সালী চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

বীরসার বিদ্রোহী বাহিনীর প্রথম সারির নেতা প্রৌঢ় ডোনকার যুবতী স্ত্রী সালী। কথায়, বার্তায়, আচার-আচরণে পুরুষের মন মোহিত করার গুণের অভাব তার নেই। তবে সে সৎ এবং ভদ্র। সালীর মধ্যে ছিল একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ। সে অন্য মুণ্ডা গৃহবধূদের মতো নয়। একার্থে তেজস্বিনী নারীর মতো আপনাতে আপনি গরিয়সী। তার স্বাতন্ত্র্য বোধের পরিচয় পাওয়া যায় বীরসার দু'বছরের কারাদণ্ড হলে মুণ্ডারা যখন দল বেঁধে খ্রিস্টান হতে যায় তখন কিন্তু সে খ্রিস্টান হতে যায়নি। বীরসার বিদ্রোহে বিদ্রোহী ডোনকা যদি পুরুষদের মধ্যে প্রথম সারির নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করে তবে মুণ্ডানীদের মধ্যে সালী সেই বিদ্রোহের ইন্ধন জুগিয়েছিল বলতে হয়।


সালী যে বিদ্রোহিনীদের সমগোত্রীয় তা ধানী মুণ্ডার বুঝতে বিলম্ব হয়নি। তাই সে জেল থেকে পালিয়ে প্রথমে সালীর কাছে এসেছিল। সে ভরত দারোগার মন যোগাতে নানা ছলাকলা এমনকি স্বামী ডোনকার নামেও অভিযোগ পেশ করতে থাকে। ভরত দারোগাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সে কাপড়ের মধ্যে পেটের কাছে তিরগুলি লুকিয়ে সে গর্ভিণী নারীর মতো অরণ্যে কুল কুড়াতে এসেছিল। সালী যে প্রখর বুদ্ধিসম্পন্না এই কর্মে তা প্রমাণিত। এমনকি সে বীরসাকে ধরতি আবা বলে মিথ্যা ব্যাঙ্গ করে বলেছে—“সুগলার ছেলা বীরসা ভগবান। তাহলে ত পিঁপড়াও হাতি, বুরুড়িও রাঁচি শহর।” সালী যে কৌতুক করতে পারদর্শিনী তা এই বাক্যে প্রমাণিত। সালী তার কার্যকলাপ এবং ভাবভঙ্গির দ্বারা এ উপন্যাসের নায়িকার পদমর্যাদায় বিভূষিত।


বীরসার নির্দেশে মুণ্ডাদের জীবন থেকে একেবারে করম পরবের নাচ গান উঠে গিয়েছিল। মানী পোহালি এজন্য দুঃখ বোধ করলে সালী বলে—“পুরানো পথ না ছাড়লে তার পথ ধরবি কী করে। এই ফাল্গুনেও শাল ফুলের গন্ধে মন মৌয়া খেতে গিয়েছিল। বনে কত ফুলরে মানী। একটি তুলি নাই, চুলে পরি নাই। করম দিনে একা নাচি নাই বনে।” এসব কার্যকলাপে বোঝা যায় বীরসার প্রতি তার একটা সূক্ষ্ম অনুরাগ ছিল। কিন্তু সেই অনুরাগকে সে প্রশ্রয় দেয়নি। ভগবানের অরণ্য অজ্ঞাতবাস জীবনে সালীই ছিল তার সঙ্গীনি। বীরসাইতদের সাহায্য করার জন্য সে তার সমস্তরকম অস্ত্র প্রয়োগ করেছে, যেমন সুচতুরতা, বুদ্ধিমত্তা, ছলাকলা ইত্যাদি। বীরসাইতদের প্রতি তার কর্তব্যজ্ঞান প্রখর।


বীরসার ডাকে সালী সমস্ত কিছু খোয়াতে বসেছিল। পুলিশ এসে ওর ধানের মরাই ভেঙে দিয়েছিল। স্বামী গেছে জেলে তবুও ভগবান বীরসার প্রতি ওর বিশ্বাস অটুট। সে ভগবানের কাজকর্ম অত্যন্ত গোপনে চতুরতার মাধ্যমে নিষ্পন্ন করেছে। তার উপর বিশ্বাস করে বীরসা জেল থেকে ফিরে প্রথমে তার বাড়িতে গোপনসভা ডেকেছিল। সে বীরসার হাতে সমস্ত কিছু অর্থাৎ তার পরিবার, পরিজন এমনকি তার একমাত্র পুত্র পরিবারে বীরসার হাতে সঁপে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল সেদিন। অর্থাৎ সে একজন প্রকৃত দেশহিতৈষিণী নারী। এরপর সৈলরাকাব পটতে পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে মুণ্ডারা পরাস্ত হলে বীরসা পুলিশের চোখ এড়াতে রোগোতার জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল। বীরসার সেই পলাতক জীবনে মনের সুপ্ত অনুরাগকে চরিতার্থ করতে সালী তার সঙ্গিনী হয়েছিল। দিনের পর দিন বীরসা এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে পালিয়ে বেড়িয়েছে। অবশেষে ৫০০ টাকার বিনিময়ে শশীভূষণ রাই আর মাঝি তামারিয়া সেখানকার জঙ্গলে আত্মগোপনকারী বীরসাকে ধরিয়ে দিলে সে শশীভূষণ আর তামারিয়াকে ধিক্কার দিয়ে বলেছে বীরসার প্রতি সালীর কী গভীর একাত্মতা ছিল, সালীর এই উক্তিতে প্রমাণ পাওয়া যায়।


দীর্ঘদিন পর অমূল্য তার নোটবই লিখেছিল— বীরসার মৃত্যুর পর জেলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে। সেখানে সে বলেছে—সালী গাছের নীচে বসেছিল। কিন্তু অমূল্যকে “দাওয়ায় বসাল। খুঁদ সিদ্ধ খেতে দিল।” অমূল্য জানতে চেয়েছিল তার স্বামী তো এখন জেলে তাহলে এখন তাদের সংসার চলে কী করে ? সালী তার অন্তর মোথিত করে উত্তর দিয়েছিল—“ভগবান শিখায়ে দিয়া গেছে উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই। মুণ্ডার জীবনে কষ্ট ফুরালে তো ভগবানের মরণ। উলগুলানের শেষসেনা নিতে নাই।” অর্থাৎ যদি মানুষের জীবন থেকে অভাব দারিদ্র চিরতরে নির্বাসিত হত তাহলে তো মানুষ কোনোদিনও প্রতিবাদী হত না। আর যে মানুষের জীবনে কোনো প্রতিবাদ নেই, অভিযোগ নেই সে জীবনের কোনো বৈচিত্র্য থাকে না। মুণ্ডাদের জীবনে অভাব ছিল তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। কাজেই সালী গর্বিত। তার সংসারে অভাব ছিল বলেই তো ভগবানের মরণ নেই, উলগুলানের শেষ নেই। এই সার সত্য উচ্চারণের সঙ্গে সালীর সমগ্র সত্ত্বাটি আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং তাকে উপন্যাসের নায়িকা রূপে কল্পনা করতে কোনো দ্বিধায় অবকাশ থাকে না।