গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলীর রূপগত ও রসগত পরিবর্তন

গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলীর রূপগত ও রসগত পরিবর্তন


উপনিষদে ত্রিধারা আছে : অস্তি, ভাতি ও প্রেম। সর্বশেষ ধারাটি বৈষ্ণবপদাবলীতে দেখা যায়। ঈশ্বরের প্রেমিক মূর্তি উপনিষদের যুগ থেকে বিবর্তিত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে একটি অভিনব রূপ ধারণ করে। প্রেম ও পূজার সমাহার এই ধর্মের সাহিত্যে লক্ষণীয়। তবু মনে হয়, এই যুগ্ম পটভূমি অনেকদিন ধরেই রচিত হয়ে চলেছিল। বস্তুতঃ, কয়েকজন সাধক-শিল্পীর ধ্যান ধারণা ও সমবায়িক ভাবনার সামগ্রিক অভিঘাতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও পদাবলীতে এই পরিবর্তন সূচিত হয়। একদিকে দাক্ষিণাত্যের আলেয়ার সম্প্রদায়, লীলাশুক, জয়দেব, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ কবির কাব্যধারা চৈতন্যদেবের ধর্ম তথা অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে সহায়তা করে, অন্যদিকে আবার চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিবাদ পদাবলীকে ব্যক্তি-আশ্রয়ী না করে ব্যক্তিভাবনার ঊর্দ্ধায়ন বা Sublimation রচনা করে। ঈশ্বর এখানে যেমন ‘সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাস’ হয়ে উঠেছেন, তেমনি রোমান্টিকতার যাবতীয় উপাদান ও ধর্মাদর্শে মিশ্রিত হয়ে বৈষ্ণব কবিতা মিষ্টিক হয়ে উঠেছে। চতুর্দশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই পদাবলীর ধারা ভাবে ও রূপে নানাভাবে বিবর্তিত হয়ে একটানা প্রবাহিত হয়েছে। এই পরিণতি এবং পরিবর্তনের পর্যায়গুলি আপাততঃ আলোচ্য। মোটামুটিভাবে এই ধারাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়

  • (ক) প্রাক্-চৈতন্য পদাবলী অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস প্রমুখ কবিদের কবিতা-নিদর্শন।
  • (খ) চৈতন্য-সমকালীন পদাবলী অর্থাৎ গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস, বাসু ঘোষ প্রমুখের রচনা দৃষ্টান্ত।
  • (গ) চৈতন্যোত্তর পদাবলী, অর্থাৎ সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের কবি ঘনশ্যাম দাস, মনোহর দাস, চন্দ্রশেখর, দীনবন্ধু দাস প্রমুখ কবিদের কবিতা-উদাহরণ।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে পদাবলী সাহিত্যের নিদর্শনরূপে মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে কিছু পদাবলী ধরনের পদ্যাংশ পাওয়া যায়, পাওয়া যায় মাধবেন্দ্রপুরীর রচনা বলে কথিত কিছু পদ এবং সর্বোপরি বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদাবলী। কৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাব এবং গোপাঙ্গনাদের ভক্তিভাবের ভূমিতে এই শতাব্দীর বৈষ্ণব কবিতা একান্তভাবেই ভূমিলগ্ন। কোনো তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে নয়, রাধার প্রথম যৌবনের প্রকাশ, অবাধ বাসনার উল্লাস, শৈশব স্রোতস্বিনীর সঙ্গে যৌবন-সমুদ্রের দূরাগত সংঘাত সবই দেখানো হয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক মনোভঙ্গীতে। নায়িকা রাধিকা এখানে মানবী গুণসম্পন্না। তাই এই কাব্য-কবিতা অবৈষ্ণব বা অদীক্ষিত পাঠকেরও আস্বাদ্য।


