ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মঠাকুরের ভাবকল্পনার উৎস | ধর্মমঙ্গল কাব্যের ঐতিহাসিক উপাদান

ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মঠাকুরের ভাবকল্পনার উৎস


আর্যগাথা না হয়েও সাহিত্যবেত্তা ও ঐতিহাসিকের কাছে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মতো থমকে দাঁড়িয়ে আছে যে অনার্যসাহিত্য, নাম তার ‘ধর্মমঙ্গলকাব্য'। এই কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নন, দেবতা। এই দেবতার নাম ‘ধর্মঠাকুর’ কেন হল তা গভীর বিতর্কের বিষয়। এই বিষয়টিকে নানাভাবে দেখা যায়


(ক) ভাববাদী তত্ত্ব : ধর্মপূজা সম্পর্কে প্রথম সবিস্তারে আলোচনা করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ স্বরূপ বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মপূজার অনুষ্ঠান এবং বুদ্ধদেবের অন্যতম নাম ছিল ‘ধর্মরাজ’—এই দুটি তথ্যের উপর তিনি জোর দিয়েছেন। আবার ‘ধর্মপূজাবিধানে’র সম্পাদক ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, ধর্মঠাকুরের পূজা যে একদা বৌদ্ধ সম্প্রদায় কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল তার প্রমাণ রাঢ় অঞ্চল থেকে আজও পাওয়া যায়।


ড. সুকুমার সেনের মতে, ধর্মঠাকুর এবং যমরাজা অভিন্ন দেবতা। তিনি শাস্ত্রের “যমম্ ধর্মরাজস্য” বা “যমোঽপি ধর্মরাজ” উক্তি অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অনুরূপভাবে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লিখিত ইন্দ্ৰ এবং বরুণদেবের সঙ্গে ধর্মদেবতার ভাবকল্পনার সংযোগ আছে।


(খ) ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্ব : সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, কূর্মবাচক কোন অস্ট্রিক শব্দ ‘দড়ম’ থেকে ‘ধর্ম’ নামের উৎপত্তি। কারণ অস্ট্রিক ভাষার মধ্যে ‘Dharam dak' (দড়ম দাঃ) নামে একটি শব্দেরও সন্ধান পেয়েছেন ড. অমলেন্দু মিত্র। তার মতে, এর অর্থ হল, বরযাত্রীদের নিয়ে আসা অথবা বিবাহের অনুষ্ঠান বিশেষ। ধর্মঠাকুরের কথায়ও আমরা দেখতে পাই শিব অথবা ধর্মঠাকুরের সঙ্গে লীলাবতীর বিবাহের অনুষ্ঠান। তাছাড়া, এই ধর্মদেবতার পূজারী বা ‘দেয়াসী’ ‘মাঝি দড়ম’ নামেও সুপরিচিত। ধর্মঠাকুরের গাজনে ‘ধর্মডাক’ বা ‘জাক’ বলে একটি শব্দ আছে। ‘ধর্মডাক’ কথাটির বর্তমান অর্থ, সকলে সমস্বরে ধর্মঠাকুরকে ডাকা।


পুরাতাত্ত্বিক শ্রীসুধাংশুকুমার রায়ের মতে, মিশরীয় ভাষায়, “দো-অহোম-রা” নামে একটি শব্দ থেকে ‘ধর্ম’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় ভাবনার সঙ্গে ভারতীয় ভাবনার সাদৃশ্য লক্ষ্য করে এই মন্তব্য করা হয়েছে। যাই হোক, ‘ধর্ম’ শব্দটি যে শুধুমাত্র আর্যশাস্ত্র থেকে উদ্ভূত নয়, এ সম্পর্কে এখন বহু ঐতিহাসিকেরাও একমত। খুব সঙ্গত কারণেই মনে হয়, এই ‘ধর্ম’ নামটি একটি অবৈদিক শব্দের পরিবর্তিত রূপ। কেননা ধর্মের সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক কল্পনা করে ‘করম’ পরবের কথাও আদিবাসী সংস্কৃতিতে দেখা যায়। সেখানে ধর্মপূজায় করম গাছের ডাল পোঁতা হয়। চড়ক গাছরূপে তাকে কল্পনা করে তাকে ঘিরে নৃত্য করা হয় পরে জলে সেই গাছ নিক্ষেপ করা হয়।


