শাক্ত পদাবলিকে সার্থক গীতিকবিতা বলা যায় কিনা তা এই কাব্যের ধর্মনিরপেক্ষ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করো।

সুর নির্ভরতা মধ্যযুগের কাব্যের ধর্ম। অষ্টাদশ শতকে মাতৃসাধনার যে ধারার সূত্রপাত হল তার ভাষা কবিতার ভাষা হলেও, সঙ্গীতের সুরই তার মুখ্য বাহন। শাক্ত সঙ্গীতের পূর্ব নাম ছিল মালসী অর্থাৎ মালবশ্রী রাগাশ্রিত ভবানী বিষয়ক গান। অনেকের মতে মালসী আসলে লোকসঙ্গীত। শাক্ত সঙ্গীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত উভয় ধারার সমাবেশ ঘটেছে। বিষয়ানুযায়ী শ্যামাসঙ্গীত, শাক্তসঙ্গীত, আগমনী বিজয়া প্রভৃতি নামে উল্লেখিত। ড. সুধীর কুমার দাশগুপ্ত মহাশয়ের ভাষায় বলতে হয়– “শাক্তপদ খাঁটি গীতিকাব্য। ইহাতে ভক্তকবির চিত্তই মুখ্য বা প্রধান অবলম্বন। বৈব কাব্যে রাধাকৃষ্ণ থাকায় এবং তাহাদের ভাববিনিময় ও উক্তি-প্রত্যুক্তি থাকায়, বাহ্য লক্ষণে তাহা হয়তো গীতিনাট্য। রামপ্রসাদ বা শাক্ত কবিগণের পদে ভক্তকবি একাই নিজ চিত্তভাব নিবেদন করিয়া চলিয়াছেন। মা বা ব্রথময়ির কোনো কার্য নাই, কথা নাই, তিনি কেবল কবির অদৃশ্য বিশ্বাসস্থল, সম্বোধনের পাত্র। কাজেই বৈশ্ববভাবের আবেদন পরোক্ষ, শাক্ত পদের আবেদন প্রত্যক্ষ পদসাহিত্যে বৈষ্ণব পদ নায়ক-নায়িকা সখা-সখি লইয়া গীতিনাট্য, সূক্ষ্ম রোমান্টিক ভাবাদর্শ তাহার অবলম্বন; শাক্ত পদ ভক্তচিত্তকে লইয়া শুদ্ধ গীতিকাব্য।”


অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত শাক্তপদগুলি বাঙলা গীতিকবিতার পূর্বসূত্র। উনিশ শতকে গীতিধর্মিতার সূচনা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শাক্ত কবিরা কেবল শাক্ত পদগুলিকে শাক্ত সংগীত নয়, গীতিকবিতার অন্যান্য শাখায় বিহার করে মুক্তবদ্ধ বক্তিপ্রধান গীতিকবিতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শাক্ত কবিরা জীবনের বিপদসংকুল অবস্থায় পড়ে অস্তিত্বের ক্ষীণ সূত্রটি রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের অনিবার্য সংঘর্ষে তাঁরা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। সেই শোণিতাদ্র চিত্তের হাহাকারকে বক্তা কণ্ঠের সংগীত করে তুলেছেন। যেখানে তত্ত্বধর্মিতার পরিবর্তে মর্ত্য মমতামধুর মাতা-কন্যার প্রতীক্ষাব্যাকুল মর্মস্পন্দন মুহূর্তটি আভাসিত হয়েছে অথবা কন্যার আসন্ন বিচ্ছেদবেদনায় আর্ত মেনকা জননীর রুদ্ধ ভগ্ন কণ্ঠস্বরে চিরন্তনী বঙ্গজননীর বেদনাবিধুর রূপের অশ্রুবাষ্পাচ্ছন্ন প্রকাশ ঘটেছে—তাকে তো গীতিকবিতা বলাই সঙ্গত। 'আগমনী ও বিজয়া' বাঙালির মাতৃহৃদয়ের গান। রবীন্দ্রনাথ যাকে গানের স্বীকৃতি দিয়েছেন তার গীতিপ্রণতা নিয়ে কী সংশয় থাকতে পারে?


বিশেষত আগমনী বিজয়া পদে শুভ্রমেঘ চুম্বিত নীলাকাশ ও শঙ্খধবল কাশ বনের পটভূমিকায় কবি উমা-মহেশ্বরের পৌরাণিক জীবনকে ধূলি-ধূসরিত বাংলাদেশের হৃদয় কন্দরে স্থাপন করে আমাদের ঘরের কথাকেই বড়ো করে দেখিয়েছেন। আর বিজয়া পদে- “মাতৃহৃদয়ের কন্যাবিচ্ছেদ জনিত আর্তি পৃথিবীর করুণতম বেদনার স্মারক।" নিতান্ত মানবিক চিত্তবৃত্তির অনুপ্রেরণায় শাক্ত কবিরা তত্ত্বনিরপেক্ষভাবে ব্যক্তিক অনুভূতির প্রকাশে সক্ষম হয়েছেন বলেই আগমনী বিজয়া গানকে গীতিকবিতা বলতে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অতএব রামপ্রসাদের শাক্তগীতিতে সমাজপ্রীতি, ধর্মীয় সিদ্ধি ও কাব্যিক মন্ময় উপলব্ধির ত্রিবেণী সংগমের উল্লেখ করতে হয়।


‘ভক্তের আকুতি পর্যায়ে শাক্ত কবিরা যে পদ রচনা করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম গীতিকবিতা রূপেই তার যথার্থ মূল্য। তাঁরা শ্যামা মায়ের চরণে বন্দনা করেছেন মাতৃতান্ত্রিক সাধনার গূঢ় ঐতিহ্যসূত্রে নয়, আধুনিক যুগের ব্যক্তিপ্রাধান্য যখন গীতিকবিতায় আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজছে তখন দুঃখদৈন্য ক্লেশের চিত্তবিদারক বিলাপ–আত্মার আর্তনাদ বহন করে মাতার নামে উৎসারিত হয়েছে। রূপকের মধ্যেও গীতিকবিতার সুর ঝংকৃত হয়েছে কমলাকাস্তের একটি উৎকৃষ্ট পদে তরু মুঞ্জরে না, শুকায় শাখা ছুড়া আগুন বিগুন আছে।” কবিতার ভাবরূপের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কলাঙ্গিকের দিকে দৃষ্টি করলে দেখা যাবে যে শাক্ত পদাবলির বাকপ্রতিমা রূপসৃষ্টিতে, অলংকার শিক্ষায় ও ছন্দের স্রোতে অপার্থিব সৌন্দর্যমহিমা ব্যঞ্জিত হয়েছে। অলংকরণ ও চিত্রকল্পের বিন্যাসে গীতিকবিতার যে শিল্পরূপ কবিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় শাক্তপদকর্তা অনেকক্ষেত্রেই তার উজ্জ্বল নিদর্শন উপস্থাপিত করেছেন। —

“তুমি মঙ্গলরূপিনী, বিশ্বহিত বিধায়িনী,

যা ভালো হয়, তাই করো মা, তোমার পদে দিলাম ভার।”


পরিশেষে বলা যায়, শাক্তপদাবলিতে একদিকে আধ্যাত্মজগতের সন্ধান ভক্তির আবেগ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অপরদিকে মর্ত্যলোক অভীপ্সা, মানুষের সুখ-দুঃখ, আকুতি মিনতি ইত্যাদি বিচিত্রভাবের উচ্ছ্বাসে সার্থক গীতিকবিতায় পর্যবসিত হয়েছে।