রূপগত পর্যালোচনার সূত্রে বলা যায় অলঙ্কার প্রয়োগ বা মণ্ডনকলায় বিদ্যাপতির দক্ষতা কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কবি-হৃদয়ের ক্রমমুক্তির আগ্রহে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’ নির্দেশিত এগারো মাত্রার 'রসিকা’ ছন্দকে তিনি অনায়াসে বারো মাত্রা পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন এই পদে

“যঁহা যঁহা পদযুগে ধরঈ।

তঁহি তঁহি সরোরুহ ভরঈ ৷৷

যাঁহা যাঁহা ঝলকত অঙ্গ। 

তঁহি তঁহি বিজুরি তরঙ্গ ।।”


স্বরের দীর্ঘায়ন এবং যুগ্মধ্বনির ব্যঞ্জনে অন্ত্যমিলকে পর্যন্ত স্পন্দিত করতে পেরেছেন।

আবার চণ্ডীদাসের কবিতায় কবিচিত্ত পরিবেশের সঙ্গে যেভাবে একাত্ম হয়েছে তার ফলে তাঁকে আপাতসরল মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর কবিতার হৃদয়ভেদী সরলতা ও অনুভূতির সুরধ্বনি সহজ হলেও সরল নয়। তাঁর কবিতায় ব্যালাডের ধর্ম আছে। ‘the poetic art which conceals art'-ও সেখানে লক্ষ্য করা যায়। অনেক কবিতায় নিরভিযোগ সহিষ্ণুতা দেখা যায় (“বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে” ইত্যাদি কবিতা স্মরণীয়) এখানে যেন কবি মনের একটি সজল পিছুটান বেজে উঠেছে। আবার তাঁর “চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ সহিত মোর” অথবা “ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনি অবনী বাহিয়া যায়” যেন Robert Herrick (1591-1674)-এর এই কবিতাংশের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে—

"Whenas in silks my Julia goes, 

Then, then (methinks) how sweetly flows

The liquefaction of her clothes."

Next, when 9 cast mine eyes and see

That brave vibration each way free; 

O how that glittering taketh me!


অ্যাম্বারক্রম্বে এই কবিতাটির সূত্রে মস্তব্য করেছিলেন: “Herrick's Julia becomes everyone's Julia" (The Idea of Great Poetry') চণ্ডীদাসের রাধাও সবার রাধা হয়ে ওঠে। আবেগময় স্বগতোক্তিকে এই কবি সার্বজনীন উত্তরাধিকারে পরিণত করতে পেরেছিলেন।

চৈতন্য সমকালীন ও পরবর্তী যুগে কিন্তু এই উত্তরাধিকার গোষ্ঠীগত হতে চেয়েছিল। কারণ, রাধাকৃষ্ণ সেখানে প্রথমত, ‘আলম্বন’ বিভাব নয়, ‘নিত্যবিভাব' রূপে গণ্য। দ্বিতীয়ত, ‘উজ্জ্বলনীলমণি' ইত্যাদি গ্রন্থাদি অনুযায়ী অপ্রাকৃত, রাধাকৃষ্ণলীলাকে পালা পর্যায়ে রূপ দান করা হয়, তৃতীয়ত, পালা-কীর্তনের পূর্বে লীলাবর্ণনার ভাব অনুযায়ী ‘গৌরচন্দ্রিকা’ পদগানের সৃষ্টি হয়। কীর্তনের মাধ্যমে পদগুলিকে সংহত আকার দান করা হয়। চতুর্থত, বাংলা ও ব্রজবুলি এই উভয় ভাষাতেই পদ রচিত হয়। সর্বশেষে বলা যায়, অবৈষ্ণব অলঙ্কার শাস্ত্র ও পূর্ববর্তী সংস্কৃত কাব্য ঐতিহ্যকে বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শে রূপান্তরিত করা হয়।


রূপগত বিচারে ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ পর্যন্ত বৈষ্ণব পদাবলীকে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় দুটি মিশ্রলীলার ফলশ্রুতি—একটি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক, অন্যটি চৈতন্যলীলা-বিষয়ক। চৈতন্য-বিষয়ক পদগুলির আবার তিন ভাবে স্বপ্রকাশ—চৈতন্য-বন্দনা, চৈতন্যজীবন বিষয়ক বাল্য-যৌবন-সন্ন্যাস বর্ণনা এবং গৌরাঙ্গনাগর-কল্পনামূলক পদাবলী।