বিশেষত্ব : অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের তুলনায় ধর্মমঙ্গলকাব্যের কিছু বিশেষত্ব আছে। সেইগুলিকে সূত্রাকারে এইভাবে বলা যায়


(ক) ধর্মমঙ্গল কাব্য একান্তভাবে আঞ্চলিক কাব্য। সমগ্র বাংলাদেশ নয়, পশ্চিম এবং দক্ষিণ বঙ্গের মধ্যেই তার বিস্তৃতিলাভ হয়েছিল।


(খ) ধর্মমঙ্গলকাব্য প্রধানত বীররসাত্মক কাব্য। এই কাব্যের কাহিনীর পটভূমিতে প্রাচীন গৌড়দেশের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান।


(গ) ধর্মদেবতার পূজা-অনুষ্ঠানে বৈদিক, অনার্য, বৌদ্ধভাবনা এমন কি ইসলামী ভাবধারা (দ্রষ্টব্য : ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ ছড়া-অংশ) পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে প্রকাশ পেয়েছে।


(ঘ) ধর্মপূজায় ডোম, জেলে, নাপিত, যুগী, বাগদী ইত্যাদি ব্রাহ্মণেতর সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার স্থান পেয়েছে। একসময় ব্রাহ্মণ কবিদের এই দেবতার বন্দনাগান করার জন্য সামাজিক মর্যাদাহানির আশঙ্কা থাকত। এই কাব্যে নায়ক লাউসেন এবং ইছাই ঘোষ (প্রথমজন ধর্মের বরপুত্র, দ্বিতীয়জন চণ্ডীর আশীর্বাদপুষ্ট)। এছাড়া অন্যান্য নরনারী, যথা—কালু ডোম, লখাই ডোমনী, কানাড়া, মহামদ প্রমুখেরা দেবদেবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন সাধারণ মানুষ মাত্র। অন্ত্যজ শ্রেণী এবং অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা আত্মশক্তি এবং শারীরিক শৌর্যের উপর নির্ভর করে সঙ্কট সমস্যার মোকাবিলা করেছে। চরিত্রগুলি হয়ত শেষ পর্যন্ত অপরিস্ফুট, কিন্তু ব্যক্তিত্বপূর্ণ।


(ঙ) পুত্রলাভ এবং কুন্ঠ ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্যলাভের জন্য (কাহিনীতেও আছে সম্ভানহীনা রাণী রঞ্জাবতী পুত্র লাউসেনকে লাভ করেছিলেন এবং মন্ত্রী মহামদ কুষ্ঠ রোগ থেকে আরোগ্যলাভ করেছিল) এই দেবতার পূজা করা হয়। ধর্মঠাকুরের কোন বিশেষ মূর্তি নেই। ইনি বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন নামে শিলা মূর্তিতে পূজিত হন; যেমন—বেলডিহা গ্রামে বাঁকুড়া রায়, শ্যামবাজার গ্রামে দলু রায়, গোপালপুরে কাকড়া বিছে, দেপুরে জগৎ রায়, বরুণ গ্রামে মোহন রায়, পশ্চিমপাড়ায় যাত্রাসিদ্ধি ইত্যাদি নামে অধিষ্ঠিত আছেন। ধর্মদেবতার উপাসকেরা শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধন করে বহু দর্শকের সামনে ধর্ম পূজা করেন।

বিষয়বস্তু অনুযায়ী ধর্মঠাকুরের পুঁথিগুলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়

  • (১) ধর্মপূজা বিধান বা ধর্মপুরাণ, 

  • (২) ধর্মমঙ্গল কাব্য। 


এই অংশ দুটির আর এক নাম শূন্যপুরাণ। কারণ কোন কোন পুঁথিতে এই জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ‘শূন্য’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ অ-রূপ বা অ-বর্ণ বলেই ধর্মদেবতা শূন্যদেবতা। তিনি নিরঞ্জন। বলা বাহুল্য, এই শূন্যপুরাণের সৃষ্টিকাহিনী বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী বিবৃত নয়, তা মূলত আর্যেতর ভাবনায় কল্পিত হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের একটি সূক্তে বর্ণিত সৃষ্টির আদিকথার সঙ্গে এর অল্প-বিস্তর সাদৃশ্য আছে।


