বাংলা কাব্যসাহিত্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ খ্ৰীঃ-১৯৬০ খ্রীঃ)

বাংলা কাব্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত


বিত্ত ও বিদ্যার কৌলীন্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ব্যক্তিত্বের বিবিধ গুণপনায় তিনি ভূষিত। সাহিত্যচর্চা থেকে এটর্নীগিরি, আইনপাঠ থেকে ফরাসী ও জার্মান ভাষা চর্চা, পত্রিকা সম্পাদনা থেকে এ. আর. পি-র অফিসার অথবা ডি. ভি. সি.-র প্রচারসচিব হওয়া, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণ। অথচ শুধুমাত্র কাব্যচর্চা ও সাহিত্যসাধনা ছাড়া আর সবেতেই হয়েছিলেন বীতঃস্পৃহ। পিতা অদ্বৈতবাদী পণ্ডিত, অভিজাত পুরুষ, রবীন্দ্র-সুহৃৎ হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মা ইন্দুমতী। এঁদের সুযোগ্য পুত্র সুধীন্দ্রনাথ পিতার পাণ্ডিত্য পেয়েছিলেন কিন্তু অদ্বৈতবাদে আস্থা হারিয়েছিলেন।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ও কর্মজীবন:

১৯০১ খ্রীস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ এ্যাটর্নি, জাতীয়তাবাদী, থিয়সফিস্ট, রবীন্দ্র-সুহৃৎ এবং বৈদান্তিক পণ্ডিত। মা ইন্দুমতী দেবী ছিলেন কলকাতার পটলডাঙ্গার প্রসিদ্ধ বসুমল্লিক বংশের প্রবোধচন্দ্র বসুমল্লিকের একমাত্র কন্যা এবং স্বনামখ্যাত রাজা সুবোধচন্দ্র বসুমল্লিকের ভগ্নী। আট ভাইবোনের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন জ্যেষ্ঠ সন্তান।


গৃহে তাঁর শিক্ষার সূচনা হয়। স্কুল শিক্ষা শুরু হয় ১৯১৪ সালে কাশীতে অ্যানি বেসান্ট স্থাপিত থিয়সফিক্যাল স্কুলে। সেখানে ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত পড়েন। ১৯১৭-তে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯১৮-তে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস-এ ভর্তি হন। এই সময় তাঁর খুড়তুতো ভাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'নাট্যপ্রতিভা' পত্রিকায় বেনামে একটি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়।


সুধীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন : "it was in his imitative magazine that my poor verses appeared for the first time" ("The World of Twilight, p. 37 )। ১৯২২ সালে ডিস্টিংশন-সমেত বি.এ. পাশ করেন। ১৯২২-২৩-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নিয়ে এম. এ.-তে ভর্তি হন এবং একই সঙ্গে ল পড়া ও বাবার কাছে এ্যাটর্নিশিপের শিক্ষানবিশী শুরু করেন। তবে ল, এ্যাটর্নিশিপের পরীক্ষাতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনের ব্যাপারে সুধীন্দ্রনাথের কোন উৎসাহ ছিল না। পক্ষান্তরে, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শিক্ষায়, জ্ঞানার্জনে, দেশ-বিদেশের সাহিত্যপাঠে ও কবিতা রচনায় ‘গভীরতম চর্চায় আত্মনিয়োগ’ করেন।


সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। ক্ষুরধার বুদ্ধি, পাণ্ডিত্য, বংশকৌলীন্যের অধিকারী। তাঁর কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র্যময়। সেই প্রসঙ্গ সংক্ষেপে উল্লেখ করা যায়; যেমন—১৯২২-১৯২৭ সালে সলিসিটর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশি, ১৯২৮-২৯ সালে ‘ফরওয়ার্ড’ দৈনিকপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের অবৈতনিক কর্মী এবং এই সময়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেস সম্মেলনের প্রচার বিভাগের একজন কর্মী হিসাবে দায়িত্বপালন, ১৯২৫ পর্যন্ত 'সবুজপত্র' (নবপর্যায়) পত্রিকার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা, ১৯৩০-১৯৩৩ সাল পর্যন্ত লাইট অব এশিয়া ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে কাজ করা, ১৯৪২-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এ. আর. পি.-র প্রধান কর্মাধক্ষ্য রূপে দায়িত্বপালন, ১৯৪৫ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে ‘মার্কসিয়ান ওয়ে' এবং পরে ‘হিউম্যানিস্ট ওয়ে’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ।