ষোড়শ শতক : সুবর্ণযুগ : চৈতন্য-কেন্দ্রিক যুগবিভাগের গুরুত্ব:

পঞ্চদশ শতকের প্রায় শেষ দশকে সুলতান হোসেন শাহের রাজত্বকাল (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীঃ)। এই সময় ভারতীয় ভক্তিধর্মের তথা মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শ্রীচৈতন্যদেব আবির্ভূত (১৮/১৯, ২-১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রীঃ) হন। হোসেন শাহের শাসনকালে দেশে সাধারণভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা ছিল অব্যাহত। বাংলা সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটে। আবার সুলতানী আমল তথা পাঠান শাসনকালের অবসানের রাষ্ট্রশক্তি মুঘল সম্রাট আকবর দখল করেন। ১৬০৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তার সুবেদার মানসিংহ সমগ্র গৌড়বঙ্গে মোটামুটি শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করতে সমর্থ হন। বাঙালীর জীবনচর্যা ও দৃষ্টিভঙ্গীতে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। বাংলা সাহিত্যের অস্ত্য-মধ্য যুগের বা চৈতন্যোত্তর যুগের প্রকাশ (১৫০০-১৮০০ খ্রীঃ) হয়। বস্তুতঃ আদি-মধ্যযুগের (আনু. ১৩৫০ খ্রীঃ) পর অন্ত্য-মধ্যযুগের প্রথম দুই শতক প্রধানতঃ শ্রীচৈতন্যদেবের আলোকসামান্য ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে, যা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজে ‘সুবর্ণযুগ’ রূপে আখ্যাত হয়ে থাকে। বস্তুতঃ, সেই কারণে মধ্য-বাংলার সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ বা যুগগণনার ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেবকে কালস্তম্ভের মতো ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে, যথাক্রমে

  • (ক) আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ (আনু. ১৩৫০-১৫০০ খ্রীঃ)। 
  • (খ) চৈতন্য যুগ (আনু. ১৫০০-১৬০০ খ্রীঃ)।
  • (গ) অস্ত্য মধ্যযুগ বা চৈতন্যোত্তর যুগ (১৬০০-১৮০০ খ্রীঃ)। 

এই চৈতন্য-কেন্দ্ৰিক যুগবিভাগের গুরুত্ব অনুভব করলে বোঝা যায়, ধর্মীয়-সামাজিক সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে তার প্রভাব ও প্রগতিশীল ভূমিকা। সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে; যেমন


(১) মানবিক সম্পর্কের নবমূল্যায়ন :

শ্রীচৈতন্যদের শুধু প্রেমের অবতার বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু নন, মধ্যযুগীয় বাংলা তথা ভারতবর্ষের এক দীপ্তিমান ব্যক্তিত্ব। তাই রঘুনন্দন-শাসিত স্মার্ত পণ্ডিত সমাজ, নবদ্বীপ শাস্তিপুরের ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডল, এমন কি পুরীতে 'পঞ্চশাখা'র উড়িয়া বৈষ্ণবগণের উপর তার ব্যক্তিত্ব ও ভক্তিধর্মের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। বিদগ্ধ সমালোচক জনার্দন চক্রবর্তী একটি লেখায় ব্রজবুলি ভাষা ও শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে চৈতন্য-বাণী কিভাবে তার জন্মভূমির সীমানা ছাড়িয়ে সারা ভারতে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেনঃ "The message of Sri Chaitanya, his new philosophy of life based upon love of God manifesting itself through the love of man was not confined to the land of his birth. It travelled far and wide, traversing an area which comprised Gauda-Vanga, Radha-Kamarupa, Mathura Vrindavana, Utkala-Dravida and Baranasi-Prayag, Chaitannyaism having practically created a greater Bengal"


