‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনটির সংলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো।

মধুসূদনের 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনটির সংলাপ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে যদি এর প্রতিটি চরিত্রের মুখের ভাষা ব্যবহারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তাহলে দেখা যাবে সংলাপ সৃষ্টিতে এটি কত অনন্য তার দাবীদার। প্রথমে ভক্তপ্রসাদের কথা ধরা যেতে পারে। তিনি আগাগোড়া Standard বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন। আনন্দের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে তাঁর ভাষা বিশুদ্ধ হয়ে ওঠ। কিন্তু হানিফ গাজীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক সময় তিনি হানিফকে তুচ্ছার্থে ‘হাফে’ পরে এই হানিফকেই মধ্যম পুরুষের সাধারণ রূপ 'তুমি' বলে সম্বোধন করেছেন। এটি ব্যতিক্রমমাত্র।


ফতেমার অঞ্চলে ধারণ করে তিনি যখন রূপমুগ্ধতা প্রকাশ করেন—“প্রেয়সী তুমি যদি যাবে, তবে আমি আর বাঁচবো কিসে? তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার কলিজ–তুমি আমার চোদ্দো পুরুষ।” সেই সঙ্গে চার লাইনের একটি কবিতাও বলেন। তখন প্রাথমিকভাবে তা হাস্যরসাত্মক ব্যাপার হয়ে উঠলেও এর বাকভঙ্গির প্রতি বিশেষভাবে নজর দিলে বোঝা যাবে যে, একেবারে পরিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় তিনি কথা বলেছেন।


বাচস্পতির সংলাপ তৎসম শব্দ বহুল। কিন্তু হানিফের সঙ্গে আলাপনের সময় তাঁর ভাষারীতির পরিবর্তন ঘটে। নাট্যকার ও এবিষয়ে সচেতন ছিলেন। বাচস্পতি বলেন, ‘কুডুলি’, হানিফ বলে ‘কুডুল খান’ । আবার তাঁর গাওয়া রামপ্রসাদী গানটি তাঁর সংলাপের একটি দিক। আরম্ভে ভক্রপ্রসাদকে তিনি বলেন—'মা কমলার কৃপায় আপনার অপ্রতুল কিসের? এই কমলার কৃপাই, আনন্দময়ী মায়ের বিচাররূপে, ব্যঞ্জনাময় অর্থে নাটকে প্রদর্শিত হয়েছে। বনস্পতির মৃতা মা, কমলা এবং আনন্দময়ীর মা—এই তিন মা এখানে অভিন্ন হয়ে গেছেন।


হানিফ একজন চাষি, স্বাভাবিকভাবেই সে মুসলমান বলেই তার ভাষাতে আরবি-ফারসি হিন্দি শব্দের প্রাবল্য দেখা যায়। নাটকে তার প্রারম্ভিক উত্তির মধ্যে পীর ও আল্লার বারংবার উল্লেখ রয়েছে। প্রথমবার ভক্তপ্রসাদকে দেখে সে বলে 'কত্তাবাবু সালাম করি'। একেবারে অভিন্ন ও অবিকৃত ভাষায় শেষেও এই বলে কত্তাকে সে সেলাম করেছে। কিন্তু দুই সেলাম কত ভিন্ন। আরম্ভে সে বলে—“হা আল্লা! বাপদাদার ভিটেটাও কি আখেরে ছাড়তি হল?” এসকল সংলাপের দ্বারা হানিফ নাট্যমধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসীন হয়েছে।


ফতেমাকে কেন্দ্র করেই নাটকের সকল ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কার্যত নাটকে তাকে দুবারের বেশি দেখা যায়নি। সে বাহ্যত শান্ত প্রকৃতির কিন্তু অন্তরে অভিনেত্রী, ষড়যন্ত্র পরায়ণা এবং ব্যঙ্গ নিপুণা। সেক্ষেত্রে তার সংলাপও অদ্রুপ। মূলত পুঁটি এবং ভক্তপ্রসাদের সঙ্গে সংলাপে তার এই বিশেষত্বগুলি পরিস্ফুট হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই তার সংলাপে এই বিশেষত্বগুলি পরিস্ফুট হয়েছে। ফতেমার সংলাপে আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। তার সংলাপে ‘তামাশা' কথাটির একটি নাট্যতাৎপর্য আছে। পুঁটি যেমন মন্দিরের কথা বলে সেও তেমনি মসজিদের কথা বলে।


পুঁটির সংলাপের মধ্যে দিয়ে নারীর ভাষার সৌকুমার্য বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে) পুনরাবৃত্তি, কাব্যের ছন্দ প্রভৃতি এগুলি নারীর সংলাপের বিশেষত্ব। এসবই পুঁটির সংলাপে লক্ষিত হয়। যেমন—“থু-থু ! পাতিনেড়ে বেটাদের বাড়িতে আসতেও গা বমি বমি করে। থু থু ! কুঁকড়োর পাখা, প্যাজের খোসা। থু থু.... ।" পুনরাবৃত্তি, অব্যয় পদের ব্যবহার, সহচর শব্দ, ধ্বন্যাত্মক অনুকার শব্দ, বাক্যের পর্ব বিভাগ, সব মিলিয়ে নারীর ভাষাটি পুঁটির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পুনরাবৃত্তিজাত ছন্দটাই এখানে প্রধান। যেমন—“সোনার খাবি। সোনার পরবি না....” ইত্যাদি সংলাপের দ্বারা পুঁটি নাটকের মধ্যে বিশেষ তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠেছে।


সর্বোপরি, গদার সংলাপের কথা বলতে গিয়ে বলা যায় তার কথা অনেক সময় তির্যক আকারে বর্ষিত হয়েছে। তবে সেই তির্যকতা কেবল ভক্তপ্রসাদের প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। অন্য চরিত্রের সঙ্গে তার সংলাপ সাধারণ ও সংযত। একদিকে ভক্তপ্রসাদের যৌন লালসায় সে ইন্ধন যোগায়, অন্যদিকে সে ভক্তপ্রসাদের প্রতি তির্যক মন্তব্য করে। এই বিপরীত মানসিকতার মধ্যেই তার চরিত্র এবং সংলাপের বৈশিষ্ট্য নিহিত। মাঝে মাঝে সে প্রবাদ আওড়ায়। ভক্তকে সে মশায় বলে, কিন্তু ব্রজ ও কৃষ্ণের অনুষঙ্গে সেই ভক্তকেই সে ‘মহাশয়' বলে। এই সকল কারণে নাট্যকার মধুসূদন তাঁর এই প্রহসনটিতে সংলাপ সৃষ্টিতে যে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।