১৯৪৫-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সহসম্পাদক রূপে কাজ করা, তারপরে এই কাজ ছেড়ে ১৯৪৯ সালে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের গণসংযোগ অফিসার রূপে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত থাকা, এর মধ্যেই ১৯৫২ সালে দ্বিতীয়বার বিদেশ যাওয়া, ১৯৫৪-১৯৫৬-তে ইন্‌ষ্টিট্যুট অব পাব্লিক ওপিনিয়ন-এর কলকাতা শাখার পরিচালক রূপে কাজ করা, তৃতীয়বার ইউরোপ ভ্রমণ, ১৯৫৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক রূপে যোগদান এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠান করেন। এর মধ্যেই ১৯৫৭ সালে ‘ফুলব্রাইট’ বৃত্তি নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে গবেষণার জন্য সস্ত্রীক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৫৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত বন্ধু এডওয়ার্ড শিল্স্-এর আগ্রহে ও ব্যবস্থাপনায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি রূপে অবস্থান করেন। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৬০ সালের ২৫ জুন তাঁর আকস্মিক জীবনাবসান হয়।


সামান্য একটি ‘কুক্কুট'কে নিয়ে কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, কিন্তু কাব্যের প্রয়োজনে রবীন্দ্র-জগৎকে ‘পরীর দেশ’ ব’লে প্রত্যাখ্যানে দ্বিধান্বিত হননি। আসলে “সুধীন্দ্রনাথের তনু-তন্ময়তার সঙ্গে মিলেছে তাঁর আভিজাতিক সুমিতি, তাঁর ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়লোক দুর্লভ মননশীলতায় গম্ভীর” (বুদ্ধদেব বসু, ‘কালের পুতুল’, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৭৩)।


বস্তুত আধুনিক পৃথিবীর সমস্যা ও জীবনসত্য-সন্ধান, দর্শন ও বিজ্ঞানের নানামুখী বিস্তার, মনোবিজ্ঞানের আবিষ্কার, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের যথোচিত প্রয়োজনীয়তা—পশ্চিমী চিন্তা-পদ্ধতির সব রকম প্রবণতাকে আত্মস্থ করে কবিতা লেখার গুরু দায়িত্বে হয়েছিলেন নিষ্ঠাবান। এই নিষ্ঠাই তাঁকে ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি নিজেও সবিনয়ে সতর্ক করেছিলেন কবিতা পাঠককে এই বলে“যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃৎকম্পন অনুভব করতে চায় তাদের কবিতা না পড়াই উচিত। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খণ্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে। ভাব শুধু মেঘ বাঁশী প্রিয়া বিরহ মিলন ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়ে কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন-বিজ্ঞানের দিকেও আস্তে আস্তে প্রসারিত হচ্ছে। আজকের এই বিশেষজ্ঞানের’ দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে সেই নির্দিষ্ট অনুশীলন ভিক্ষা করি যেটা সাধারণতঃ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি” (দেশ, সাহিত্যসংখ্যা, ১৩৭৯, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৬)।


এই ‘নির্দিষ্ট অনুশীলনে’ কবি নিজেও ছিলেন অভ্যস্ত, এলিয়ট-মালার্মে ভ্যালেরি প্রমুখ কবিদের কাব্য-নির্মাণকলার অনুভবী পাঠক। সেই অনুভব ও অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন ঃ “কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে; এবং কবি যদি মহাকালের প্রসাদ চায়, তবে শুচিবায়ু তার অবশ্য বর্জনীয়, তবে ভুক্তাবশিষ্টের সন্ধানে ভিক্ষাপাত্র হাতে নগর পরিক্রমা ভিন্ন আর গত্যন্তর নেই। কারণ কাব্যের পথ উল্লঙ্ঘনে চলে না; সেখানকার প্রত্যেকটি খাত পদব্রজে তরণীয়, প্রত্যেকটি ধূলিকণা শিরোধার্য, প্রত্যেকটি কণ্টক রক্তপিপাসু; সেখানে পলায়নের উপায় নেই, বিরতির পরিণাম মৃত্যু, বিমুখ মাত্রেই অনুগামীর চরণাহত” (“কাব্যের মুক্তি’, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৪৮, 'স্বগত', পৃষ্ঠা ২১)। আর এইভাবেই কবিতা রচনায় তিনি চেয়েছিলেন “স্বকীয় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, অতীত ও বর্তমানের সমুদ্র মন্থন করে উপযুক্ত উপায়ে সুসঙ্গত অবৈকল্য নির্মাণ” (পূর্বোক্ত)।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের রচনাসমূহ:

