চৈতন্যচরিত সাহিত্য : বৈষ্ণব ষড় গোস্বামী, রঘুনাথভট্ট গোস্বামী, গোপালভট্ট গোস্বামী, রূপ গোস্বামী

বৈষ্ণব ষড় গোস্বামী :

ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়ম্ – ধর্ম-সম্পর্ক এ অভিযোগ প্রাচীন যুগে স্বীকৃত হলেও দেখা যায়, শ্রেষ্ঠ ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত উপলব্ধিতেই নিঃশেষিত নয়। সমাজ ও সাধারণের প্রয়োজনে তার প্রচার বা প্রকাশ যে-কোনো ধর্ম বিকাশের একটি অন্যতম শর্ত। তাই অবতারকল্প ধর্মাচার্যের পাশাপাশি দেখা যায় তার অনুচর-পরিকরদের পুণ্য আবির্ভাব। এই প্রচার প্রকাশ পায় প্রধানত দুভাবে—তত্ত্বগ্রন্থ প্রণয়নে এবং তাঁদের অনুসৃত আচরণে। স্বয়ং ধর্মাচার্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তাদের ভূমিকা। গৌতম বুদ্ধের মুখ থেকে সদ্ধর্মের প্রথম বাণী শুনেছিলেন পাঁচজন—অন্ন-কোদন্ন, ভাপ্পা, মহানাম, ভদ্য, অশ্যাপি। শঙ্করাচার্যের বাণীবাহক ছিলেন চারজন— হস্তামলক, পদ্মপাদ (সনন্দন), সুরেশ্বরাচার্য (মণ্ডন মিশ্র), তোটকাচার্য। আর শ্রীচৈতন্যের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের স্বীকৃত গোস্বামী হলেন ছ'জন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থেই সর্বপ্রথম পাওয়া যায় তাঁদের নাম

“শ্রীরূপ সনাতন আর ভট্ট রঘুনাথ। 

শ্রীজীব গোপাল ভট্ট দাস রঘুনাথ ॥ ”


প্রকৃতপক্ষে, গ্রন্থের সূচনাতেই ‘এই ছয় গুরু শিক্ষাগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন তিনি নিষ্ঠুণ্ঠ। শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের যে প্রসারলাভ এটি সাধারণ সত্য। কিন্তু এই ধর্মের ‘কায়ব্যূহ' নির্মাণে সমকালে এবং অনতি-পরবর্তীযুগে এই ষড় গোস্বামীর অবদান সীমাহীন। অবশ্য তথ্যগত সাক্ষ্যে, সকলের অবদান সমানভাবে প্রত্যেক চরিতসাহিত্যে স্বীকৃত হয়নি (বিশেষত রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও গোপাল ভট্ট)। সম্ভবত গ্রন্থকার হিসাবে অল্পপরিচিতি, তাঁদের স্বল্পোল্লেখের কারণ।


রঘুনাথভট্ট গোস্বামী :

মহাপ্রভুর এই আদেশ শিরোধার্য করেই গোস্বামী রঘুনাথভট্টের ধর্মজীবনের পথে পদক্ষেপ। তাঁর পিতা তপন মিশ্র চৈতন্যদেবের প্রথম ভক্ত। যিনি পূর্ববঙ্গে প্রভুর অবস্থানের সময়ে সাধ্য সাধন সম্পর্কে তত্ত্বোপদেশ পান। পরে সপরিবারে কাশীবাসী হন। মুরারি গুপ্তের কড়চা থেকে জানা যায় বালক বয়সেই রঘুনাথের মহাপ্রভুর কৃপালাভ। বয়ঃপ্রাপ্তির পর নীলাচলে উপস্থিত হয়ে আটমাস চৈতন্য সঙ্গ লাভ করেন। তিনি তাঁকে “বিবাহ না করিহ বলি নিষেধ করিলা”। তারপর আরো চারমাস কাশীতে এবং পিতা-মাতার মৃত্যুর পর আটমাস নীলাচলে কাটিয়ে তিনি উপস্থিত হন বৃন্দাবনে। যাত্রার পাথেয় সম্মান রূপে পান প্রভুর হাত থেকে “চৌদ্দ হাত জগন্নাথের তুলসীর মালা”, যেটি তাঁর তিরোধান মুহূর্ত পর্যন্ত সঙ্গে ছিল। সুকণ্ঠ ভাবুক ভক্ত রঘুনাথের খ্যাতি গ্রন্থরচনায় নয়, নির্লোভ নিরহঙ্কার বৈষ্ণব যতিজীবনের আদর্শ অনুসরণে এবং সাঙ্গীতিক প্রতিভায়। “পিকস্বর কণ্ঠ তাহে রাগের বিভাগ এক শ্লোক পড়িতে ফিরায় তিন চারি রাগ”—ভাগবত পাঠের এই খ্যাতি ও চরিত্রের মহত্ত্বের জন্যই হয়ত অম্বরাধিপতি মানসিংহের মতো ব্যক্তি তাকে গুরুপদে স্বীকার করেছিলেন। হতে পারে এটি অনুমান, কিন্তু ব্যক্তিজীবনের পুণ্য পথরেখা ধরেই যে ধর্মজীবন মূর্ত হয়ে উঠেছিল, এ তথ্য মিথ্যা নয়।


