বাংলা নাট্যসাহিত্যে ক্ষীরোদপ্রসাদ (ভট্টাচার্য) বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩ খ্রীঃ–১৯২৭খ্রীঃ)।

বাংলা নাটকে ক্ষীরোদপ্রসাদ (ভট্টাচার্য) বিদ্যাবিনোদ


পেশাদারী বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনে ইতিহাস নির্ভর নাটক লিখে একসময় ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ দর্শকমহলে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ নাট্যরচনার নির্মাণকৌশলে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, এমন কী শরৎচন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন সমকালীন লেখকগণের ভাবধর্মকে অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন। এর পাশাপাশি নাট্যমঞ্চের দাবী অর্থাৎ দর্শক মনোরঞ্জনের দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। তাঁর নাটকগুলিকে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, কাল্পনিক, রোমান্টিক প্রভৃতি নানা শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে।


ক্ষীরোদপ্রসাদের জন্ম-শিক্ষা-কর্মজীবন:

১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের (বঙ্গাব্দ ১২৬৯) ১২ই এপ্রিল খড়দহে ক্ষীরোদপ্রসাদের জন্ম হয়। পিতা, গুরুচরণ ভট্টাচার্য শিরোমণি, উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা খড়দহের বিখ্যাত গুরুবংশের উত্তরাধিকারী। ক্ষীরোদপ্রসাদ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে মাত্র সতেরো বছর বয়সে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর ১৮৮৩-তে জেনারেল এসেমব্লীজ ইনষ্টিটিউশন থেকে এফ. এ., ১৮৮৮-তে মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে রসায়ন বিদ্যা নিয়ে এম. এ. পাস। তারপর জেনারেল এসেমব্লীজ ইনষ্টিটিউশনে বা স্কটিশচার্চ কলেজে ১৮৯২-১৯০৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর পর কলেজে পড়ানোর কাজ ত্যাগ করে তিনি নাট্যচর্চায় সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই বাঁকুড়া শহরের কাছে বিক্‌না গ্রামে ৬৫ বৎসর বয়সে ক্ষীরোদপ্রসাদের মৃত্যু হয়।


ক্ষীরোদপ্রসাদের রচনাসমূহ:

ক্ষীরোদপ্রসাদের প্রথম রচনা ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাসী' (১৮৮৫) দু-খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আছে বিভিন্ন ধরনের নাটক।


(ক) ক্ষীরোদপ্রসাদের রঙ্গনাট্য ও রঙ্গন্যাস : ‘কবি-কাননিকা’ (১৮৯৬), '‘আলিবাবা’ (১৮৯৭), 'প্রমোদরঞ্জন' (১৮৯৮), ‘দাদা ও দিদি' (১৯০৮), 'ভূতের বেগার’ (১৯০৮), 'রূপের ডালি’ (১৯১৩)।


(খ) ক্ষীরোদপ্রসাদের নাটক-নাটিকা : ‘ফুলশয্যা' (১৮৯৪), 'সপ্তম প্রতিমা' (১৯০২), ‘রঘুবীর’ (১৯০৩), ‘রঞ্জাবতী’ (১৯০৪), 'উলূপী' (১৯০৬), ‘রক্ষঃ ও রমণী’ (১৯০৭), ‘দৌলতে দুনিয়া' (১৯০৯), 'মিডিয়া’ (১৯১২), 'নিয়তি' (১৯১৪), 'রত্নেশ্বরের মন্দির' (১৯২২), ‘জয়শ্রী’ (১৯২৬)।


(গ) ক্ষীরোদপ্রসাদের নাট্যকাব্য ও গীতিনাট্য : 'কুমারী' (১৮৯৯), 'জুলিয়া' (১৯০০), ‘বভ্রুবাহন' (১৯০০), 'বেদৌরা' (১৯০৩), 'বৃন্দাবন-বিলাস' (১৯০৪), 'বাসন্তী' (১৯০৮), ‘বরুণা’ (১৯০৮), 'পলিন' (১৯১১), 'কিন্নরী' (১৯১৮), 'রাধা-কৃষ্ণ’ (১৯২৬)।


(ঘ) ক্ষীরোদপ্রসাদের পৌরাণিক ও ধর্মমূলক নাটক আখ্যান : ‘প্রেমাঞ্জলি’ (১৮৯৬), ‘সাবিত্রী’ (১৯০২), 'দুর্গা' (১৯০৯), 'ভীষ্ম' (১৯১৩), 'রামানুজ' (১৯১৬), 'মন্দাকিনী’ (১৯২১), ‘নর-নারায়ণ' (১৯২৬)।


