বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে অভিসার পদ রচনার বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও।

‘অভিসার’ কথাটির সাধারণ অর্থ প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক অনুরাগ হেতু সংকেত স্থানে গমন। প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়ের পক্ষেই অভিসার সম্ভব। তবে বৈষ্ণব পদাবলীতে নায়িকার অভিসার বর্ণনায় গুরুত্ব স্থাপন করা হয়েছে বেশী। যে নায়িকা নিজে অভিসার করে বা কান্তকে অভিসার করায় তাকেই অভিসারিকা বলা হয়। বৈষ্ণব পদাবীলতে রাধাই একমাত্র অভিসারিকা।


বৈষ্ণবশাস্ত্রে ও পদাবলীতে অভিসারের একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ভক্তের চোখে কৃষ্ণ ভগবান। ভক্ত ভগবানের দিকে নিত্য অভিসারী। পথে কত বাধা বিঘ্ন, সমাজের ভয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লোকের গঞ্জনা— সবকিছু তুচ্ছ করে ভগবানের উদ্দেশে অভিসারে যেতে হয় মিলনের জন্য। রাধার অভিসার আসলে ভক্তের ঈশ্বরমুখীনতার নামান্তর। পথের দুঃখ কষ্ট সাধন তপস্যার ইঙ্গিত বলে পরিগণিত হয়। এই অভিসারের নানা পর্যায়: জ্যোৎস্নাভিসার, তমসাভিসার, কুজ্ঝটিকাভিসার, তীথাভিসার, উন্মাত্তভিসার, বর্ষাভিসার, অসমঞ্জস্যভিসার। বৈষ্ণব কবিগণের কাব্যে এই সকল অভিসারের পদ পাওয়া যায়।


বিদ্যাপতি রাধার অভিসারের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। রাধার অভিসারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত তাঁর পদে। প্রথমে তিনি রাধাকে ভয়চকিত বালিকা হিসাবে চিত্রিত করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে অধিকতর সাহসিকা। তৃতীয় পর্যায়ে রাধা হৃদয়ের প্রেরণায় অভিসারে গমন করেছেন কৃষ্ণের উদ্দেশে—

“তুঅ অনুরাগ   মধুর মদে মাতলি 

কিছু না শুনল বরনারী।”


বাঙালী-কবি গোবিন্দদাস অভিসারের পদে বিদ্যাপতির সমান কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বস্তুত বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে অভিসারের পদ রচনায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনস্বীকৃত। গোবিন্দদাস অভিসারিকা রাধার অপূর্ব ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছেন। রাধা কৃষ্ণপদে নিবেদিতা। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য তাঁর দেহ মন ব্যাকুল। তাই সমাজ সংসার প্রাণ—সবকিছু তুচ্ছ করে তিনি অভিসার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে গভীর অন্ধকারে তাঁকে পথ চলতে হবে। পথে পায়ে কাঁটা ফুটতে পারে, সাপ কামড়াতে পারে, তাই তিনি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন—

কণ্টক গাড়ি   কমলসম পদতল

মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

গাগরি বারি   ঢারি করি পিছল

চল তহি অঙ্গুলি চাপি ।।


অন্ধকার রাত্রে পথ চলতে হবে। তাই রাধা করযুগে চক্ষু আবৃত ক'রে পথ চলার অভ্যাস করছেন। সাপুড়ের কাছ থেকে সাপের মুখবন্ধন শিক্ষা করছেন—

কর কঙ্কণ পণ    ফণী মুখবন্ধন

শিখই ভুজগগুরু পাশে।


অভিসার যাত্রার এই প্রস্তুতির জন্য গুরুজনরা নানা কথা বলেন। কিন্তু রাধার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। কৃষ্ণকে তিনি হৃদয় উজাড় ক'রে ভালবেসেছেন। কৃষ্ণ তার হৃদয় জুড়ে বিরাজ করছেন। তাই কোনও কথা তাকে স্পর্শ করতে পারে না।


গুরুজন বচন   বধির সম মানই

আন শুনই কহ আন।

পরিজন বচনে    মুগধী সম হাসই

গোবিন্দদাস পরমাণ।।

রাধার এই অভিসার যাত্রা কত যে বিপদসঙ্কুল, গোবিন্দদাস তা অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে, দশদিকে বিদ্যুতের ঝলক। তাতে জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে—

ইথে যদি সুন্দরী তেজবি গেহ। 

প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।


এই দুর্যোগের মধ্যে প্রচণ্ড বিপদ মাথায় নিয়ে রাধা কেমন ক'রে যে তাঁর দয়িতের কাছে পৌঁছবেন তার সম্পর্কে কবি নিজেই প্রশ্ন করেছেন—

সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার। 

হরি রহ মানস সুরধুনি পার।।


কিন্তু ভগবান যেখানে ভগবানের সঙ্গে মিলিত অর্থাৎ আত্মলীন হতে চান সেখানে। কোনও বাধাই তো দুস্তর নয়। প্রাণভয় তো সেখানে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তাই রাধার কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনও বাধাই নয়—

কুল মরিয়াদ    কপাট উদ্‌ঘাটলু

তাহে কি কাঠকি বাধা।

নিজ মরিয়াদ    সিন্ধু মঞে পঙারলু

তাহে কি তটিনী অগাধা।।


এইভাবে রাধার অভিসার গোবিন্দদাসের পদে অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনা লাভ করেছে। গোবিন্দদাস চৈতন্য-পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব সাধনার মূল ধারাটিকে আত্মসাৎ করে রাধার অভিসার বর্ণনা করেছেন। সেখানে একদিকে যেমন কাব্য-চমৎকারিত্ব ও সার্বজনীনতা প্রকাশিত, অন্যদিকে তেমনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্বটিও রক্ষিত।