গোপালভট্ট গোস্বামী :

ষড়গোস্বামীর মধ্যে গোপাল ভট্টের স্থান জন্ম এবং ব্যক্তিপরিচয় নিয়ে বৈষ্ণবশাস্ত্রের এবং সাহিত্যের ইতিহাসে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। তার কারণ


(ক) প্রথমত, তার সম্পর্কে প্রচারিত দ্বৈত-পিতৃনামের অস্তিত্ব-যার মূলে নিহিত কবিরাজ গোস্বামীর অনাবধানতা। “চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যখণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে এবং মধ্যলীলার নবম পরিচ্ছেদে শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে মহাপ্রভুর আশ্রয়দাতা গৃহকর্তা রূপে যথাক্রমে ত্রিমল্ল ভট্ট এবং বেঙ্কটভট্টের নাম পাওয়া যায়। তারই ভিত্তিতে ‘ভক্তিরত্নাকরে’র লেখক নরহরি চক্রবর্তীর সিদ্ধান্ত, গোপাল ভট্ট বেঙ্কট ভট্টের পুত্র; অন্যদিকে মনোহর দাস তার ‘অনুরাগবল্লী' গ্রন্থে তাঁকে ত্রিমল্ল-পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন।


(খ) গোপাল ভট্ট সম্পর্কে সংশয়ের দ্বিতীয় কারণ, বৈষ্ণব গ্রন্থাকারদের আশ্চর্য নীরবতা। কবি কর্ণপুর, বৃন্দাবন দাস, লোচন ও জয়ানন্দ প্রমুখ চরিতকারগণের রচনায় তার পরিচয় অনুপস্থিত। একমাত্র কৃষ্ণদাস কবিরাজ ও মুরারি গুপ্তের গ্রন্থে তাঁর সম্বন্ধে শুধু নামোল্লেখ মাত্র পাওয়া যায়। অথচ ষোড়শ শতকের শেষভাগে রূপ সনাতনের পর বৃন্দাবনে তিনি গুরুরূপে বহুমানিত। শ্রীনিবাস আচার্য তার মন্ত্রশিষ্য। কবিরাজ গোস্বামী তাঁরই অনুমতি নিয়ে গ্রন্থরচনা শুরু করেছিলেন।


(গ) 'হরিভক্তিবিলাস' গ্রন্থকে কেন্দ্র করে তৃতীয় সমস্যার শুরু। ১২৮৯ বঙ্গাব্দে রামনারায়ণ বিদ্যারত্নের সহায়তায় যখন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তখন রচয়িতারূপে গোপাল ভট্টের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু জীব গোস্বামী প্রদত্ত গ্রন্থতালিকায় (লঘুবৈষ্ণবতোষণী’তে) আলোচ্য রচনাটি এবং ‘দিগ্‌দর্শনী’ টীকা গ্রন্থটির লেখকরূপে সনাতন গোস্বামীর নাম দেখা যায়। সুতরাং গোস্বামী গোপাল ভট্ট না সনাতন গোস্বামী—এই দুই স্মরণ্য আচার্যের মধ্যে কে এই গ্রন্থের প্রকৃত রচয়িতা তা সমস্যাচ্ছন্ন। তাছাড়া, মূল গ্রন্থের মধ্যেও বৈষ্ণবধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রসঙ্গে দীক্ষাদানে তান্ত্রিক নিয়ম পালনের উল্লেখ, রাসযাত্রা, রাধাকৃষ্ণ, চৈতন্যমূর্তি পূজা প্রভৃতি বিষয়ে নীরবতা ক্রমাগত সংশয় জাগায়।


