলা যতনে 

হলুদ বরণ গোরাচাঁদে পড়ে গেলা মনে।”


তবু ইতিহাসাশ্রিত কবিতার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করলে লোচনের গ্রন্থের ত্রুটি দৃষ্টি এড়ায় না। গৌড়নাগরী মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর ধ্রুব লক্ষ্য। তাই চৈতন্যজীবনের সার্থক ভাষ্যকার না হলেও ড. বিমানবিহারী মজুমদারের ভাষায়, “বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসে লোচনের গ্রন্থ খুব মূল্যবান, কেননা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের একটি শাখার উপাসনা ও ভাব-সাধনা-প্রণালীর বিশদ ও অকৃত্রিম বিবরণ ইহাতে পাওয়া যায়।” লেখকের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কোগ্রাম। পিতা কমলাকর, মাতা সদানন্দী। গ্রন্থরচনার কাল সংশয়াচ্ছন্ন। আনুমানিক ১৫৬০-১৬৭০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে লোচনের কাব্যটি রচিত হয়েছিল।


চূড়ামণি দাস :

লোচনদাসের কাব্যের মতো আরও কয়েকখানি চৈতন্যচরিত গীতিকাব্য ‘পাঁচালী প্রবন্ধ’ রীতিতে বিবেচিত হয়েছিল। তার মধ্যে একটি অংশতঃ, আর একটি সম্পূর্ণ। চূড়ামণি দাসের ‘গৌরাঙ্গ বিজয়’ কাব্যটি অসম্পূর্ণ। সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে গ্রন্থটি লেখা হয়। আদি, মধ্য, অন্ত্য খণ্ডে গ্রন্থটির কথা ও কাহিনী বিভক্ত। লাচাড়ি অংশের তুলনায় ‘শিকলি' অংশই বেশি। নিত্যানন্দ অনুচর ধনঞ্জয় পণ্ডিতের অনুপ্রেরণায় কবির কাব্যসৃষ্টি। চূড়ামণি দাসের উদ্দেশ্য চৈতন্য-সংসারের চিত্রায়ণ। নিত্যানন্দের জ্ঞাতিশত্রু আখগুল আচার্যের বর্ণনা ও কবির বাস্তবানুসিদ্ধ অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান

“আখণ্ডল আচার্য আইলা হেনবেলা

কথাগুলা কএ যেন বোড়া সাপের জ্বালা।..

অকার্য গ্রাহক যে অবাচ্যে তোল বাণী

কাটিয়া ত বড় নালা ঘরে আন পাণী।”


তাঁর কাব্যে গানগুলিতে ব্রজবুলির ব্যবহার দৃশ্যমান। তিনি চৈতন্যকে অবতাররূপে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি। যে জনসাধারণের দৃষ্টিতে চৈতন্য 'অবতার' তাদের জন্যই বইটি লেখা হয়েছে।


জয়ানন্দ :

তার 'চৈতন্যমঙ্গল' গ্রন্থটি গান করার উদ্দেশ্যে সৃজিত। ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, ১৫৬০ খ্রীস্টাব্দের নিকটবর্তী সময়ে কাব্যটি লেখা হয়। নয়টি খণ্ডে গ্রন্থটির আরম্ভ ও অবসান। ধ্রুবচরিত্র, জড়-ভরতের কথা, ইন্দ্রদুম্ন রাজার জগন্নাথ প্রতিষ্ঠার পৌরাণিক বিবরণ থাকলেও তা সংক্ষিপ্ত। তাঁর গ্রন্থের আদিখণ্ডে পৌরাণিক প্রসঙ্গ, নদীয়া খণ্ডে জন্ম বর্ণনা থেকে জগাই-মাধাই উদ্ধার, বৈরাগ্যখণ্ডে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা-উদ্ভব পর্যন্ত, সন্ন্যাসখণ্ডে সন্ন্যাসগ্রহণ ও শান্তিপুরে অদ্বৈত গৃহে আগমন, উৎকল খণ্ডে নীলাচলে যাত্রা, প্রকাশখণ্ডে নীলাচল-মাহাত্ম্য ও চৈতন্যের নীলাচলে স্থিতি, তীর্থখণ্ডে বৃন্দাবন মথুরা ও দক্ষিণ ভারতে তীর্থভ্রমণ, বিজয়খণ্ডে মহাপ্রভুর গৌড়দেশে গমন, নিত্যানন্দ প্রভুর নীলাচল গৌড়ে স্থিতি, উত্তরখণ্ডে গ্রন্থের “অনুবাদ”, মহাপ্রভুর তিরোভাব ও ভক্তদের শোক, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতের দেহত্যাগের উল্লেখ আছে। গ্রন্থের সমস্ত ঘটনাগুলির মধ্যে সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরলদৃষ্ট।


জয়ানন্দের কাব্যের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য— (১) কৃত্তিবাস বন্দনা, (২) চৈতন্যের দেহত্যাগ বর্ণনা। তার মতে, আষাঢ় পঞ্চমীতে রথযাত্রার সময়ে চৈতন্যদেবের “ইটাল বাজিল বাম পাএ আচম্বিতে।” আর তার ফলেই টোটা গোপীনাথের মন্দিরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বারোমাসের বিরহবর্ণনার মধ্য দিয়ে গীতিকবিতার স্পন্দন অনুভূত হয়—

“চৈত্রে চাতক পক্ষী পিউ পিউ ডাকে 

শুনিঞা যে প্রাণ করে তা কহিব কাকে।...

ও গৌরাঙ্গ প্রভু হে, 

তোমার নিদারুণ হিয়া

গঙ্গাএ প্রবেশ করি মরু বিষ্ণুপ্রিয়া।”...


কিন্তু তবু কবিত্ব শক্তির কল্পনা-বিলাস না থাকায় ও মহাপ্রভুর বহিরঙ্গে ভক্তজনের সঙ্গে নাম সঙ্কীর্তনের ছবি এখানে দুর্লভ বলে এ গ্রন্থ সার্থক জীবনীকাব্যের দাবী হতে বঞ্চিত হয়। জয়ানন্দের বাসস্থান মধ্যরাঢ়ের আমাইপুর গ্রাম। পিতা সুবুদ্ধি মিশ্র, মাতা রোদনী। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, ১৫১১ বা ১৫১৩ খ্রীস্টাব্দে কবির জন্ম হয়।


গোবিন্দদাসের কড়চা :

চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সহচর গোবিন্দদাস চৈতন্য জীবনের দিনানুদৈনিক অনুভূতিগুলিকে রোজনামচা বা কড়চায় বেঁধে রেখেছেন। এটি গেয় নয়, পাঠ্যকবিতা। কিন্তু ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে জয়গোপাল গোস্বামীর মাধ্যমে গ্রন্থটি মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে এর অকৃত্রিমতা নিয়ে পণ্ডিত সমাজে বিতর্কের ঝড় ওঠে। গোবিন্দদাসের স্বহস্তে লেখা মূল পুঁথিটি আজও অজ্ঞাত। পর্তুগীজ থেকে আগত বাংলা শব্দের আগাছা কাব্যটির এখানে ওখানে গজিয়ে উঠেছে। তাই ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতানুযায়ী যদিও গ্রন্থটির ভাষা, ভাব ও লেখক অকৃত্রিম, তবু ড. সুকুমার সেন প্রমুখ সমালোচকেরা তা মানতে অনিচ্ছুক ছিলেন।