বাংলা গদ্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাপর্ব : প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪ খ্ৰীঃ- ১৮৮৩ খ্ৰীঃ)

বাংলা গদ্যে প্যারীচাঁদ মিত্র


উনিশ শতকে বাংলা নবজাগরণের এক দীপ্তিমান নক্ষত্র ‘টেকচাদ ঠাকুর' ছদ্মনামী প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যে সামাজিক উপন্যাস “আলালের ঘরের দুলাল” -এর মহান স্রষ্টা হিসাবে অবিস্মরণীয়।


প্যারীচাঁদ মিত্রের জন্ম ও কর্মজীবন

১৮১৪ খ্রীস্টাব্দের ২২শে জুলাই কলকাতায় প্যারীচাদের জন্ম হয়। ১৮২৭-এর ৭ই জুলাই তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এর এক বছর পূর্বে ডিরোজিও এই কলেজে শিক্ষকরূপে যোগ দেন। কলেজে প্যারীচঁাদের সহপাঠী হন রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিরা। ১৮৩১-এ ডিরোজিওর ছাত্রেরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। ১৯৩২-এ মহেশচন্দ্র ঘোষ ও পরে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত হন। ১৮৩৬ সালে প্যারীচাদ কৃতী ছাত্র রূপে হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপরে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরীর সাব লাইব্রেরীয়ান পদে যোগদান করেন। ১৮৪৮ সালে লাইব্রেরীয়ান পদে উন্নীত হন। তবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার দিকেও তার আগ্রহ দেখা যায়। সেইজন্য লাইব্রেরীয়ানের পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু কর্মনিষ্ঠার জন্য লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ তাকে আজীবন কিউরেটর ও কাউন্সিলরের মর্যাদা দেন। ১৮৩৯ সালে প্যারীচাদ ‘কালাচঁাদ শেঠ এ্যান্ড কোম্পানী’তে আমদানী-রপ্তানীর কাজ করেন। পরে ১৮৫৫ সালে দুই ছেলেকে নিয়ে ‘প্যারীচাঁদ মিত্র এ্যান্ড সন্স' নাম দিয়ে কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেন। পরে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্যারীচাদ ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোং লিমিটেড’, ‘পোর্ট, ক্যানিং ল্যাব, ইনভেস্টমেন্ট কোং’, ‘হাওড়া ডকিং কোং লিমিটেড’, ‘বেঙ্গল টি কোং', “ডারা টি কোং লিমিটেড' ইত্যাদি একাধিক প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হন।


প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনাসমূহ

(১) গ্রন্থরচনা : 'আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৮), 'মদ খাওয়া বড় দায়, জাত রাখার কি উপায়’ (১৮৫৯), 'রামারঞ্জিকা' (১৮৬০), ‘কৃষিপাঠ’ (১৮৬১), ‘যৎকিঞ্চিং’ (১৮৬৫), 'অভেদী' (১৮৭১), 'আধ্যাত্মিকা' (১৮৮০), ‘ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত’ (১৮৭৮) এবং ‘গীতাঙ্কুর' (১৮৬১) নামে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত সঙ্কলন' প্রভৃতি।


(২) পত্রিকা সম্পাদনা : রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘মাসিক পত্রিকা’ (১৬ অগাস্ট ১৮৫৪) প্রকাশ।


তিনি ছিলেন বিপ্লবী ডিরোজিওর ছাত্র। কিন্তু ইয়ংবেঙ্গলের কালাপাহাড়ী উদ্দামতার মধ্যে নিমজ্জিত হননি। তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী। তাই তাঁর ‘রামারঞ্জিকা’ হয়ে উঠেছিল এক অবশ্যপাঠ্য নীতিগ্রস্থ, 'অভেদী’ ধর্মসমন্বয়গত ঔদার্যের সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক, আর মদ খাওয়া বড় দায়’ মদ্যপান নিবারণী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল। দীক্ষিত ব্রাহ্ম না হয়েও তাঁর রচনাবলী ব্রাহ্ম ভাবধারাতেই প্রাণিত।


প্যারীচাদ ও বিদ্যাসাগরের মধ্যে তুলনা :