ধর্মপূজা বিধান : কতকগুলি ছড়ার সমষ্টি। রচয়িতা ডোম, নাম রামাই পণ্ডিত। তাঁর নামে প্রাপ্ত পুঁথিটির নাম ‘শূন্যপুরাণ'। তবে তাঁর নামের ভণিতায় নানাজনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। পুঁথিটির আবিষ্কারক ও সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বসু। রামাই পণ্ডিতের ভণিতা যুক্ত ‘আগমপুরাণে’ ‘রামাই পণ্ডিতের পদ্ধতি' রচনায় নানা স্থানে ‘শূন্য’ কথাটির উল্লেখ দেখে সম্পাদক এর ‘শূন্যপুরাণ’ নামকরণ করেছেন। এখানে আছে—

  • (ক) ধর্ম নিরঞ্জন কর্তৃক বিশ্বসৃষ্টি প্রভৃতি উৎপত্তিপর্ব এবং ধর্মপূজা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, (খ) হরিশচন্দ্র লুইচন্দ্রের কাহিনী,
  • (গ) 'নিরঞ্জনের রুষ্মা' (উষ্মা) নামে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ছড়া।

শেষোক্ত অংশটি বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এক মূল্যবান তথ্যের সন্ধান দেয়। সাহিত্যের ইতিহাসে এই অংশের গুরুত্ব হল, ধর্মপূজার মধ্যে মুসলমানী ভাবধারার স্বীকৃতি লাভ (এই প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা আছে, নিরঞ্জনের রুষ্মা’ টীকা-অংশে)। শূন্যপুরাণের দু-এক স্থলে বাংলা গদ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তার প্রাচীনত্ব সংশয়াতীত নয়।


রামাই পণ্ডিতের আর একটি উল্লেখযোগ্য পুঁথি আবিষ্কার করে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশ করেছেন ড. পঞ্চানন মণ্ডল। নাম দিয়েছেন 'অনাদ্যের পুঁথি'। রচনাকাল অষ্টাদশ শতাব্দী, পুঁথিটি খণ্ডিত। এর বৈশিষ্ট্য হল

  • (১) রামাই পণ্ডিতের জীবনকাহিনী বর্ণনা। রামাইয়ের ছেলে শ্রীধর সম্পর্কে নতুন নাম (ধর্মদাস নয়) ও তথ্যদান। 

  • (২) ধর্মপূজা সম্পর্কিত কিছু নতুন তথ্যের সংযোজন। 

  • (৩) রাঢ় অঞ্চলের লোকেদের ভাষা-ব্যবহারের চিত্তাকর্ষক নিদর্শন ‘রেঢ়ো বুলি’ প্রকাশ করা। 

  • (৪) পুঁথিটি পূর্ণাঙ্গ নয়, খণ্ডিত।


ধর্মমঙ্গল কাব্যের ঐতিহাসিক উপাদান :

ধর্মমঙ্গল কাব্যের ইতিহাসের উপাদান আছে। এই উপাদান প্রধানতঃ রাঢ়বঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান; যেমন এখানে 


(ক) কোনো এক ‘গৌড়েশ্বরে’র কথা আছে। লাউসেন এঁর রাজত্বকালে কামরূপ জয় করেন ও কলিঙ্গাকে বিবাহ করেন। ইতিহাসে আছে দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রীস্টাব্দ) কামরূপ ও কলিঙ্গ জয় করেন। এইজন্য তার খুড়তুতো ভাই জয়পাল সেনাপতি হয়েছিলেন। কাব্যে আছে লাউসেনই ছিলেন সেনাপতি। মনে হয়, কবি এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে পরিবর্তন করে ব্যবহার করেছেন কাব্যে।


