সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক: পদাবলী সাহিত্যে কৃত্রিমতা ও অবক্ষয়

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক: পদাবলী সাহিত্যে কৃত্রিমতা ও অবক্ষয়


অর্থনীতিতে একটি নিয়ম আছে, কোনো বস্তু ব্যক্তি মানুষের সর্বোচ্চ তৃপ্তিসীমাকে স্পর্শ করার পর তার উপযোগিতা ক্রমশ হ্রাস পায়। সাধারণভাবে এই নিয়মটি কোন বিশেষ সাহিত্য শাখার ব্যক্তি বা সমষ্টি মানুষের রসাবেদন সম্পর্কেও হয়ত প্রয়োগ করা যেতে পারে।


বিশ্বসাহিত্য ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আমাদের বলে দেয়, প্রত্যেক সমৃদ্ধ সাহিত্য-শাখা ধারাবাহিক হলেই তার একটি পরিণামী সমাপ্তি আছে। সেই সমাপ্তির বৃত্ত বা পর্ব সম্পূর্ণ হবার আগে থেকেই ধরা যায় তার অন্তঃক্ষয়। দীর্ঘচর্চায় লালিত বিশাল আয়তন বৈষ্ণব পদাবলীও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। ধর্মের ঘরে আবদ্ধ না হলেও তত্ত্বের প্রতি অতি নিষ্ঠা ও আনুগত্য প্রদর্শনে এই যুগে কবি-কল্পনা যেন স্বতঃস্ফূর্ত গতি হারিয়ে ফেলেছিল। ভাব ছিল, কিন্তু ভাবনার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল। এমন কি অনেক সময় হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধিরও যথাযথ সংযোগ ঘটে নি।


যুগধর্মের সঙ্গে শিল্পসাহিত্যের সম্পর্ক সব সময় প্রত্যক্ষ নয়, কখনো কখনো বরং তির্যক। প্রেরণামুখ্য পদাবলী সাহিত্যে সপ্তদশ শতকেও প্রেরণাদাতার অভাব ছিল না। শ্রীনিবাস-নরোত্তম-শ্যামানন্দ নরহরি সরকার বা বীরচন্দ্র-জাহ্নবা দেবী-সীতাদেবী প্রমুখ স্মরণীয় এবং বহুমান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন একাধিক ভক্ত কবির ভক্তিভাবনার ‘কারয়িত্রী’, কিন্তু তাঁদের শিল্পিত-স্বভাব উজ্জীবনের পক্ষে এঁদের পথনির্দেশ কতখানি যথানুপাতী এবং হৃদয়ধার্য ছিল সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে।


আমরা লক্ষ্য করি, এই যুগ যতখানি বিভিন্ন গোষ্ঠীবাদী মতবাদের (খড়দহ, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ড ইত্যাদি সম্প্রদায়) ততখানি, সৃষ্টিস্বাদের নয়। উৎসব-কীর্তন এবং ঐশ্বর্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষ্ণবধর্ম এই যুগে বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে, বিশেষত বিত্তবান সমাজের সঙ্গলাভে হয়েছিল শক্তিশালী। সেইজন্য নানামুখী সম্প্রদায়ের তরঙ্গে আত্মবৃত্ত শান্ত চিত্তে পদ রচনার মগ্নমুহূর্ত যেন শিল্পী জীবনে আর খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশ্য শান্তিপূর্ণ আবহমণ্ডল মাত্রেই যে কাব্যসাধনার অনুকূল অথবা বিপরীতভাবে উত্তেজনা সংঘাতময় পরিবেশে সাহিত্যচর্চা যে একবারেই অসম্ভব তা হয়ত নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর জাপানী নো-নাট্যগুচ্ছ এবং কাবুকি নাটকগুলির বিষয়ের সঙ্গে সমকালীন সময় পরিবেশের বৈপরীত্য স্মরণীয়। তবু সংঘাত যেখানে কবির আশ্রেয় ধর্মের সঙ্গে জড়িত, সেখানে সেই বিপন্ন ধর্ম থেকে প্রেরণা-সন্ধান রীতিমত কষ্টসাধ্য।


দ্বিতীয়ত, ষোড়শ শতকের কবিরা প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যের মধ্যবর্তিতায় ভক্তি এবং মানবিকতার উষ্ণ আবেগের আবহে কাব্য রচনার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী শতকের কবিদের তাঁর তিরোভাবের মহাশূন্যতায় সেই ভারসাম্য আর ছিল না। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্য যদি হন বৈষ্ণবধর্ম এবং পদাবলীর প্রাণপুরুষ বা মেরুদণ্ড স্বরূপ, তবে তাঁর তিরোভাবে ভাবসর্বস্ব পদাবলী হয়ে পড়েছিল অচৈতন্যপ্রায়।