(ক) বয়সের বিচারে প্যারীচাদ ছিলেন বিদ্যাসাগরের বয়োজ্যেষ্ঠ। তার জন্ম ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দে, আর বিদ্যাসাগরের ১৮২০ খ্রীস্টাব্দে। প্রথম জনের জন্ম কলকাতায়, দ্বিতীয় জনের মেদিনীপুরে। (খ) বিদ্যাশিক্ষা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের ক্ষেত্রেও প্যারীচঁাদ ছিলেন বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী। নারীশিক্ষা এবং বিধবা-বিবাহ প্রচলন বিদ্যাসাগরের যেমন অমরকীর্তি, তেমনি প্যারীচাদও “স্ত্রীলোকদিগের নিমিত্তে” বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশ (১৮৫৫ খ্রীঃ) করেছিলেন, 'নারীকল্যাণমূলক উপন্যাস’ ‘আধ্যাত্মিকা’ এবং স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ক ‘বামাতোষিণী’ প্রভৃতি গ্রন্থ লিখেছিলেন। (গ) সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন প্যারীচাদের অগ্রযাত্রী। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি' প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দে, প্যারীচাদের ‘আলালের ঘরের দুলালে’র (১৮৫৮ খ্রীঃ) এগারো বছর আগে। (ঘ) প্যারীচাদের সাহিত্যসাধনা প্রধানত ব্রাহ্মধর্মের সপক্ষে নিয়োজিত এবং কিছু অংশ থিয়োসফির গূঢ় তত্ত্বে নিবদ্ধ। কিন্তু বিদ্যাসাগর ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কে নীরব, তার সাহিত্য সাধনার মূলে মানবচেতনা তথা মানবিক বৈশিষ্ট্যই স্বপ্রকাশ হয়ে উঠেছে। (ঙ) প্যারীচাদ উপন্যাস লেখার সচেতন ভাবনা নিয়ে ‘আলাল’ বা ‘আধ্যাত্মিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থ লিখেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র অনুবাদ করেই তাঁর মধ্যে শৈল্পিক গুণাবলী প্রকাশ করেছিলেন। (চ) কৌতুকপ্রিয়তা, বাস্তববুদ্ধি এবং কথার বয়ান-দক্ষতা ‘আলাল’ রচয়িতা টেকচঁাদ-রূপী প্যারীচাদকে যে প্রথম ঔপন্যাসিকের গৌরবে ভূষিত করেছিল, পরবর্তী গ্রন্থগুলির মধ্যে সেইসব গুণের অভাব তার প্রতিভার পরিণতি নির্দেশ করে না। পক্ষান্তরে বিদ্যাসাগরের প্রথম পর্যায়ে অনুবাদকর্ম থেকে পরবর্তী পর্যায়ের ব্যঙ্গরচনার মধ্যে ভাষারীতির বৈচিত্র্য ও সুপরিণতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।


সাগরী গদ্য এবং আলালী গদ্যের মধ্যে পার্থক্য:

ভাষারীতির থেকে প্যারীচাদ যেন বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করবার জন্যই সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিলেন। যেমন—আলালী ভাষার বৈশিষ্ট্য হল : ভাষায় তীব্র শ্লেষ ও কৌতুকরস; বাক্যরীতির কথ্যভঙ্গিকলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের ভাষায় আরবী-ফার্সী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ; দেশী বিদেশী ও তৎসম শব্দের ব্যবহার ক্রিয়া-বিভক্তি, কারক-বিভক্তি ও অব্যয়ের নতুন রূপ আবিষ্কার এবং সমাস-সন্ধিযুক্ত দীর্ঘ জটিল বাক্য।


