বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে পূর্বরাগ ও অনুরাগ কাকে বলে? পূর্বরাগের পদরচনায় কোন্ কোন্ কবি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন?

পূর্বরাগের পদে চণ্ডীদাস তুলনাহীন

‘উজ্জ্বল নীলমণির’ আদর্শ অনুসারে বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদগুলিকে বিভিন্ন রসপর্যায়ে সজ্জিত করেছেন। পূর্বরাগ সেই রসপর্যায়ের প্রথম ধাপ। উক্ত গ্রন্থে বলা আছে-

রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শনে শ্রবণাদিজা।

তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈ : পূর্বরাগ স উচ্চ্যতে।

অর্থাৎ পূর্ণ মিলনের পূর্বে প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক দর্শন, বাক্য শ্রবণ প্রভৃতির মাধ্যমে চিত্তে যে অনুরাগ জন্মায় তাকেই পূর্বরাগ বলে। এই পূর্বরাগে প্রথম প্রেমের নিবিড়তা লক্ষ্য করা যায়।


পূর্বরাগ প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের মনেই জাগ্রত হয়। কিন্তু বৈষ্ণব কবিতায় রাধার পূর্বরাগের কথাই বেশী বর্ণিত। তাই রাধার পূর্বরাগের উপর যেরূপ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে কৃষ্ণের পূর্বরাগে সেরূপ গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রবল আকর্ষণ ও অনুরাগ অবলম্বনে অনেক পদ রচিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব রুপমাধুরী এই আকর্ষণের উৎস। এই বিষয় নিয়ে বৈষ্ণব কবিগণ উচ্চাঙ্গের অনেক পদ রচনা করেছেন। কৃষ্ণনাম শ্রবণে ও কৃষ্ণের রূপদর্শনে রাধার পূর্বরাগ জাগ্রত হয়।


পূর্বরাগের সঙ্গে অনুরাগের কিছু কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। মিলনের পূর্বে প্রেমের যে অবস্থা তাই পূর্বরাগ। এখানে কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব বর্তমান। আর অনুরাগে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। কেবল তীব্র আকর্ষণের অনুভূতিই অনুরাগের লক্ষণ। এই অনুরাগই প্রেমিক-প্রেমিকাকে পরস্পরের দিকে আকর্ষণ করে। উজ্জ্বল নীলমণি’তে বলা হয়েছে যে প্রিয়তম সকল সময়ে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। প্রতি মুহূর্তে নতুন করে তাকে অনুভব করার নাম অনুরাগ। যেমন— 

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মনে ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

রাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে। (জ্ঞানদাস)


পূর্বরাগে বৈষ্ণবকবিদের বেশী আকর্ষণ করে। তাই জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রভৃতি অনেক কবি এই রসপর্যায়ের অনেক সুন্দর পদ রচনা করেছেন।


বিদ্যাপতির পূর্বরাগের পদ : বিদ্যাপতির পূর্বরাগে কৃষ্ণ ও রাধা পরস্পর একাত্ম হতে চেয়েছেন। কৃষ্ণ এমনই প্রিয় রাধার কাছে যে রাধা সকল প্রিয় বস্তু ও কৃষ্ণের মধ্যে কোনও ভেদ কল্পনা করতে পারেন না। কৃষ্ণ রাধার হাতের দর্পণ, মাথার ফুল, নয়নের অঞ্জন এবং মুখের তাম্বুল। কৃষ্ণ হৃদয়ের মুগমদ এবং ‘দেহক সরবস গেহক সার”। বিদ্যাপতির কোনও কোনও পদে সলজ্জ কুণ্ঠিত রাধার সহজ সাবলীল রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। কৃষ্ণের প্রতি তার অনুরাগ অত্যন্ত প্রবল। অথচ গুরুজনেরা কাছাকাছি থাকার জন্য সহজভাবে কৃষ্ণের দিকে অনুরাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারছেন না রাধা। তাই গুরুজনদের পশ্চাতে ফেলে অগ্রসর হয়ে গেছেন।

সখি হে, অপরূপ চাতুরী গৌরী 

সবজন তেজি আগুসরি সঞ্চরী

আড় বদনে ত’হি কেরি

বিদ্যাপতির রাধা চাতুরা; তাই পূর্বরাগের পদে রাধার এই চাতুর্য প্রকাশিত।


চণ্ডীদাসের পুর্বরাগের পদ : চণ্ডীদাস তাঁর রচিত পূর্বরাগের পদে রাধার একটি বিষাদঘন আধ্যাত্মিক মূর্তি রচনা করেছেন। কেবল কৃষ্ণনাম শুনে রাধার অন্তরে যে আকর্ষণের সূত্রপাত হয়েছে সেই আকর্ষণের বশেই তিনি ঘরছাড়া হয়ে বিবাগী হয়ে যেতে চান। যোগিনী বেশ ধরে রাধা কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর। যেমন—