আঙ্গিক সচেতনতা, পালাকীর্তন এবং পদসঙ্কলন সৃষ্টি: সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বৈষ্ণব কবিরা উৎকর্ষ ও নিষ্ঠার ঐকান্তিকতায় পূর্ববর্তী শতকের তুলনায় স্নান ও শূন্যগর্ভ। তবু একথা ঠিক, মৌলিক চিন্তায় ও কল্পনায় নিঃস্ব হলেও অন্তত আঙ্গিক ও কাব্যপ্রকরণ ভাবনায় এই দুই দশকের কবিরা নিরীক্ষাভীরু ছিলেন না। যেমন চন্দ্রশেখর নামে এক কবি শ্রীরাধার অবৈধ প্রেমের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন। দীনবন্ধু দাস গোষ্ঠলীলা বর্ণনায় শৃঙ্গার রস এনে সুবলের ছদ্মবেশে রাধাকে পাঠিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছিলেন। অবশ্য পদাবলীর তত্ত্বগাম্ভীর্য ও শুদ্ধ সৌন্দর্যের বিচারে এ চিত্র হয়ত শোভন ও সার্থক হয়নি।


এই যুগের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য হল: (১) সঙ্গীতের সঙ্গে পদাবলীর অপরিহার্য সংযোগ সাধন। খেতুড়ীর মহোৎসবে অনুষ্ঠিত মান্দারিণী, গরাণহাটী, রেনেটি, মনোহরশাহী ইত্যাদি চতুরঙ্গ কীর্তন রীতির মাধ্যমে পদাবলী গান পরিবেশিত হয়। (২) পদাবলী কাব্যধারাকে সঞ্জীবিত রাখার জন্য সঙ্কলন গ্রন্থসমূহ সৃষ্ট হয়, যথা—বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষণদাগীতচিত্তামণি’, রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদামৃতসমুদ্র’, দীনবন্ধু দাসের ‘সঙ্কীর্ত্তনামৃত’, নরহরি চক্রবর্তীর ‘গীতচন্দ্রোদয়’, সুন্দর দাসের ‘কীর্ত্তনানন্দ’, বৈষ্ণবদাসের ‘পদকল্পতরু', ‘পদাবলীসংগ্রহ’ ইত্যাদি। অষ্টাদশ শতকের পদাবলী সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল ‘পালাকীর্তন’ রচনা এবং ‘পদসঙ্কলন’ গ্রন্থ সৃষ্টি।


প্রতিভার অভাব: পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণের প্রধান রস-পর্যায়গুলি বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস-জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাস প্রমুখ পূর্বজ কবিদের অসামান্য শক্তিতে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাধাকৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত যাবতীয় অনুভূতির প্রকাশ মাধুর্যে তাঁদের পদগুলি বাণী এবং রসসিদ্ধিতে প্রায় সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল। তাছাড়া পদ রচনার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় তাদের বিশাল সংখ্যাধিক্য (গোবিন্দদাসেরই পদসংখ্যা প্রায় আটশ)। সুতরাং, সচেতন বা অচেতনে কোনোভাবেই সেইসব পদের ‘ধার’ এবং ‘ভার’ এড়িয়ে মৌলিক চিন্তার উপস্থাপনা এই যুগের পদাবলীকারের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পদকর্তার সংখ্যা এযুগে আদৌ স্বল্প নয়। কিন্তু কাব্যমূল্য বিচারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অধিকাংশ পদেরই বক্তব্য বলা চলে ‘ইত্যাদি’ পর্যায়ভুক্ত। তাই কুমুদানন্দ, নরসিংহ দাস (কবিরাজ), শ্যামদাস কবিরাজ, বলরাম দাস, ঘনশ্যাম দাস, যদুনন্দন দাস প্রমুখ অসংখ্য কবি-রচিত পদে অধিকাংশতই যেন শুধু কণ্ঠস্বর আছে, কিন্তু কবি নেই, ব্যক্তি নেই। এর কারণ সম্ভবত, দীর্ঘচর্চার দ্বারা অভ্যস্ত এবং নিয়ম-নির্মিত বিবিধ পালা-বিন্যাসের বিধিবদ্ধতায় গড়া পদাবলী সাহিত্যকে পুনর্নব করে তোলা, অর্থাৎ স্বয়ংশুদ্ধ সত্তার দ্বারা দ্বিতীয় কোনো 'দিব্যজীবন’ থেকে উপাদান আহরণ করা কবিদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। তাদের তাই গোষ্ঠী আনুগত্যে লক্ষ্য ছিল, মূলতঃ বৈষ্ণব পদাবলীর বিশাল আয়তন এবং বিশেষ আঙ্গিকটির সম্পূর্ণতা দান।