কাব্যগ্রন্থ : প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'কুক্কুট' (প্রবাসীতে প্রকাশিত, ১৯২৮), ‘তন্ত্রী’ (১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), 'ক্রন্দসী' (১৯৩৭), 'উত্তরফাল্গুনী' (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩), ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৫৪), 'দশমী' (১৯৫৬), এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ (১৯৬২)।


গদ্য প্রবন্ধ : ‘স্বগত' (১৯৩৮), 'কুলায় ও কালপুরুষ' (১৯৫৭), অমিয় দেব সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ, ‘আত্মজীবনীর খসড়া”।


আত্মজীবনীমূলক ইংরেজী রচনা : The World of Twilight' (1970).


পত্রিকা সম্পাদনা : 'পরিচয়' (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ, শ্রাবণ–১৩৫০ বঙ্গাব্দ, আষাঢ়), এছাড়া, ‘ফরওয়ার্ড’, ‘স্টেটসম্যান’, ‘মার্কসিয়ান ওয়ে’, ‘কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি বিভিন্ন পত্রিকার লেখক ছিলেন।


কবির চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্ত্রী’। এখানে আছে প্রথম প্রকাশিত ‘কুক্কুট’ সহ ঊনত্রিশটি কবিতা। প্রথম কবিতাটির জন্ম-ইতিহাস বিচিত্র কৌতুকময় ঃ জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়ি যাতায়াতকালে একদিন কবিতায় বিষয়গৌরবের মূল্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের বিতর্ক বাধে। রবীন্দ্রনাথ মোরগের উপর একটি কবিতা লিখতে বলেন। কয়েকদিন পর সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখে নিয়ে আসেন। কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘না, তুমি জিতেছ’—। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে কবিতাটি ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়। কিন্তু 'ভারতবর্ষ’, ‘শনিবারের চিঠি’ তা প্রত্যাখ্যান করে। এই কবিতায় পত্রিকা-পরিচালকদের প্রতি ব্যঙ্গ আছে ভেবে ‘শনিবারের চিঠি’ এর একটি প্যারডিও প্রকাশ করে “জৈবার্তৃক গর্ভলীন ক্ষপার্ধ উদ্‌গাঢ় অন্ধকার” ইত্যাদি। শোনা যায়, এই ব্যঙ্গাত্মক ঘটনার আঘাতেই ‘পরিচয়' পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল (দ্রষ্টব্য : হীরেন্দ্রনাথ দত্ত: ‘দত্ত পরিবার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘পরিচয়’-এর প্রকাশ’, নিরঞ্জন হালদার সম্পাদিত 'সুধীন্দ্রনাথ’ ১৯৭৫)।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য আলোচনা:

‘তুম্বী' কাব্যে প্রথম যৌবনের আবেগ প্রবণতা ও রূপানুরাগ অভিব্যক্ত। এখানে ‘শ্রাবণবন্যা’, ‘বর্ষার দিনে' প্রভৃতি কবিতায় আছে সম্ভোগময় প্রেমের অনুভূতি, বেদনাবিদ্ধ স্মৃতিচারণ, রহস্যময়ী প্রেমিকার প্রতি আকর্ষণ। এই কাব্যে রবীন্দ্র প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে নেই, কিন্তু অনুরূপ ভাবনা আছে; যেমন রবীন্দ্রনাথের মতোই মৃত্যুর পর লীলাসঙ্গিনীর সঙ্গে চিরমিলনের প্রত্যাশা দেখা গেছে : “তোমার প্রমোদকুঞ্জ রচিত কি বৈতরণী তীরে, হে মোর ক্রন্দসী?” এই প্রাথমিক রচনায় শব্দ নির্মাণের কুশলতাও তেমনভাবে চোখে পড়ে না। কারণ সুধীন্দ্রনাথের যুক্তাক্ষর বহুল তৎসম শব্দের গাঢ় গাম্ভীর্য ও উদ্ধত মহিমা তখনও পর্যন্ত কবিতায় অনুপস্থিত।