(খ) পরবর্তী ইচ্ছাই (বা ঈশ্বরী ঘোষ)ঘোষের কথা এক তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, ঈশ্বরী ঘোষের পিতার নাম ছিল ধবল ঘোষ। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র জানিয়েছেন, তাম্রলিপিটি দ্বাদশ শতাব্দীর রচনা। ইছাইয়ের রাজত্ব ছিল ঢেঁকুর গড়। শুধু তাই নয়, ইছাই নবম শতাব্দীর লোক। ইছাই ঘোষের সঙ্গে গৌড়েশ্বরের বিবাদের তাৎপর্য আছে। কেননা পালরাজারা সামস্তদের সঙ্গে প্রায়শই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতেন। ঢেঁকুর গড়টিও কল্পনা নয়। জয়দেবের জন্মগ্রাম কেন্দুলীর কাছে শ্যামারূপার গড়। স্থানীয় জনসাধারণের বিশ্বাস, এই গড়ের কাছে ভগ্নমন্দিরটি ইছাই ঘোষের প্রতিষ্ঠিত।


(গ) আবার, ময়নাগড় বা ময়নানগর নামে এক স্থানের নাম ধর্মমঙ্গল কাব্যে আছে। বাংলার একাধিক গ্রাম দাবী করেছে, এই গৌরব তাদের প্রাপ্য। বিষ্ণুপুর থেকে কিছু দূরে একটি গ্রাম আছে ময়নাপুর। গ্রামবাসীদের মতে, এখানে ধর্মঠাকুরের যে প্রাচীন মন্দির আছে (যাত্রারায় ধর্মঠাকুর) এবং এখানকার ডোম-পুরোহিতরা নাকি রামাই পণ্ডিতের বংশধর। মন্দিরের সামনে ‘হাকন্দ দীঘি' নামে একটি পুকুর আছে। ধর্মমঙ্গলেরও এক নাম ‘হাকন্দপুরাণ’।


তমলুক থেকে ন-মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা গ্রাম আছে ময়না। এখানে আছে একটি গড়ের ধ্বংসাবশেষ। স্থানীয় জনের ধারণা, এই ময়নাগড় ছিল লাউসেনের রাজধানী। O.Mally সাহেব মেদিনীপুরের গেজেটে লাউসেনকে 'Semi-mythical hero' নামে উল্লেখ করেছেন। আমাদের অনুমান লাউসেন নামে বাস্তবে একজন ছিলেন। তাঁর কাল জানা যায় না।


সিদ্ধাত্ত— ধর্মমঙ্গল কাব্য ঐতিহাসিক কাব্য নয়। তার বিষয়বস্তু এবং প্রধান চরিত্রগুলিও ঐতিহাসিক নয়। যদিও আঞ্চলিক ইতিহাসের সঙ্গে তার ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। তাকে ভিত্তি করে লোককল্পনা পল্লবিত হয়েছে।


ধর্মমঙ্গল কাব্য মহাকাব্য কিনা বিচার :

মহাকাব্যে আছে ব্যাপ্তি, বিশালতা এবং সমুন্নতি। ধর্মমঙ্গলের কাহিনী বিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে গড়ে উঠেছে, (গৌড়, কামরূপ, বর্ধমান, ঢেঁকুরগড় ইত্যাদি স্থানের নাম) এবং তা শৌর্যবীর্য দীপ্ত কাহিনী। এদিক দিয়ে ধর্মমঙ্গল যেন মহাকাব্য। কিন্তু মহাকাব্যের largeness বা vastness নেই, grandeur সমন্বয়ও নেই। তবে এর বিষয়বস্তুর মধ্যে মহাকাব্যের সম্ভাবনা ছিল।


রাঢ়ের জাতীয় কাব্য :

রাঢ় অঞ্চল—পূর্বে ভাগীরথী, উত্তরে ময়ূরাক্ষী, দক্ষিণে দামোদর ও পশ্চিমে ছোটনাগপুরের সীমানা বেষ্টিত ভূভাগ। বর্তমানে রাঢ়খণ্ড—হুগলী, বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