আলঙ্কারিক কৃত্রিমতা : কাব্যধারার বিকাশের মূলে একটি অন্যতম শর্ত—কবি হৃদয়ের স্বাভাবিক আবেগ বা স্বতঃস্ফূর্তি প্রয়োজন। গভীরতম নিষ্ঠায় সেই আবেগের শিল্পিত রূপদান কাম্য। আশ্চর্যভাবে আমরা লক্ষ্য করি, ধর্মভাব্য হয়েও ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবির ছিল অসাধারণ শিল্পনিষ্ঠা, ধর্মেরও যেন কবিতার হাতে নিজেকে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করা। তাই দেখতে পাই, প্রাচীন সাহিত্য বা অলঙ্কার শাস্ত্রের যা কিছু চিরন্তন, সেই ঝর্ণাধারা থেকে আপন আপন হৃদয়ের চাহিদা অনুযায়ী কাব্যপাত্রকে ভরে তোলার জন্য জ্ঞানদাস গোবিন্দদাস প্রমুখ কবিরা ছিলেন উৎসুক। কিন্তু বিপরীতভাবে সপ্তদশ শতকে শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ দাস গোস্বামীর কাব্য-নাটক অলঙ্কার শাস্ত্রের যেন বড় বেশি বাধ্য অনুকরণ কবিদের মধ্যে দেখা যায়। যেমন, রূপ গোস্বামীর “তুণ্ডে তাণ্ডবিনী রতিং বিতনুতে তুণ্ডাবলীবদ্ধয়ে” ইত্যাদি শ্লোকের অনুসরণে যদুনন্দন লিখেছেন— “মুখে লৈতে কৃষ্ণনাম নাচে তুণ্ড অবিরাম আরতি বারয়ে অতিশয়” ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, নিছক ধর্মাচারগত প্রথাপালন এবং চিত্তমুগ্ধ আলঙ্কারিক কৃত্রিমতায় ছিল এযুগের কবিদের পদরচনা। সময়কে সৃষ্টি না করে সময়ের সেবা করার দিকেই যেন তাঁদের ঝোঁক বেশি ছিল। সাহিত্যচর্চায় অনুকরণ নিন্দনীয় নয়, বরং কোনো কোনো সময়ে হয়ত অনিবার্য। কিন্তু পার্থক্য হল, "Immature poets imitate mature poets steal, bad poets deface what they take and good poet make it better or at least something different". (T.S. Eliot) শ্রীনিবাসের কনিষ্ঠপুত্র গীতগোবিন্দকে ঘনশ্যামদাস গোবিন্দ-রতি-মঙ্গলাচরণে “গান্ধবীয় কলা-বিন্যাস-রসিকো গান প্রধান স্বয়ং” বলে প্রমাণ করেছেন। ষোড়শ শতকের শেষপাদে সমষ্টিগত জীবনের ভাবধারার মধ্যে আলঙ্করিক কৃত্রিমতা প্রবেশ করে। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের পদাবলীতে তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।


অনুকরণ-আসক্তি : সপ্তদশ শতকের বৈষ্ণব কবিরা প্রায় সকলেই পূর্ব কবিদের বাধ্য অনুবাদক, বিশেষতঃ গোবিন্দদাসের। বলরাম দাস তার নায়িকার পূর্বরাগের বর্ণনায় যখন বলেন—“শুনইতে কানহি আনহি শুনত বুঝাইতে বুঝই আন” তখন সচেতন পদাবলী পাঠক অনুভব করতে পারেন গোবিন্দদাসের ভাব-ভাষা-ভঙ্গীর অবিকল অনুকরণ। অভিসারিকা রাধার “আন শুনই কহ আন” পদের সঙ্গে চিত্রসাদৃশ্য। শক্তিশালী কবি দীর্ঘজীবী হলেই অনতি-উত্তর কবিরা হন তাঁর অনুকরণকারী। (স্মরণীয়, রবীন্দ্রানুসারী কবিদের উপর রবীন্দ্র-প্রভাব)। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত গোবিন্দদাসের স্বয়ং উপস্থিতি এবং কাব্য প্রভাব হল সেই কারণ। অর্থাৎ তাদের পক্ষে অনিবার্য ছিল (বিশেষত তিরোভাবের পর) গোবিন্দদাসের অনুকরণ। এঁরা বুঝেও বোঝেননি তাঁর প্রত্যেকটি শব্দের পিছনে একান্ত নিষ্ঠায় গড়া যে আবেগের চাপ এবং বিশ্বাসের উত্তাপ আছে, আছে প্রাণবস্ত প্রবলতা—তাকে আত্মস্থ করার জন্য অনুরূপ কোনো ধ্রুপদী চেতনার প্রয়োজন, একালের সমালোচকের ভাষায় যাকে ব্যাখ্যা করা যায় the name is graven on the workmanship'। সেইজন্য স্বভাবতই দেখা যায় তাদের অনুকরণ অনেকক্ষেত্রে 'deface what they take'। যেমন গোবিন্দদাসের গোবিন্দ যেখানে খণ্ডিতা রাধার দৃষ্টিতে ধৃষ্ঠ হয়েও বিদগ্ধরাজ, সেখানে তাঁর ভাগ্নে বলরাম দাসের নায়িকার কাছে নাগর-কৃষ্ণের শুধুই মত্ততা দর্শনীয়

“ঢুলি ঢুলি চলত খলত পুন উঠত

আয়ত ইহ মঝু কান্ত।”


বলা বাহুল্য, এধরনের অপদৃষ্টি ধর্ম বা কাব্য কোনো কিছুর উন্নতির পক্ষেই শোভন নয়। তাই মনে হয়, এই সময় থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর অবক্ষয় শুরু হয়েছিল।