পরবর্তী ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্য থেকেই সুধীন্দ্রনাথের স্বকীয়তার প্রকাশ। এই কাব্যে আছে মোট বাইশটি কবিতা। প্রেক্ষাগারের বর্ণনামূলক কবিতা, সাতটি সঙ্গীতের বর্ণনামূলক কবিতা, আর সাতটি সঙ্গীতধ্বনি নায়কের মনে যে স্মৃতি বা অনুষঙ্গ জাগিয়ে তুলেছে তার কথা। কবি দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় বলেছেনঃ এর “সাতকাণ্ড যেমন গতিমূলক পরকাষ্ঠার সোপান পরম্পরা, তেমনি প্রত্যেক পর্ব আবার ত্রিবিধ উপলব্ধির তাৎকালিক সমন্বয়। অর্থাৎ প্রতি ভাগে ঘুরে ঘুরে এসেছে রঙ্গালয়ের আভ্যন্তরীণ দৃশ্য, শ্রাব্য ঐকতানের অতিশ্রুতি ব্যঞ্জনা আর শ্রোতৃবিশেষের সমবায়ী ভাবানুষঙ্গ....”। প্রেক্ষাগারের বর্ণনামূলক কবিতাগুলির পর পর তরঙ্গগুলি সাজালে প্রেক্ষাগারের অভ্যন্তর দৃশ্যটি অনুভব করা যায়। প্রবহমান অমিল পয়ারে এই অংশগুলি লেখা। দ্বিতীয় তরঙ্গগুলি সাজালে পাওয়া যাবে নাট্যশালার বাদ্যসমবায়ে বেজে উঠছে যে সঙ্গীতের ‘থীম’, সেই পরিবর্তমান দিন রাত্রির প্রকাশ : “বিদায় মাগে মলিন শুকতারা”, সেই ভোর থেকে “আলোর সোনালী সুরা অঝোরে ঝরে” দ্বিপ্রহর, তারপরে আছে “চন্দ্রের কৌস্তুভ, উরসে প্রকৃতির মুগ্ধ নিদ্রায় স্তব্ধ” রাত্রি। তৃতীয় তরঙ্গের কবিতাগুলিতে আছে পূর্ব প্রণয়ের আনন্দযন্ত্রণায় মেশানো স্মৃতিচিত্র। এই স্মৃতি এক বিদেশিনীর যার “পাকা দ্রাক্ষার মদির কান্তি অঙ্গে” আছে কবি-নায়কের মুগ্ধ দৃষ্টি। তাই সব শেষে

“মায়ামৃগী, তুমি বন্দিনী আজ আমার গেহে,

আমার অমরা-আশ্রিত তব মানুষী স্নেহে।

স্খলিত বসন উরুতে তোমার

অনাদি নিশার শাস্তি উদার;

নব দুর্বার চিকন পুলক ও বরদেহে।

বিশ্বের প্রাণ বিকচ আজিকে আমার গেহে।”


রবীন্দ্র-কাব্যের ভিন্নতর প্রয়োগ : অর্কেস্ট্রা' কাব্যে রবীন্দ্রনাথের একাধিক পঙ্ক্তি জ্ঞানে-অজ্ঞানে ব্যবহৃত, কিন্তু মৌলিকতায় দীপ্ত। এইসব পক্তির সুবিন্যাসে কবির উদ্দেশ্য "an attempt to imitate through the media of various verseforms symphonic music as produced by many instruments" (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সঙ্কলিত কবিতার রেকর্ডে ধৃত কবিকৃত ইংরেজী ব্যাখ্যা, উদ্ধৃত প্রবন্ধ : “সুধীন্দ্রনাথের কবিতা : তার গঠন শিল্প’, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা বিচার ও বিশ্লেষণ’, জীবেন্দ্র সিংহ রায় সম্পাদিত ১৯৮৯, পৃষ্ঠা, ১৯১)। যেমন ছন্দোমিল দেখা যাবে এই অংশে

রবীন্দ্রনাথ : “যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে 

সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া....।”

সুধীন্দ্রনাথ : “সন্ধ্যার রাগ ছিন্ন মেঘের অন্তরে

অঙ্গারমসি প্রেমলোকে করে পুণ্য....।”