(ঙ) ক্ষীরোদপ্রসাদের ঐতিহাসিক নাটক : ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ (১৯০৩), ‘পদ্মিনী' (১৯০৬), ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৭), 'চঁাদবিবি' (১৯০৭), 'নন্দকুমার’ (১৯০৭), 'অশোক’ (১৯০৮), ‘বাঙ্গালার মসনদ' (১৯১০), ‘খাঁজাহান’ (১৯১২), “আহেরিয়া’ (১৯১৫), ‘বঙ্গের রাঠোর’ (১৯১৭), ‘আলমগীর' (১৯২১), 'বিদূরথ' (১৯২৩), ‘গোলকুণ্ডা’ (১৯২৫)।


(চ) ক্ষীরোদপ্রসাদের উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ : 'নারায়ণী' (১৯০৪), 'বিরামকুঞ্জ' (১৯০৯), ‘পুনরাগমন' (১৯১২), 'নিবেদিতা' (১৯১৯), ‘গুহামুখে’ (১৯২০), ‘পতিতার সিদ্ধি’ (১৯২৪)।


(ছ) ক্ষীরোদপ্রসাদের পত্রিকা সম্পাদনা : ‘অলৌকিক রহস্য’ নামে মাসিক পত্রিকা ১৩১৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে অনিয়মিতভাবে ছয়মাস সম্পাদনা।


ক্ষীরোদপ্রসাদের খ্যাতি প্রধানত ঐতিহাসিক নাটকরচনার ক্ষেত্রে বিস্তারিত হয়। তাঁর ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ স্বাদেশিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত। তবে এখানে অনৈতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র এবং স্বাদেশিক আবেগ ও উচ্ছ্বাস ঐতিহাসিক সত্যের (Historical truth) তুলনায় অধিকতর বলে মনে হয়। তাঁর ‘আলমগীর’ নাটকটিতে ঔরঙ্গজেবের বিচিত্র চরিত্র দ্বন্দ্ব দিগ্বিজয়ী অভিনেতা আচার্য শিশিরকুমারের অভিনয় দক্ষতার গুণে কালজয়ী হয়েছে। ক্ষীরোদপ্রসাদের নাটকে দ্বিজেন্দ্রলালের আদর্শবাদ অনুপস্থিত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকের মতো রোমান্সের ইন্দ্রজাল ইন্দ্ৰধনুচ্ছটায় আচ্ছন্ন নয়, বরং ইতিহাস ও কল্পনার সমবায়ে তা অনেক পরিমাণে সর্বজনবোধ্য রূপ ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর এই নাটকগুলির মধ্যে অতিনাটকীয় দুর্বলতা এবং মানবজীবন সম্পর্কে অগভীর ধারণাই উচ্চতর সারস্বত গুণ থেকে বঞ্চিত করেছে।


তার পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘বভ্রুবাহন’ (১৩০৬), 'সাবিত্রী’ (১৩০৯), 'ভীষ্ম' (১৩২০), 'নর-নারায়ণ’ (১৩৩৩)। তাঁর পৌরাণিক নাটকগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভক্তিরসের প্লাবনের অল্পতা বা অভাব। এদিক থেকে তাঁর নাটকগুলি ছিল গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটক অপেক্ষা উন্নততর। পুরাণকে যথাসম্ভব অনুসরণ এবং পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন—তার পৌরাণিক নাটকগুলির অন্যতম বিশেষত্ব। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘নরনারায়ণ’-এ কর্ণের অস্তদ্বন্দ্ব এবং ‘ভীষ্মে’ অম্বার প্রতিহিংসাময়ী নারীরূপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে।


‘আলিবাবা’ (১৮৯৭), 'কিন্নরী' (১৯১৮)– ‘আলিবাবা’র মতো সর্বজনধন্য নাটক সমগ্র বঙ্গ নাট্যসাহিত্যেই এক বিরলদৃষ্ট ঘটনা। শুধুমাত্র এই একখানি নাটকের জন্যই ক্ষীরোদপ্রসাদের স্থান বঙ্গ-নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে অনশ্বর রূপে দেখা দিয়েছে। এই নাটকে লঘু-তরল ভাবধারার মধ্যে কৌতুকরসের প্রকাশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বিজাতীয়, বিধর্মী, এমন কী নিন্দনীয় পেশায় (চাকরাণী ও চাকর) নিযুক্ত হয়েও মর্জিনা আবূদাল্লা বাঙালীর ঘরে ঘরে জাতি-ধর্ম-শ্রেণী-নির্বিশেষে সকলের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।


ক্ষীরোদপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্রলালের মতো প্রতিভাবান নন। গিরিশচন্দ্রের মতো ভক্তিভাবের প্রাবাল্যে দর্শক-চিত্তকে অভিভূত করার ক্ষমতাও রাখেন না। তবু পেশাদারী বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন অনুসারে নাটক লিখে তিনি গিরিশ-পরবর্তী বাংলা নাটকের শূন্যতাকে অনেক পরিমাণে পূর্ণ করেছিলেন। আর এই কারণেই তিনি বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্মরণীয়।