কর্তামশাই চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

প্রহসনে নবকুমারের পিতা কর্তামশায়রূপে উল্লিখিত। তিনি পরম ভক্ত বৈষ্ণব। নবকুমার নিজেই বলেছে—“বোধ করি কলকাতায় আর এমন ভক্ত দুটি নাই।” কণ্ঠামশাই বৃন্দাবনেই বাস করেন, কখনো কখনো কলকাতায় এসে নিজ গৃহে থাকেন। কলির কলকাতা সম্পর্কে তাঁর ভীতি ছিল প্রচণ্ড। কারণ—‘কলকাতা শহর বিষম ঠাঁই – পাপ ও দুর্নীতির কেন্দ্রভূমি। নিষ্ঠাবান বৈব বলেই শ্রীমদ্ভাগত ও গীতগোবিন্দ নাম শুনেই তাঁর চিত্তে ভক্তিভাবের উদয় হয়। তার বৈশ্বব সুলভ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কালীনাথ নিজেকে জনৈক ভক্তি বৈবের ভ্রাতুষ্পুত্র বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে এবং নবকুমার যাতে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় যেতে পারে তার অনুমতি আদায় করে নিয়েছে।


তবে কর্তাবাবু সরল হলেও বোকা নয়, পিতৃ কর্তব্য সম্বন্ধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় পুত্রকে যেতে দিলেও কালীনাথ ও নবকুমারের কথার মধ্যে কিছুটা অসংলগ্নতা লক্ষ করে তাঁর মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জেগে উঠেছে এবং পুত্র সম্পর্কে খোজ খবর নেবার জন্যে বাবাজিকে সিকদার পাড়ায় পাঠিয়ে নিজের কর্তব্য পরায়ণতার পরিচয় দিয়েছেন। পুত্রের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় সদা চিন্তিত এক আদর্শ পিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে এখানে। নবকুমার সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ যে অমূলক নয় তা পরে প্রমাণিত হয়েছে।


পরিবারের কর্তা হিসাবে গোটা পরিবারের ওপর তাঁর একটা কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরিবারের সকলেই তাঁকে সমীহ শ্রদ্ধা করত। এমনকি নবকুমারও তাকে অগ্রাহ্য করে অপ্রত্যাশিত জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় যেতে পারেনি। পিতা বৃন্দাবন ছেড়ে ভাবে কলকাতায় চলে এসেছেন বলে তার স্বাধীন চলাফেরা যে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তা তার কথাতেই স্পষ্ট—“কর্তা এখন কেমন হয়েছেন যে, দশমিনিট যদি আমি বাড়ি ছাড়া হই তাহলে তখনই তত্ত্ব করেন।” তার চলাফেরার প্রতি পিতার সদা সতর্ক প্রহরায় সে যে চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিল তা বোঝা যায়। বন্ধু কালীনাথ বৈঠকখানায় বসে মদ আনার কথা বললে নবকুমার পিতার ভয়ে ভীত হয়ে তাকে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ করেছে এবং মুখের গন্ধ দূর করার জন্য তাকে পান খেতে বলেছে। সুতরাং পিতার উপস্থিতি এবং তাঁর ব্যক্তিত্বকে উপেক্ষা করার সাহস অন্তত সজ্ঞান অবস্থায় নবকুমারের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।


প্রয়োজনে কর্তামশায় কতখানি দৃঢ় ও কঠিন হতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া যায় প্রহসনের শেষ দৃশ্যে। মাতাল দুশ্চরিত্র লম্পট পুত্র যখন পানোন্মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে বমি করেছে। 'মদ ল্যাও' বলে চিৎকার করেছে, নিজের স্ত্রীকে পয়োধরী বলে সম্বোধন করেছে, তখন বিচলিত ক্রুদ্ধ পিতা তাকে বংশের কুলাঙ্গার বলে অভিহিত করেছেন। লজ্জায় ক্ষোভে আপন গৃহিণীকে বলেছেন যে জন্মলগ্নেই কেন তাকে নুন খাইয়ে মেরে ফেলা হয়নি, তাহলে পিতা হিসেবে পুত্রের এই শোচনীয় অধঃপতন তাকে দেখতে হত না। তার পরেই তিনি এই পাপনগরী পরিত্যাগ করে সপরিবারে কাশী চলে যাবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছেন। আর তাঁর নবরূপী বাঁদর পুত্রটি মদের ঘোরে বলে উঠেছে—–“হিয়র হিয়র আই সেকেন্ড দি রেজোলুশান।”


কর্তা মহাশয়ের সংলাপ ব্যবহারে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়। যখন তিনি আত্মমগ্ন অবস্থায় স্বগত উক্তি করেন তখন তিনি চলিত ভাষা ব্যবহার করেন। যেমন—“একবার বাবাজিকে পাঠিয়ে দি না কেন, দেখে আসুক ব্যাপারটিই কী। আমার মনে যেন সন্দেহ হচ্ছে যে নরকে যেতে দিয়ে ভাল করি নাই।” কিন্তু তিনি যখন জনসমক্ষে কথা বলেন তখন তিনি সাধুভাষা ব্যবহার করেন। এই ভাষা ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তাঁর চরিত্রের ব্যক্তি-মহিমাও যেন ফুটে ওঠে। যেমন— “তোমার স্বর্গীয় গুড়া মহাশয় আমার পরম মিত্র ছিলেন; “জয়দেব ? আহা কবি কুলতিলক, ভক্তিরস সাগর।” আলোচ্য উক্তিগুলি তাঁর শুদ্ধ নির্মল চরিত্রটিকে মুহূর্তেই যেন আভাসিত করে তোলে।