  • (ক) ধর্মমঙ্গলে লাউসেনের কাহিনীটির সঙ্গে পালযুগে রাঢ়ভূমির ইতিহাসের কিছুটা সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় গ্রাম-জনপদ ও নদ-নদীর অনেক বাস্তব তথ্য এখানে পাওয়া যায়। মহামাগুলিক ঈশ্বর ঘোষ নামে এক সামন্ত রাজার বর্ধমান জেলার ঢেক্করী নামক স্থানে রাজত্ব করার কথা ড. নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাস' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
  • (খ) মহাকাব্যের উপযোগী বীররসের উপাদান, অর্থাৎ যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা এখানে পাওয়া যায়।
  • (গ) রাঢ় অঞ্চলের লোকেদের ভাষা ব্যবহারের চিত্তকর্ষক নিদর্শন ‘রেঢ়ো বুলি’ ধর্মমঙ্গল কাব্যে পাওয়া যায়।

“জাতে আমি রাঢ় রে করমে রাঢ় তু”— ধর্মমঙ্গলের কবির এই উক্তি থেকে হয়ত এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব, এই কাব্য প্রধানত স্থানীয় বীরত্ব বর্ণনা ও মাহাত্ম্যজ্ঞাপনের বাহন ছিল। সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে, "....Dharma Mangal gives us a picture of the tangled political life of Western Bengal and the martial exploits of Western Bengal and the martial exploits of men and women in humble places."


ধর্মের কৃপায় এবং প্রকৃত বীরের দাপট দেখিয়ে মহামদের ভগিনী রঞ্জাবতীর ছেলে লাউসেন কী করে পার্বতীর স্নেহাশ্রিত ইছাই ঘোষকে হারিয়ে এবং মাতুল মহামদকে নির্জিত করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করে, এ তারই কাহিনী। এর পাশাপাশি কালু ডোম আর তার স্ত্রী লখাই ডোমনীর আশ্চর্য সামরিক প্রতিভা লৌকিক মানুষের সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করছে।


কিন্তু উপরোক্ত তথ্য সত্ত্বেও বলা যায়, ইংরেজী সাহিত্যে National Poetry যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, ধর্মমঙ্গলকে সেই শ্রেণীর কাব্য বলা যেতে পারে না। কারণ আঞ্চলিক (regional) কিংবা, সমাজগত (Communal) পার্থক্য বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমরা সেই কাব্যকেই ‘জাতীয় কাব্য' বলব যে কাব্য একটি জাতির জীবন-ইতিহাসের বিশ্বস্ত প্রতিফলন, যেখানে আঞ্চলিক ও সামাজিক পার্থক্যের ভেদরেখা অবলুপ্ত হয়ে এক মহাসমন্বয়ের চিত্র আভাসিত হয়। ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী বিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে গড়ে উঠেছে। কামরূপ, বর্ধমান, ঢেঁকুরগড় ইত্যাদি একথা ঠিক। কিন্তু কাহিনীর মধ্যে মহাকাব্যের largeness বা vastness নেই grandeur বা সমন্বয়ও নেই। বস্তুত,

  • (১) জাতীয় কাব্যের সংজ্ঞায় সেই কাব্যই উন্নীত হতে পারে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যেখানে আদ্বিজচণ্ডাল একটি অভিন্ন আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে পারে।
  • (২) জাতীয় কাব্য মৌলিক জাতিগত পার্থক্য শুধু দূরই করে না, তা এক সার্বজনীন মানবিক রসাস্বাদনের সন্ধান দিয়ে পুরুষানুক্রমিক পরিতৃপ্তি এনে দেয়।
  • (৩) জাতীয় কাব্য তাকেই বলা যায়, সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতর ধর্মীয় গণ্ডী অতিক্রম করে যেখানে জাতির বৃহত্তর সাংস্কৃতিক গণ্ডীর মধ্যে তার ভাবকল্পনা বিস্তারিত হয়। সমগ্র মঙ্গলকাব্যের মধ্যে একমাত্র ‘মনসামঙ্গলই’ প্রকৃত অর্থে জাতীয় কাব্যের শিরোপা লাভ করেছে। অন্যান্য সব কটি মঙ্গলকাব্যই আঞ্চলিক।