চিত্র ও সংগীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ। অরূপকে রূপের দ্বারা ব্যক্ত করিতে গেলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করতে হয়।

পরিদৃশ্যমান জগৎ আমাদের সামনে প্রসারিত হচ্ছে। এখানে ভালো মন্দ, মুখ্য ও গৌণ অঙ্গাঙ্গিভাবে বিরাজমান। প্রকৃতির অপক্ষপাত প্ৰাচুৰ্য্য এ জগতে প্রত্যক্ষগোচর। কিন্তু সেই জগৎ যখন আমাদের মনে প্রবেশ করে, তখন তা রূপান্তরিত হয়, আমাদের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র ভাবের স্পর্শে যা স্থূল বাস্তব তা মানসিক হয়ে ওঠে। আমাদের প্রীতি ও বিদ্বেষ, ভীতি ও বিস্ময়, সুখ ও দুঃখের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র রসে বাইরের জগৎ এক নতুন রূপ ধারণ করে। স্বভাবত আমরা জগৎকে আমাদের চেতনার স্পর্শে মানসিক ও মানবিক করে নিই।


যাঁদের হৃদয়বৃত্তির জারকরস পর্যাপ্ত নেই, তাঁরা জগৎকে বস্তুসীমার বাইরে উপলব্ধি করতে পারে না। তাঁদের চেতনার রঙে জগৎরূপ অহল্যার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয় না। জড় প্রকৃতির এমন দুই একজন লোক আছেন, যাঁদের হৃদয়ের ঔৎসুক্য খুবই সীমিত। তাঁরা এই জগতে বাস করেও প্রবাসী, হৃদয়ের সংকীর্ণ জানালা দিয়ে তাঁরা বিশ্বকে দেখতে পান না, পক্ষান্তরে সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ, সৌভাগ্যবান ব্যক্তি অনেক থাকেন, যাঁদের কাছে প্রকৃতির জগৎ থেকে আমন্ত্রণ আসে। এই পৃথিবীতে ‘যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি" তা তাঁদের হৃদয় বীণায় সাড়া জাগায়। প্রকৃতির অন্তরের বেদনা প্রকাশের চাঞ্চল্য তাঁদের বাঁশিতে কম্পিত মূর্ছনা সৃষ্টি করে। অতএব ভাবুকের কাছে বাইরের জটিল ও পারম্পর্যের বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকেও হৃদয়ের অধিগত মানসিক জগতের আকর্ষণ অনেক বেশি। সংবেদনশীল মানব মন যতখানি বাইরের জগতকে আত্মসাৎ করে নিতে পারেন, তা ঠিক ততখানি সত্য ও সার্থক হয়ে ওঠে।


সাহিত্য রচনার সময় দুটি বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে, একটি হল সাহিত্য স্রষ্টা তাঁর হৃদয় দ্বারা জগৎকে কতখানি গ্রহণ করতে পেরেছেন, অপরটি হল, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে স্থায়ী রূপ দিতে পেরেছেন কিনা। কবির কল্পনা যত সার্বভৌম হবে ততই তাঁর রচনার গভীরতা আমাদের আনন্দ দান করবে। তাঁর কাব্যে বিশ্বের সীমা বিস্তৃতি লাভ করে আমাদের মনকে সেখানে স্বচ্ছন্দ বিহারের সুযোগ দান করবে। রচনার নৈপুণ্যও সাহিত্যে মর্যাদা লাভ করে। এই নৈপুণ্যের ফলে কবিমনের অনুভূতি বাইরে স্থায়ী রূপ গ্রহণ করে। বাইরের জগৎ কবিমনে আর একটি নতুন জগতে রূপান্তরিত হয়। তাকে এমনভাবে প্রকাশ করতে হয়, যাতে সে অন্যের হৃদয়ে অনায়াসে সঞ্চারিত হতে পারে। এই হৃদয়ের ভাব অন্যের মনে উদ্রিক করার জন্য কলাকৌশলের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। পুরুষের বেশভূষা সাধারণ ও যথাযথ হলেই চলে, কিন্তু নারীর সাজসজ্জায় সুষমা ও পরিপাট্য অপরিহার্য। তাদের আচরণে আভাস ইঙ্গিত থাকা চাই।


সাহিত্যও সেইরকম নিজেকে সুন্দর রূপে ব্যক্ত করার জন্য অলংকার, ভাষা ও ছন্দের আশ্রয় নেয়। সাহিত্যকেও শুধু ব্যক্ত করলে চলে না, রূপের মধ্যে রূপাতীতকে, বক্তব্যের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে প্রকাশ করতে হবে। যা রূপাতীত, অসীম ও অনির্বচনীয় তাকে নিরলংকৃত দর্শন বিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, কাব্যার্থের অতীত অর্থকে প্রকাশ করতে চায় বলে সাহিত্যের ভাষা ইঙ্গিত বহু বা প্রতীকধর্মী। এই যে গভীর অর্থ, যা হৃদয়াবেদ্য, তাকে আলংকারিকরা ধ্বনি বলেছেন, নারীদেহের অলংকারকে আশ্রয় করে যেমন শ্রী ফুটে ওঠে, তেমনি ছন্দ ও অলংকারকে আশ্রয় করে সাহত্যের অনির্বচনীয় মাধুর্য ফুটে ওঠে, ছন্দও অলংকার-এর উপায় মাত্র। সাহিত্যের যা অনির্বচনীয়তা তা ছন্দে ও অলংকারে আবৃত হয় না।


ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রকাশ করার জন্য সাহিত্য, চিত্র ও সংগীত—এই দুই উপকরণকে গ্রহণ করে থাকে, ভাষায় যে ভাব প্রকাশ করা যায় না, তা চিত্রে সহজে করা যায়। সাহিত্যের ভাবকে উপমা রূপকের সাহায্যে গঠিত চিত্ররীতির মাধুর্যে প্রত্যক্ষ গোচর করা যায়। বৈষ্ণুব কবি বলরাম দাস লিখেছেন—'দেখিবারে আঁখিপাখী ধায়, এর মাধ্যমে বিত্তের ব্যাকুলতা আশ্চর্য রূপ লাভ করেছেন। অর্থাৎ সংগীতের মাধ্যমে কাব্যের গভীর ভাব ও রচনাতীত মাধুর্যকে প্রকাশ করা যায়। সংগীতের সুরের দ্বারা ভাব ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করা যায়। চিত্রভাবকে চিত্রকাব্যে দেহ ও সংগীত তার আত্মা, বস্তুত বাইরের প্রকৃতি ও মানব চরিত্র মানুষের মনে সর্বদা যে রূপ ধারণ করেছে, যে সুর সৃষ্টি করেছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্র ও গানই সাহিত্য।


বহিপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য।


ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সাহিত্য প্রধানত ভাষার মধ্যে দুইটি জিনিস মিশাইয়া থাকে চিত্র ও সংগীত।