‘ক্রন্দসী’ কাব্যের অনেক কবিতা ‘অর্কেষ্ট্রা’র সমকালে (অর্থাৎ ১৯৩১–১৯৩৫ খ্রীঃ) লেখা। কিন্তু পার্থক্যে দুই কাব্য প্রায় বিপরীত। 'অর্কেস্ট্রা’য় আছে ক্ষণস্থায়ী প্রেমের চিরস্থায়ী আর্তি; ‘ক্রন্দসীতে আছে রূঢ়-নিষ্ঠুর, হিংস্র উন্মত্ত জগতের প্রতি কবির দৃষ্টিপাত। এখানে দেখা গেছে কখনো অসহিষ্ণু প্রতিবাদ, কখনো মর্মান্তিক হতাশা, কখনো বা নিষ্ফল স্বপ্ন। এই কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ‘সন্ধান’, ‘প্রত্যাখ্যান’, ‘কাল’, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘প্রশ্ন’, ‘নরক’, ‘ভাগ্যগণনা’, ‘মৃত্যু’, ‘প্রার্থনা’ প্রভৃতি কবিতাগুলির মধ্যে ভাবের বৈচিত্র্য দেখা গেছে; যেমন শক্তির জন্য প্রার্থনা

“হানো তীক্ষ্ণ সর্বনাশা, তীব্র ক্ষতি, বৈরিতা নির্মম,

জুগপ্সার শক্তি দাও, দাও মোরে নিৰ্গুণ নির্বাণ”।


আবার নেতিবাদী নৈরাশ্যময় একাকীত্ব

“জীবনের সার কথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া

নির্বিকারে নির্বিবাদে সওয়া 

শবের সংসর্গ আর শিবার সভাব।

মানসীর দিব্য আবির্ভাব

সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে, জাগরণে আমরা নিত্য একাকী”

এই কাব্যের কবিতাগুলিতে শব্দ-সচেতনতা এবং ধ্বনি সাম্যময় বাক্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনির্বেদ, উন্মথ, বিনির্মোক, বমনবিধুর, দুহৃদ প্রভৃতি গুরু-গম্ভীর বিশেষণ প্রয়োগের প্রচেষ্টা দেখে গেছে।


‘উত্তরফাল্গুনী' কাব্যটি প্রধানত প্রেমমূলক। এই প্রেমভাবনার মধ্যে রোমান্টিক স্বপ্নচারিতা এবং আদর্শময় দৃষ্টি নিয়ে অমরার অমৃতসন্ধানের প্রয়াস সুস্পষ্ট। এই প্রেম যৌবনগত কবি-চিত্তের আর্তি। এখানে আছে যেমন অতীত মিলনের রসোল্লাস, তেমনি ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের আশঙ্কা। তাই কোমল চিত্তের করুণ ব্যাকুলতা, কম্পিত প্রত্যাশা ও সরোদন মিনতিতে পূর্ণ এর অনেক কবিতা। এই কাব্যের ‘মরণ-তরণী’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘দুঃসময়’, ‘জন্মান্তর’, ‘বিলয়’, ‘মহানিশা’ প্রভৃতি কবিতা মৃত্যুভাবনায় ধূসর। যেমন ‘দ্বন্দ্ব’ কবিতায় দেখা যায়

“আজিকে দেহের পালা, রিক্ত সেজে শুয়ে তাই ভাবি

হয়তো বা তারই কাছে পড়ে আছে অমরার চাবি।”


এখানে “দেহ-মনের দ্বন্দ্বে দেহ বা ইন্দ্রিয়জ সুখের কাছে মনের মৃত্যু-ভীতির চিন্তাও হার মেনেছে। কবি পাশ্চাত্যের অ্যারিস্টিপ পাশ, লুক্রেসিয়াশ প্রভৃতি Hedonist-দের মতো আমাদের দেশের সুখবাদী চার্বাকের সুরে এখানে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন”