সই কেবা শোনাইল শ্যামনাম

কানের ভিতর দিয়া    মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।।


কৃষ্ণ নাম জপ করতে করতে রাধা আনন্দে আত্মহারা। কৃষ্ণকে পাবার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়েছে—

না জানি কতেক মধু   শ্যামনামে আছে গো

বদন ছাড়িতে নাহি পারে।

জপিতে জপিতে নাম   অবশ করিল গো

কেমনে পাইব সই তারে।


চণ্ডীদাসের রাধা কৃষ্ণপ্রেমেপাগলিনী। কৃষ্ণ প্রেম তাকে ঘরে থাকতে দেয় না। কৃষ্ণের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এত তীব্র যে প্রকৃতি জগতের মধ্যেও তিনি কৃষ্ণের সন্ধান করেন—

রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা। 

বসিয়া বিরলে    থাকয়ে একলে

না শুনে কাহারও কথা।।

সদাই ধেয়ানে    চাহে মেঘ পানে

না চলে নয়ান তারা।

কিংবা,

একদিঠ করি   ময়ূর ময়ূরী

কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।


কৃষ্ণের প্রতি রাধার এই অপূর্ব অনুরাগ আর কোথাও দেখা যায় না। এই অনুরাগের তুলনা মেলে না। দুজনেই দুজনের প্রাণের সঙ্গে বদ্ধ। এই অনুরাগ স্বর্গীয়। তাই পৃথিবীতে এর তুলনা নেই। প্রেমিক-প্রেমিকার আকর্ষণের অনেক তুলনা বা উপমা দেওয়া যায়, কিন্তু রাধাকৃষ্ণের এই অনুরাগ এত গভীর ও স্বর্গীয় যে পার্থিব কোনও বস্তুর সঙ্গেই তার তুলনা করা চলে না

জল বিনু মীন যেন কবহুঁ না জীয়ে। 

মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে।।

……….

কি ছার চকোর চান্দ দুহূ সম নহে। 

ত্রিভূবনে হেন নাহি চণ্ডীদাসে কহে।

বিদ্যাপতির পূর্বরাগের পদে রাধার মানবী চাতুরীটুকু যেমন ধরা পড়ে অন্যদিকে চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদে ভাবগভীরতা এত বেশী যে আমাদের তন্ময় হয়ে ভাবতে হয় এই অলৌকিক অনুরাগের কথা।


জ্ঞানদাসের পূর্বরাগের পদ : চণ্ডীদাসের রাধা ভাবের গভীরতায় অনন্যা, বিদ্যাপতির রাধা মানবী বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল আর জ্ঞানদাসের রাধা রুপচেতনায় বিভোর। কৃষ্ণের অসামান্য রূপ দেখে রাধার অন্তরে পূর্বরাগের যে সূচনা তা জ্ঞানদাসের কাব্যে চিত্রিত। কৃষ্ণের রূপ দেখে আশ্চর্য হয়ে রাধা বলেন—

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ রে।।


কেবল রূপের প্রতি অনুরাগ নয়, সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের আকর্ষণও তীব্র। কৃষ্ণের প্রেম লাভের জন্য তাই তিনি এমন অস্থির।—

রূপ দেখি হিয়ার আরতি না টুটে। 

বল কি বলিতে পারি যত মনে উঠে।

কৃষ্ণের হাসিতে যেন মধু ঝরে পড়ে। কৃষ্ণের মৃদুমন্দ হাসির মধ্যেই রাধা অমৃতরসের সন্ধান পান। গুরুজনদের মাঝে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ শুনে তাঁর তনুমন পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। আনন্দের গভীরতায় তাঁর চোখে জল এসে পড়ে।

পূলকে ঢাকিতে করি কত পরকার।

নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।।

ঘরের যতেক সবে করে কানাকানি। 

জ্ঞান কহে লাজ ঘরে ভেজাই আগুনি।।

জ্ঞানদাসের পূর্বরাগের পদগুলি চণ্ডীদাসের পদের মতই ভাবগভীরতায় অনন্য।