‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনটির গঠনরীতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

দুই গৰ্ভাঙ্ক বিশিষ্ট মাত্র দুটি অঙ্কে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনটি শেষ হয়েছে। এর প্রথম অঙ্কটিকে ভূমিকা বা প্রস্তুতি বললে দ্বিতীয় অঙ্কটিকে তার পরিণতি বলতে হয়। এ নাটকে ভক্তপ্রসাদকে বারবার বেলা শেষে, সন্ধ্যাবেলায় বা তার কাছাকাছি সময়ের পটভূমিকায় দেখা গেছে। মনে হয় এটি নাট্যকারের সচেতন ইচ্ছের ফলে ঘটেছে। প্রথম অঙ্কের প্রথম গভাঙ্ক শেষ হয়েছে ভক্তপ্রসাদের উক্তিতে, “এখন যাই, সন্ধ্যা আহ্নিকের সময় উপস্থিত হল।” দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে একাধিকবার সন্ধ্যা না হবার জন্য ভক্তপ্রসাদের অধীরতা লক্ষিত হয়েছে। তারপর—“নেপথ্যে শঙ্খ, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, করতাল” ইত্যাদি শব্দ শুনে আনন্দকে তিনি বলেছেন—“এসো বাবু, ঠাকুর দর্শন করিগে।” এই সন্ধ্যার পটভূমিকা ভক্তপ্রসাদের মনে মূল্যবোধ এবং দ্বন্দ্ব সংশয় জাগানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।


আলোচ্য গর্ভাঙ্কের আরও দুটি প্রসঙ্গ হল–আনন্দ-চরিত্রের অবতারণা এবং গদাধর ও রামের ক্ষণকালের বিলাসিতা প্রদর্শন। আনন্দের সঙ্গে ভক্তপ্রসাদের সংলাপের মধ্যে যে কলিকালের প্রসঙ্গটি উঠেছিল, এই প্রসঙ্গে তাও বিবেচ্য। আনন্দের সঙ্গে কথাবার্তায় গ্রাম ও শহর কলকাতার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিরুদ্ধতা ধরা পড়েছে। ভক্তপ্রসাদ উজ্জ্বলতর হয়েছেন। আনন্দ-অম্বিকারা যেন গ্রামের হানিফ ফতেমা-বাচস্পতিদের সঙ্গে নৈতিকভাবে মিলিত হয়ে কলিদেবের কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করেছে। গদাধর ও রাম ভক্তপ্রসাদের প্রতি যে তির্যক মন্তব্য করেছে, তাতে বাইরে প্রতিহত ও অপমানিত হবার পূর্বেই, নিজ গৃহেই, ভক্তপ্রসাদের অবমাননা প্রদর্শিত হয়েছে। গদাধর ভক্তপ্রসাদের দুষ্কর্মের সহযোগী বটে, কিন্তু তার বিভিন্ন মন্তব্য এবং পরিণতি তাকে অনেক ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র করে তুলেছে।


নাটকের শেষ দৃশ্যে মূলতত্ত্ব প্রকাশিত। যে হানিফ ভূতের বেশে আবির্ভূত হবে, তার ক্রোধকে অত্যন্ত স্থূলভঙ্গিতে গর্ভাঙ্কের প্রথমেই তুলে ধরা হয়েছে। হানিফকে প্রথম গর্ভাঙ্কে যতটা Submissive দেখা গিয়েছিল, নাটকের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই তার বিপরীত রূপ ধরা পড়েছে। বাচম্পতি সে তুলনায় অনেক স্থিতধী ও পরিকল্পনাশীল। গর্ভাঙ্কের শুরুতেই তাঁর মন্তব্য ; ‘না জানি, আজ একটা কি বিভ্রাটই বা ঘটায়। পুঁটি ও ফতেমার মন্তব্যেও একটা অঘটন ঘটার ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ ঘটনা পরিণতি সম্পর্কে নাট্যকার পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হচ্ছেন।


যাইহোক, আলোচ্য প্রহসনটির ঘটনাক্রমে বিস্তারিতভাবে আলোচনার পর এর গঠন রীতিতে সে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় তা এমনভাবে নিরূপণ করা যেতে পারে—


১। 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নামকরণ অপেক্ষা মধুসূদন প্রদত্ত ভগ্ন শিবমন্দির অধিকতর ব্যঞ্জনায় প্রতীকময়তাও অভিষিক্ত। 


২। ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামের মধ্যে 'ভগ্ন' বিশেষণটি নানা নৈতিক ও সামাজিক অপবাদ, দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতির সূচক।


৩। হানিফ-যম ও ভূতের সমন্বয়ী রূপ। ভক্তপ্রসাদ দেবতার কাছে প্রসাদপ্রার্থী ভক্ত। এই জন্যেই হানিফ রূপী শিব বা ধর্মরাজের কাছে ভক্তপ্রসাদের অষ্টাঙ্গে প্রণাম এবং ক্ষমা প্রার্থনা। 


৪। বাচস্পতির ব্রাহ্মণত্ব, তাঁর মাতৃদায়, ব্রহ্মত্র জমি, এবং বাচস্পতি পদের অর্থ উল্লিখিত ভাবানুষঙ্গেরই পরিপোষক।


৫। ভারতচন্দ্রের কাব্যের অনুষঙ্গ গ্রহণ। কলিকালের প্রসঙ্গ, বিভিন্ন চরিত্রের অর্থবহ নামকরণ, সর্বক্ষেত্রেই ভক্তপ্রসাদকে সন্ধ্যার পটভূমিকায় স্থাপন করা, প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলা চলে— Structural Analysis এর সঙ্গে Explicative Criticism ঘনিষ্ঠরূপে জড়িয়ে পড়েছে।


সর্বোপরি, এই প্রহসনে সময় বিশেষে যে ‘সংকট সমাহার’ সৃষ্টি করা হয়েছে তা স্বতঃপ্রণোদিত। যা নাটকের গঠনতত্ত্বের বিচারে অত্যন্ত সার্থক ও উপযোগী হয়ে উঠেছে। তাই সব মিলিয়ে বলতে হয়, মধুসূদন কেবলমাত্র দুখানি প্রহসন রচনায় আত্মনিয়োগ করলেও নিখুঁত পর্যালোচনা ও লেখনীর গুণে দুটোই যে সার্থকতার মহিমায় উজ্জ্বল সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।