এই কাব্যের কবিতাগুলির ভাষা স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, ছন্দবন্ধনও নির্দিষ্ট। শব্দ ও বাক্যপ্রয়োগ রীতির মধ্যে আছে সংস্কৃত ও বৈষ্ণব কবিতায় ব্যবহৃত দেহবর্ণনার অলঙ্কৃত চিত্র। জীবন-মৃত্যুর তরঙ্গে দোলায়িত প্রেমভাবনায় আছে রবীন্দ্র কবিতার চিত্রকল্প। আছে সুধীন্দ্রিয় ভাষারীতির ধ্রুপদী কারুকার্য; যেমন “উলবন রভসে নামে অনস্তের উন্মুদ্র অতলে’’ (‘লঘিমা’), “স্মৃতির মিশর বীজ মন্বন্তরে যথারীতি ম’জে’’ (‘শবরী’), “প্রাগূযার পাণ্ডুমুখে অনর্থের অপপাঠ লিখে” (‘প্রতিপদ’) ইত্যাদি পঙ্ক্তি।


‘সংবর্ত’ কাব্যটি ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৩-র মধ্যে লেখা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। কবির ভাষায় “অথচ উক্ত যুদ্ধ যে ব্যাপক মাৎসন্যায়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, তার সঙ্গে পরবর্তী কবিতাসমূহের সম্পর্ক অকাট্য” (মুখবন্ধ’)। সুন্দরের প্রশস্তি রচনায় প্রস্তুত কবি। কিন্তু বিদেশী শত্রুর আক্রমণে মানবজাতির আকুল আর্তনাদে বিচলিত ক্ষুব্ধ কবি ভগবানের অদৃশ্য নীরবতা দেখে প্রশ্ন করেছেন

‘‘অদৃশ্য অম্বরে তবুও অদৃশ্য তুমি? 

নিরঙ্কুশ নিঃসন্তান নিত্য মরুভূমি আস্তিক্যের পুরস্কার-

প্রতিশ্রুত ভূস্বর্গ তবেবিহ” (‘উজ্জীবন’)।


পৃথিবীতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্বার্থপরতা সুবিধাবাদ বিজিগীষা ও মত্ত ক্ষমতা দস্ত প্রবলরূপে প্রকাশিত“রুশের রহস্যে লুপ্ত লেনিনের মমি, হাতুড়ি নিষ্পিষ্ট ট্রটস্কি, হিটলারের সুহৃদ স্টালিন, মৃত স্পেন, ম্রিয়মান চীন, কবন্ধ ফরাসীদেশ”। এই বিপর্যস্ত বিশ্বশক্তির যুদ্ধের নামে অবিবেকী আচরণের ফলে “কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে, মেদিনীমুখর একনায়কের স্তবে” (১৯৪৫)। এ্যাটম বোমার ধ্বংসলীলায় আতঙ্কিত কবি দেখেন : “অণুবিদারণে শত সহস্র মানুষ হত, ব্যক্ত অভিব্যক্তিবাদের ফাকি” (‘প্রত্যাবর্তন’)।


এই কাব্যের ভাষায় শব্দ নির্মাণকলার বিস্ময়কর পরীক্ষা-রীতি দেখা যায়। কাব্যের ভূমিকা অংশে কবি বলেছিলেন“আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ, এবং উপস্থিত রচনাসমূহ শব্দপ্রয়োগের পরীক্ষা রূপেই বিবেচ্য।” এখানে বাক্যে আছে যুক্তাক্ষর বিশিষ্ট শব্দের ধ্বনিসাম্য “প্রনষ্ট পৃথ্বীর প্রাস্তে তমিস্রার লজ্জাবস্ত্রে আজ।” দুরূহ শব্দ বিলাস কোথাও কোথাও দেখা যায় : “মাতরিশ্বা পরিত্ব কবির কণ্ঠশ্বাস” (‘সংবর্ত')।


১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬-র মধ্যে লেখা হয় ‘দশমী' কাব্যের দশটি কবিতা। কবি জীবনের উপাত্ত্য পর্বে পৌঁছে বিগত মদমত্ত যৌবনের কথা ভাবেননি, পরিবর্তে জীবনের কোমল অনুভূতি-সজল মুহূর্তগুলি মনে করেছেন, প্রকৃতির সুধা পান করতে চেয়েছেন অথবা অনুভব করেছেন : “বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী” (‘প্রতীক্ষা')। পরবর্তী ‘নৌকাডুবি’ কবিতায় আছে এক উজ্জ্বল প্রাকৃতিক দৃশ্য : “খালি গোলাঘরে সারা ভাঙা হাট শুরু, পায়ে চলা পথে কে একাকী”। নৌকাডুবির প্রতীকে কবির বক্তব্য, জীবন মরণে পূর্ণ এবং মৃত্যুর সামনে না আসা পর্যন্ত ব্যক্তি আপনার স্বরূপ চিনতে পারে না। পরবর্তী ‘উপস্থাপনা’ কবিতায় কবির স্বীকারোক্তি