(ঘ) সুশীল কুমার দৌর গোপাল ভট্ট নামে দ্রাবিড় দেশবাসী নৃসিংহের পৌত্র এবং হরিবংশ ভট্টের পুত্রের উল্লেখ সংবাদে (Vaishanava Faith & Movement') তার সম্পর্কে চতুর্থ সমস্যার সূত্রপাত হয়। উল্লিখিত এই ব্যক্তি চৈতন্যতত্ত্বে প্রাজ্ঞ। এঁর রচিত ‘কালকৌমুদী’, ‘কৃষ্ণবল্লভী’ ও ‘রসিকরঞ্জিনী’ নামক তিনটি গ্রন্থে তার পরিচয় স্পষ্টরেখ। বাঙলাদেশের বৈষ্ণব মতাদর্শের সঙ্গেও এর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল।


(ঙ) আবার জীব গোস্বামীর ‘ষসন্দর্ভ’ গ্রন্থে দক্ষিণী ভট্ট নামক ভক্ত ব্যক্তির উল্লেখ দেখে অনেকের অনুমান, এই দক্ষিণী ভট্ট ও গোপাল ভট্ট অভিন্ন ব্যক্তি।


গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব, আদর্শ ও দর্শনের মননশীল ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক অবদান প্রধানত তিনজনের—সনাতন, রূপ ও শ্রীজীব গোস্বামীর। বৃন্দাবনের কবি ও ভক্তসম্প্রদায় তাঁদেরই নির্দেশিত চিন্তাধারার অনুগামী হয়েছেন।


রূপ গোস্বামী :

সনাতন, রূপ ও তাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব গোস্বামীর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কর্ণাট অঞ্চলের সুপণ্ডিত ও সম্পন্ন ব্যক্তি। সেই বিত্ত ও বিদ্যার উত্তরাধিকার পরবর্তীকালে গৌড়ের রামকেলিগ্রামে বসবাসী তাঁদের বংশধরেরা রীতিমত চর্চায় আয়ত্ত করেছিলেন। শুধুমাত্র সনাতনের ছ'জন গুরুর কাছে শিক্ষালাভের সংবাদ পাওয়া যায়। রূপ এবং সনাতন, দুইজনেই সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা ছাড়া আরবী এবং ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। বিত্তের ক্ষেত্রেও তারা অসামান্য সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সনাতন গোস্বামী ছিলেন গৌড় সুলতান হোসেন শাহের ‘দবীর খাস’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত সচিব। তার ভাই রূপ গোস্বামী ছিলেন ‘সাকর মল্লিক’ বা রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা। যশোহর জেলার য়ুসুর ও চেঙ্গুটিয়া পরগনা এই ভাইদের দখলে ছিল। এজন্য তারা সুলতানকে কিছু রাজস্বও দিতেন। শ্রীচৈতন্যের ডাকে তাঁদের গৃহত্যাগ, গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য অর্থ বিতরণের কাহিনী রীতিমত রোমাঞ্চকর এবং সর্বজনপরিচিত ঘটনা। শোনা যায়, সনাতন ও রূপের নাম শ্রীচৈতন্যেরই দেওয়া, পূর্বজীবনে তাদের নাকি নাম ছিল সত্তোষ (সনাতন) ও অমর (রূপ)। অনেকের অনুমান, তাঁরা ছিলেন ‘পিরালী' মুসলমান (বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়)। কিন্তু এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি অনুপস্থিত। রূপ সনাতনের মতো মান্যজন যখন বলেন

নীচজাতি নীচ সঙ্গী করি নীচ কাজ।

তোমার অগ্রেতে প্রভু! কহিতে বসি লাজ ।”


তখন একে বৈষ্ণবের দুর্লভ বিনয়োক্তি বলে ভাবাই সঙ্গত, মুসলমান সুলতানের অধীনে চাকরীর জন্য পাতিত্যদোষও হতে পারে। বৈষ্ণব ধর্মের গবেষক রমাকান্ত চক্রবর্তী ‘বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “এত বড় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং সাহিত্যিক হলেও নবদ্বীপের প্রতিক্রিয়াশীল পণ্ডিত সমাজে সম্ভবত ‘যবন’দের সঙ্গে থাকার জন্যেই রূপ-সনাতনের কোনও স্থান ছিল না। চৈতন্যই তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন (প্রথম সংস্করণ, জানুয়ারি ১৯৯৬, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৫২)। এঁরা দুই ভাই চূড়ান্ত দরিদ্রের জীবনযাপন করেন।