প্যারীচাদ বিদ্যাসাগরের ‘পণ্ডিতী রীতি'র গদ্যাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। অথচ একথা সত্য, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যের মধ্যে সরাসরি পাণ্ডিত্য না দেখিয়ে ব্যাকরণের উপাদানকে সাজিয়ে শিল্পের উপাদানে পরিণত করেছিলেন; যেমন—বাংলা ভাষার স্বভাবানুযায়ী পদবিন্যাস রীতি স্থাপন করা, কমা-সেমিকোলন প্রভৃতি বিরামচিহ্ন প্রয়োগ করে আদি হ্রস্ব, হ্রস্বতর বা দীর্ঘ যতি-পদ্ধতির বিস্তারিত ব্যবহার; ভাষার মধ্যে ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করে অন্ত্যছন্দের আবিষ্কার ইত্যাদি। আসলে, বিদ্যাসাগর সারা জীবন ‘পণ্ডিতী রীতির’ গদ্য ব্যবহার করেন নি। তার শেষ জীবনের polymics-গুলিতে কথ্য বাক্‌ভঙ্গীর স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দেখা যায়। অনুরূপভাবে ‘আলালে’র রচয়িতা প্যারীচাদও তার পরবর্তী রচনাগুলির মধ্যে কথ্যরীতি ত্যাগ করে জটিল ভাষাভঙ্গী ব্যবহার করেছেন। তাই বলা চলে, ভাষা ও ভাবের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যেমন সমাজমুখীন তেমনি ক্রমান্বয়ে সরলতামুখীন; কিন্তু প্যারীচঁাদ ক্রমান্বয়ে জটিলতামুখীন। দ্বিতীয়ত, লেখক বিদ্যাসাগরের অনেক বেশি ব্যবহারিক বুদ্ধি ছিল। বই লেখা, মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সংযোগ, সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরী বা বইয়ের দোকান খোলা ইত্যাদি সক্রিয় উদ্যোগ তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তাই মনে হয়, কি ভাবগত কি প্রয়োগগত বা ভাষাগত আদর্শে প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন যেন বিদ্যাসাগরের বিপরীত মেরুতে অবস্থিত।


আলালের ঘরের দুলাল :

ব্রাহ্মসমাজের আদর্শবাদ 'আলালে’ সম্পূর্ণভাবে অভিব্যক্ত। সুশিক্ষা, নীতিবোধ, সুরুচি, সেবাধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতাই সমগ্র গ্রন্থটির প্রতিপাদ্য। বইটির আদর্শ চরিত্র বরদাবাবুর চিন্তা ও কর্মধারা যেন ব্রাহ্ম সুশিক্ষার দ্বারাই গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত। গ্রন্থটি অশ্লীলতা-বিহীন। এর বীভৎস দৃশ্যগুলি শুভ্রাভাস রুচির শুচিতায় পরিস্নিগ্ধ। এর মর্মগত সুশিক্ষার বাণী, একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক আখ্যান। চরিত্রসৃষ্টিতেও আছে চমৎকার নৈপুণ্য। লোকায়ত ভাষার সংযত প্রয়োগে গ্রন্থটি স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।


‘মাসিক পত্রিকার’ প্রথম বর্ষের সপ্তম সংখ্যা থেকে ‘আলাল' প্রকাশিত হয়। সমকালে গ্রন্থটি লাভ করেছিল বিপুল অভিনন্দন। কারণ রোমান্টিক আখ্যান ও শিশুলোভন রূপকথার জলাভূমি পার হয়ে এই প্রথম উপন্যাসের বেলাভূমি দেখা গেল। অবশ্য সার্থক উপন্যাসের যথাযথ লক্ষণ এই আখ্যানটিতে অনুপস্থিত। তবু রোমান্স-আশ্রিত বাংলা আখ্যানকে বাস্তবজীবনের পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত করার প্রথম প্রয়াস দেখা গেল, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাই ‘আলাল’কে জানিয়েছিলেন রাজসিক অভিনন্দন : “তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরের কাছেই আছে—তাহার জন্য ইংরাজী সংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে যেমন জীবনে তেমনি সাহিত্যে, ঘরের সামগ্রী যত সুন্দর, পরের সামগ্রী তত সুন্দর বোধ হয় না।” ঘরের সামগ্রী দিয়ে সারস্বত সাধনার দৃষ্টান্তস্থাপনে প্যারীচাদের কৃতিত্ব ছিল অপরিসীম।


নীতিহীন ধনী পরিবারের আদরের সন্তান কিভাবে কুশিক্ষার ফলে অধঃপথে যায়, গল্পের নায়ক মতিলাল তার নিখুঁত নিদর্শন। আবার অন্যদিকে সুশিক্ষার গুণে আর একজন কিভাবে মূর্তিমান মনুষ্যত্ব হয়ে ওঠে রামলাল তার আদর্শ দৃষ্টান্ত। কিন্তু শুধু নীতিশিক্ষার দীপ্তিতেই ‘আলাল’ মহিমান্বিত হয়নি, উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ—জীবনের স্পর্শস্বাদ—তাও এখানে সহজলভ্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষই 'আলালে' স্বমহিমায় উপস্থিত। প্রেমনারায়ণ মজুমদার, কবিরাজ ব্রজনাথ রায়, মৌলভি, উৎকলীয় পণ্ডিত, আদালতের ঘুষখোর পেশকার, ভণ্ড শিক্ষক বক্রেশ্বর—প্রত্যেকেই টেকচঁাদের তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতার আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্তু চরিত্র হিসাবে যে ব্যক্তিত্বটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে নিঃসঙ্গ তা হল মামলাবাজ ও কূটবুদ্ধির প্রতীক ‘ঠকচাচা’। তার ফার্সী মেশানো সংলাপ যেমন সার্থক, জীবনদর্শনও তেমন সহজিয়া : “দুনিয়াদারি করতে গেলে ভালো-বুরা দুই চাই—দুনিয়া সাচ্চা নয়,– মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করব।” নীলকরদের অত্যাচার, সামাজিক দুর্নীতির বেসাতি, বিচার প্রহসন—সবকিছুই সমাজসচেতন শিল্পী যেন ফোটোগ্রাফিক ছবির মতো ক্ষুরধার দৃষ্টির এক্স-রে লেন্সে ধরে ফেলেছেন। ‘টাইপ’ চরিত্র সৃষ্টিতেও তিনি দ্বিতীয়রহিত। প্যারীচঁাদের ‘আলালেই’ হুতোমের চিত্র পূর্ণায়ত হয়ে উঠেছে।


প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্যরীতি:

'আলালে’র অন্যতম সম্পদ এর ভাষারীতি। আলালী ভাষার বৈশিষ্ট্য হল

  • (ক) বাক্যরীতির কথ্যভঙ্গি—লোকব্যবহার্য ভাষার অনুসরণ, সরল ও সর্বজনবোধ্য গদ্যে কাহিনীকথনের চেষ্টা।
  • (খ) কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের ভাষা ও আরবী-ফার্সী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ। (গ) দেশী বিদেশী ও তৎসম শব্দের অবাধ ব্যবহার (“মশায়ের যেমন কাণ্ড, ভাত খেতে বস্তেছিনু” —হরে চাকর) ক্রিয়া বিভক্তি, কারক ও অব্যয়ের নতুন রূপ আবিষ্কার।
  • (ঘ) সমাস-সন্ধিযুক্ত দীর্ঘজটিল বাক্য পরিহার।
  • (ঙ) প্রবচন প্রয়োগ ইত্যাদি।

আলালের গদ্যে পণ্ডিতী বাংলা বা সংস্কৃতের উৎপাত নেই। হয়ত সময় বিশেষে শ্রীহীন, কিন্তু হাস্যরসে উচ্ছল। তাই সংস্কৃতপন্থী ও লোকব্যবহার্য ভাষার সুষম সমন্বয়ে যে আদর্শ বাংলা গদ্যের প্রকাশ ঘটবে উপন্যাসে, বঙ্কিমচন্দ্র 'আলালে’র মধ্য দিয়ে তার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

‘আলালে’ অন্তর্জগতের গহনগূঢ় বার্তা অনুপস্থিত। কিন্তু সে অভাব থাকলেও অন্য গুণ বিরল নয়। ঘটনাবৈচিত্র্যে, সুমিত হাস্যরসে, বহুবিধ মানুষের উপস্থিতিতে এবং জীবনরসের নির্বাধ ফল্গুধারায় এই গ্রন্থ সমৃদ্ধ। প্রথম সামাজিক উপন্যাসের পক্ষে এ সাফল্য অল্প নয়।


প্যারীচাঁদ মিত্রের অন্যান্য উপন্যাস:

প্যারীচাদের ‘রামারঞ্জিকা’ ‘অভেদী' কিংবা 'আধ্যাত্মিকার’ সাহিত্যগুণ অকিঞ্চিৎকর, নীতিশিক্ষাই মুখ্য। 'অভেদী' উপন্যাসের নায়ক অন্বেষণচন্দ্র। তিনি সত্যান্বেষী কিন্তু সংসারনিষ্ঠ নন। গৃহদাহে স্ত্রীকন্যার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর অরণ্যে ও লোকালয়ে তিনি সত্যসন্ধানে ব্যাপৃত হন। অথচ যথার্থভাবে মৃত্যু না হওয়ার ফলে স্ত্রী পতিতভাবিনী স্বামীর অনুসন্ধান করতে থাকেন। শেষে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পর্যায়ক্রমে সাধনার পর স্বামী-স্ত্রীর মিলন হয়, রম্না পর্বতে অভেদীর কাছ থেকে তাঁরা দীক্ষালাভ করেন। এখানেই উপন্যাসের সমাপ্তি। পার্শ্বচরিত্র রূপে বাবুসাহেব, জেঁকো বাবু ও লালবুঝকড় চরিত্রের বাচনভঙ্গীর দ্বারা কিছু কৌতুকরস সৃষ্টির প্রচেষ্টা আছে। উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা বাস্তবজীবন থেকে আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নীত হয়। সেই কারণে ‘অভেদীকে’ রূপক উপন্যাসও বলা যেতে পারে। এই উপন্যাসে সমকালীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র আছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি নব্যদলের আচরণের বিপক্ষে কটাক্ষ আছে, যেমন

“পৈতাফেলা— পৌত্তলিকতা ইত্যাদি ইংরাজী বহি পড়ার দরুণ— আপনি কি বলেন। অন্বেষণচন্দ্র। তাহা হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত কারণ এই যে, বাহ্য প্রবল অক্তর দুর্বল—এইজন্য আত্মা দণ্ডে দণ্ডে নব সংস্কারাধীন। যেমন তরকারী সম্ভলনকারী হাঁড়িতে তপ্ত-ঘৃত উপরে ফোড়ন দিলে ফড়ফড় শব্দ হয়, তেমন প্রবল বাহ্য কারণ বশাৎ নব নব মত ও বিশ্বাসের সৃষ্টি—তাহার কি তর্জন-গর্জন হইবে না? অবশ্যই হইবে। কিন্তু স্থায়ী হইতে পারিবে না।”


তার পরবর্তী উপন্যাসের নায়িকা আধ্যাত্মিকা শিক্ষা ও যাবতীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিপুল পারদর্শিতা দেখিয়ে আত্মসাধনায় চরম সিদ্ধিলাভ করেছে। শেষে সাংসারিক বিপর্যয়ে স্থৈর্য, খ্যাতি অর্জন করে ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। লেখকের মতে “যে সকল স্ত্রীলোক আত্মতত্ত্বজ্ঞ নহেন, তাহাদিগের পতি প্রয়োজন। কারণ পতি গ্রহণে স্ত্রী পুরুষের শুদ্ধ প্রেম পরস্পরে সর্বদা অর্পিত হইলে নিষ্কাম ভাবের উদ্দীপনা, নিষ্কাম ভাবের উদ্দীপনে আত্মার উদ্দীপন।


প্যারীচাদের ‘যৎকিঞ্চিৎ' গ্রন্থের মধ্যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বর কিরূপ, তাঁহার সহিত কি সম্বন্ধ, আত্মার অবিনাশিত্ব, ঈশ্বরের রাজ্যের নিয়ম, উপাসনা, ঈশ্বর কি প্রকারে উপাস্য, পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, আত্মোন্নতি” ইত্যাদি গূঢ় তত্ত্বকথা দুটি চরিত্র জ্ঞানানন্দের বক্তৃতা ও প্রেমানন্দের প্রার্থনার মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এই গ্রন্থের শেষে প্যারীচাদের ব্রাহ্মধর্ম সম্বন্ধে মনোভাব সুস্পষ্টভাবে জানা যায় : “এ ধৰ্ম্ম সমুদ্র স্বরূপ—অন্য অন্য ভিন্ন ভিন্ন নদী স্বরূপ যত ধর্ম আছে, তাহা কালেতে এই ধৰ্ম্মেতে বিলীন হইবে। এই ধৰ্ম্মই নিত্য ধৰ্ম্ম—এই-ই সত্য ধৰ্ম্ম—এই-ই ব্রাহ্ম ধৰ্ম্ম”।


প্যারীচাদের শেষ পর্যায়ের বিবিধ রচনার মধ্যে ‘রামারঞ্জিকা’, ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’ এবং ‘বামাতোষিণী’ বিশেষভাবে স্ত্রীশিক্ষামূলক। প্রথম গ্রন্থে স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে গ্রন্থাকারের পাণ্ডিত্যপূর্ণ অভিমত কথোপকথনের আকারে উপস্থাপিত। কুড়িটি পরিচ্ছেদের মধ্যে প্রথম ষোলটিতে হরিহর এবং তার স্ত্রী পদ্মাবতীর মধ্যে ‘গৃহকথা’ আলোচনাকালে স্ত্রীশিক্ষার বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। শেষ চারটি পরিচ্ছেদে আছে ‘জাপান দেশের স্ত্রীলোক’, ‘সৎ স্ত্রীকে স্বামী কখনও ভুলিতে পারে না’, ‘ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্মে পথ’, ‘ধৰ্ম্মপরায়ণা নারী’ প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে আছে ‘ব্রহ্মবাদিনী’, ‘আর্য্যরাজ্য’, ‘ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যোবধূ’, ‘উচ্চসদ্যোবধূ', ‘স্ত্রীলোকদিগের সম্মান’, ‘পুনর্বিবাহ’, ‘সহমরণ ও ব্রহ্মচর্য’, ‘বিবাহ’, ‘স্ত্রীলোকদিগের বাহিরে গমন’, ‘রাণীদিগের রাজ্যগ্রহণ’, ‘পরিচ্ছদ ও গমনাগমন’, ‘বৌদ্ধমত’, ‘রানীদিগের গৃহ’, ‘দয়াদি’, ‘চৈতন্য'— ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা।


নারীকল্যাণমূলক উপন্যাস ‘বামাতোষিণী’তে পারিবারিক স্বাস্থ্যরক্ষা, শিশু ও স্ত্রী শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রন্থকারের অভিমত নায়ক গোপাল, স্ত্রী শাস্তিদায়িনী, কন্যা ভক্তিভাবিনী ও পুত্র কুলপাবনের দ্বারা ব্যক্ত হয়েছে। এখানে ঘটনাসূত্রে 'ইউরোপীয় উচ্চ নারীদিগের বিবরণ’, ‘বিলাতীয় বিবিদিগের বিবরণ দিয়ে প্যারীচাঁদ নারী চরিত্রের আদর্শ নির্দেশ করেছেন।

‘ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত্র' রচনার মধ্য দিয়ে লেখক প্রার্থনা করেছেন “জগদীশ্বর আমাদিগকে এই কৃপা করুন যে, হেয়ার সাহেবের যেরূপ শুদ্ধ প্রেম ছিল, সেই শুদ্ধ প্রেমে আমরা যেন পরিপূর্ণ থাকি।”


প্যারীচাদের অন্যান্য প্রবন্ধ ও ইংরেজী রচনাবলী মূলতঃ তত্ত্বনিবন্ধ। শুধু ‘গীতাঙ্কুর’ রাগরাগিণী ও তালের উল্লেখসহ ৩৪টি ব্রহ্মসঙ্গীতের সঙ্কলনরূপে স্মরণীয় হয়ে আছে।

সুতরাং বলা চলে, প্যারীচাদের খ্যাতির উৎস তার 'আলালের ঘরের দুলাল' হলেও তার মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিচয় সেখানে পাওয়া যাবে না। সামগ্রিকভাবে তার সাহিত্যকর্ম স্মরণীয় হয়ে উঠেছে 'for its significance in the history of ideas.