“আমি ক্ষণবাদী : অর্থাৎ আমার মতে হয়ে যায়।

নিমেষে তামাদী আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ, তথা

তাতে যার জের, সে সংসারও।”

‘নষ্টনীড়’ কবিতায় দেখা যায় একটি পাখি নীড় খুঁজছে, কিন্তু কৃষ্ণচূড়া নিষেধে মাথা নাড়ছে—এই প্রতীকে কবিতার ভাবগত ব্যাখ্যা। অবনীভূষণ চট্টোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : "The Krishnachura with its flowers of violet red and staring yellow is a symbol of physical life, while the parrot is the wounding self,"


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যের গঠন-বৈশিষ্ট্য:

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যের গঠনরীতি ধ্রুপদী। তার বিভিন্ন কাব্যের বিষণ্ণ-বিধুর যন্ত্রণাময় প্রেমের কবিতাগুলি তীব্র নাটকীয়তায় মণ্ডিত। সেইসঙ্গে আছে সিম্ফনিক সঙ্গীতের প্রতি তুলনা, কবির ভাষায় 'various verseforms'। তাছাড়াও আছে ছন্দোগত বৈচিত্র্য। শঙ্খ ঘোষ ‘ছন্দের বারান্দা’ গ্রন্থে একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, সুধীন্দ্রনাথের মৌলিক কবিতার সংখ্যা ১৩০। তার মধ্যে ৯০টি অক্ষরবৃত্তে, ৩০টি মাত্রাবৃত্তে এবং ১০টি স্বরবৃত্তে রচনা। গদ্যছন্দে কবিতা লেখায় তিনি ছিলেন নিরুৎসাহী। কবিতার স্তবকগুলি ন্যায়-পরম্পরায় ধাপে ধাপে বিন্যস্ত; বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় “কথাকে তিনি ব্যবহার করেন, যেমন করে বাস্তুশিল্পী ব্যবহার করে ‘ইষ্টক’’ (‘কালের পুতুল’, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ৬৯)। শব্দ সাধনায় তিনি ছিলেন মালার্মে-পন্থী। 'সংবর্ত' কাব্যের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, তার কবিতা যেন শব্দ ব্যবহারের পরীক্ষারূপে বিবেচনা করা হয়। তার নিজের কথাঃ “মূল্যহীন সোনা হয় তব স্পর্শে, হে শব্দ-অপ্সরী।” তাঁর কবিতার নিত্যনব শব্দসজ্জার অভিনবত্ব সেটাই প্রমাণ করে।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যে পুরাণ-প্রয়োগ:

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মানবজীবনের হতাশা ও আর্তনাদ, নৈরাশ্যময় বেদনার প্রকাশ। অনেক সময় তিনি কাব্যিক মুক্তির জন্য পুরাণের শরণ নিয়েছেন। এখানে পৌরাণিক চরিত্র বা শব্দসমূহ তার স্ববৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা ও বক্তব্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে; যেমন ‘বৈদেহী’, ‘ফাল্গুনী’, ‘ত্রিশঙ্কু’, ‘দ্বৈপায়ন' ইত্যাদি শব্দগুলি পুরাণ-প্রসিদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে নবতর ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত হয়েছে; 'তন্ত্রী' কাব্যের ঊনত্রিশটি কবিতার মধ্যে এগারোটিতে পুরাণ-প্রসঙ্গ লক্ষিত হয়। এখানে 'ঊর্বশী' রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বসৌন্দর্যের প্রতিমা নয়, কবির ব্যক্তিগত ভাবনায় পরিবর্তিত : “আজকে তোমার চ্যুতবনের লীলাখেলা/ প্রাণে জাগায় অবহেলা/ওই যে, তোমার পাণ্ডু বুকের কৃষ্ণচূড়া/মধুতে তার নেই যে-সুরা/মর্মর প্রায় তোমার ঊরু আর না দহে/চুম্বনে হিম ঝিমিয়ে রহে।”


‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থে রাবণ, ইন্দ্র, ফাল্গুনী, শিব, মহাশ্বেতা, কালী ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র নাম দেখা যায়। এছাড়া, ‘বৈতরণী’, ‘অমরাবতী’, ‘ত্রিভুবন’, ‘অলকানন্দা’, ‘সুরধুনী' প্রভৃতি পৌরাণিক স্থানের নামোল্লেখ আছে। বর্তমানের ভয়াবহ অবক্ষয়ে যখন “দলিত সুন্দর শাস্ত শিব পদতলে” তখন কবির মনে হয়েছে : “বৈতরণী পুনর্বার ডাকিবে আমারে অবিরত।” কবির কাছে মৃত্যু ‘নীলকণ্ঠ’ এবং রুদ্র ‘মহাকাল’ রূপে প্রতিভাত— “আসে মৃত্যু নীলকণ্ঠ, আসে মৃত্যু রুদ্র মহাকাল।” “মহাশ্বেতা’ কবির কাছে ‘ক্ষণিকা পরমা’ ‘ক্রন্দসী' কাব্যেও সঞ্জয়, অহল্যা, নীলকণ্ঠ, রুদ্র, দুঃশাসন, নটরাজ, শৈলসূতা, অশনি, চণ্ডী, নহুষ, নচিকেতা প্রভৃতি চরিত্র-নাম উল্লিখিত। উত্তর কাব্যগ্রন্থের ঊনিশটি কবিতার মধ্যে মাত্র ৪টিতে ভারত-পুরাণের উপকরণ আছে।


'সংবর্ত' কাব্যের 'যযাতি' কবিতায় আছে পুরাণ প্রসঙ্গের সার্থক প্রয়োগ। এই সুদীর্ঘ কবিতাটিতে কবির বক্তব্য রূপকের অন্তরালে প্রচ্ছাদিত। এখানে “আমি বিংশ শতাব্দীর/সমানবয়সী” ইত্যাদি উক্তির মধ্যে যেন ‘যযাতি’ বিশ শতকের ‘অকপটতার’ সাধক কবি বা প্রজ্ঞাবান মানবমূর্তি। তাই তিনি পুরাণের যযাতির বিপরীত কথা বলেন: “অকাল জরায় আমি অবরুদ্ধ নই শুক্রশাপে/অজাত পুরুষ সঙ্গে ব্যতিহার্য নয় দুর্বিপাক / অর্থাৎ প্রকট বলে সম্ভোগের অনন্ত বঞ্চনা/পঞ্চাশে পা না দিতেই অন্তর্যামী নৈমিষে নির্বাক”।


সমালোচকের মতে, “কবিতাটি অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায় যে লিখিত পুরাণ-কাহিনী অতিক্রম করে মহাভারতের ‘যযাতি’-উপাখ্যানকে কবি মানব ইতিহাসের আদিপর্বে নিয়ে গেছেন। অলৌকিকভাবে পুত্রের সঙ্গে যযাতির যৌবন বিনিময়ের মধ্যে তিনি অতীত, বর্তমান তথা চিরকালের মানবসমাজের একটি বৈকল্য বা ‘বৃথা বিলাপ’ লক্ষ্য করেছিলেন। যে ‘বিলাপ’ মৃত্যুভয় বা ‘আত্মোপলব্ধির অভাব’ আজকের জড়বাদী বিজ্ঞান শক্তির অহমিকা প্রচারের যুগেও মানুষের মধ্যে গ্লানিকর রূপে দেখা দিয়েছে। একমাত্র আজকের চৈতন্যবান মানুষ (বা কবি স্বয়ং) যযাতির বিপরীত মেরুতে সাফল্য অনিশ্চিত এবং বিনাশ ধ্রুব জেনেও জড়ের সঙ্গে তাঁর অবিকল চৈতন্য সম্বল করে সংগ্রামে রত” (কমলেশ চট্টোপাধ্যায় : ‘বাংলা সাহিত্যে মিথের ব্যবহার’ ১৯৮০)। অনুরূপভাবে ‘সংবর্ত' কাব্যের ‘জেসন্’ কবিতাটিতে গ্রীক পুরাণের রূপসী মোহিনী মিডিয়ার সঙ্গে জেসনের প্রেমলীলা ও মোহভঙ্গের উপাখ্যানের নব রূপায়ণ ঘটেছে।


এইভাবে দেখা যায়, ভাবকল্পনায়, শব্দসজ্জায়, আঙ্গিকের ও পুরাণের নবতম প্রয়োগে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা কাব্যে দ্বিতীয়বিহীন কবি শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন।