মনোহরলালের চরিত্রের সার্থকতা লেখো।

মনোহরলালের সদর ও অন্দরে অনেক জটিলতা থাকলেও, চরিত্র হিসাবে অজটিল, ফ্ল্যাট-ধরনের। রবীন্দ্রনাথ সাবেককালের এই জমিদারটির পরিচয় ও চরিত্ররীতি সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছেন:- 'মনোহরলালের ছিল সাবেককেলে বড়োমানুষি চাল। যে-সমাজ তাঁহার সেই সমাজের মাথাটিকেই আশ্রয় করিয়া তিনি তাহার শিরোভূষণ হইয়া থাকিবেন, এই তাঁহার ইচ্ছা। সুতরাং সমাজের হাত-পায়ের সঙ্গে তিনি কোনো সংস্রব রাখেন না। সাধারণ লোকে কাজকর্ম করে, চলে ফেরে; তিনি কাজ না-করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনটির কেন্দ্রস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন।'


তিনি সেবা পেতে ভালোবাসেন। সুখী অলস জীবনযাপনে তিনি অভ্যস্ত। তাঁর একটি চাকর আছে, রামচরণ। 'বাবুর দেহ রক্ষা করা’র জন্য তাকে ‘শরীররক্ষা ও শরীরপাত' করতে হয়। যদি সে নিশ্বাস নিলে বাবুর নিশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন না হত তাহলে সে বাবুর জন্য অহোরাত্র হাঁপাতে রাজি। হাতের গুড়গুড়ির নলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে বাবুর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সুখটুকুও মনোহরলাল হাতছাড়া করতে নারাজ। আর একজন অনুচর নীলকণ্ঠ। সে মনোহরলালের বিষয়-আশায় পরিচর্যা করে। তার মানে বাবুকে কোনোরকম কায়িক ও মানসিক ক্লেশই সইতে হয় না। জমিদারির ব্যাপারে যেমন তিনি মাথা ঘামান না, সংসারের ব্যাপারেও তেমনি। মধুকৈবর্তের ব্যাপারে বনোয়ারিলাল বাবার কাছে নীলকণ্ঠের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে হাজির হলে দেখি তিনি বাগানে দিঘির ঘাটে তাঁর নধর শরীরটি উন্মোচন করে আরামে হাওয়া খাচ্ছেন। তাঁর পারিষদদের মুখে অন্য পাড়ার জমিদার অখিল মজুমদার কলকাতার ব্যারিস্টারের জেরায় জেলাকোর্টে কিরকম নাকাল হয়েছিলেন বসন্ত সন্ধ্যার বায়ুসহযোগে সেই রসালো কাহিনি উপভোগ করছিলেন। বনোয়ারি সেই সময় নীলকণ্ঠের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উত্থাপন করল, নানাভাবে সে-অভিযোগে দোষীও সাব্যস্ত করল। কিন্তু তিনি কর্ণপাত করলেন না। তাঁর মতো পোড়-খাওয়া জমিদার জানেন:- ‘আবহমানকাল এমনি ভাবেই সংসার চলিয়া আসিতেছে...চুরি করিবার চাতুরী যাহার নাই, মনিবের বিষয়রক্ষা করিবার বুদ্ধিই বা তাহার জোগাইবে কোথা হইতে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়া তো জমিদারির কাজ চলে না।'


ফল হল এই, তিনি বনোয়ারির ওপর চয়ে গেলেন, ‘অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বিলয়া উঠিলেন, আচ্ছা, আচ্ছা, নীলকণ্ঠ কী করে না-করে সে কথা তোমাকে ভাবিতে হইবেনা। সেইসঙ্গে ইহাও বলিলেন, দেখো দেখি, বংশীর তো কোনো বালাই নাই। সে কেমন পড়াশুনা করিতেছে। ওই ছেলেটা তবু মানুষের মতো। অর্থাৎ মনোহর জ্যেষ্ঠ পুত্রের অভিমৃষ্যকারিতায় অসন্তুষ্ট হয়ে 'অমানুষ' বলেই তিরস্কার করলেন আর কী।


গল্পে মনোহরলালের এইটুকু ভূমিকা। তারপর অতর্কিতে পাই তাঁর মৃত্যুসংবাদ। আগেই বলেছি, মনোহর ফ্ল্যাট-চরিত্র, এরকম জমিদার শ্রেণির টাইপ-চরিত্র বাংলা সাহিত্যে গল্পে উপন্যাসে ভুরিভুরি দেখতে পাওয়া যায়।


গুরুত্বের দিক থেকে বিচার করলে নীলকণ্ঠ চরিত্রটিকে মনোহরলালের আগেই আলোচনায় আনতে হয়। কিন্তু প্রভুভৃত্যের সম্পর্ক মাথা আর পায়ের সম্পর্ক। তাই আগে আনা গেল না।