মধ্যযুগে এই ‘বৃহত্তর বঙ্গের (greater Bengal) বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব ও ভক্তিবাদের সৃষ্টিকর্তা এবং সংস্কর্তা হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্ম, কৃষ্ণ বা বিষ্ণুভজনা ছিল প্রধানত ঐশ্বর্যভাব, দেব-নির্ভর ও অলৌকিকতা আশ্রিত। কিন্তু এই প্রথম‌ সুস্পষ্টভাবে বলা হল

“কৃষ্ণের যতেক লীলা     সর্বোত্তম নরলীলা 

নরবপু তাহার স্বরূপ।”


ফলে ভক্তির মতাদর্শের সঙ্গে ভাগবতপুরাণের কৃষ্ণলীলা মিশ্রিত হলেও তাঁর স্বরূপ প্রকাশ ও অভিব্যক্তি মানব সম্পর্কের আধারে ধরা দিল বিশেষভাবে। সমগ্র বঙ্গে ও অন্যত্র বৈষ্ণবেরা তত্ত্ব এবং উপাসনা পদ্ধতির মধ্যে সখা, পুত্র, পিতা বা প্রভু, প্রেমিক রূপে তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করলেন। মানবজীবনের মাধ্যমে দিব্যজীবনের এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে ড. সুশীলকুমার দে তাঁর গ্রন্থে বলেছেন - "Bengal Vaisnavism seeks to realize in its theory and practice, what is supposed to be the actual passion of the deity as a friend, son, father or master but chiefly and essentially as a lover"


অন্যদিকে শ্রীচৈতন্যের মানবিক আচরণ বর্ণনা করেছেন ঐতিহাসিক ড. রমাকান্ত চক্রবর্তী : “চৈতন্য “মুখ-শিট্‌কান বিকট মূরতি' ছিলেন না। চৈতন্যের ভক্তির উদ্দেশ্য ছিল মানবজীবনকে সমৃদ্ধ এবং অর্থপূর্ণ করে তোলা; জীবনকে অস্বীকার করা তাঁর আদর্শ ছিল না। সংখ্যাতীত ভক্তদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন; তাঁদের সঙ্গে নিয়ে তিনি কীর্তনে যোগ দিয়েছেন, নৃত্য করেছেন। যবন হরিদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরতে তাঁর বাঁধেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর সামাজিকতা ও রসবোধ অক্ষুণ্ণ ছিল। মানুষকে তিনি ভুলে যাননি ...সর্বদাই তিনি ঈশ্বর হয়ে থাকেননি” তাঁর মতে, “আমাদের দেশে চৈতন্যই ছিলেন প্রথম ‘সামাজিক’ সন্ন্যাসী”

এই মানবিক সম্পর্কের তথা মানবতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথম সুস্পষ্টভাবে বলা হল “কৃষ্ণভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার”। চৈতন্যজীবনীকারেরা অনেকেই বলেছেন, “তার আবির্ভাবের একটি সামাজিক কারণ ছিল।... হিন্দু সদাচার তান্ত্রিক কৌলাচারের অভিঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। হিন্দু সমাজের নৈতিক বাঁধন যতই দুর্বল হয়ে পড়ে, ততই নব্যস্মৃতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ...স্মার্ত কর্মকাণ্ড এবং সুলতানের স্বৈরাচারী শাসন একে অপরের পরিপূরক ছিল বলে মনে হয়”।


বস্তুত, বর্ণভেদের বৈষম্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বর্ণ ও জাতি-ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতা, হিন্দু ও মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থপরতা এবং ঐহিকতা, নব্যন্যায়-চর্চার শুষ্কতা ইত্যাদির মধ্যে বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশে এক মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়। সেই সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য ক্ষুব্ধ, উন্মত্ত অদ্বৈত আচার্য শ্রীচৈতন্য আবির্ভাবের কথা ইঙ্গিতে প্রচার করেন

“শুন শ্রীনিবাস গঙ্গাদাস শুক্লাম্বর। 

করাইব কৃষ্ণ সর্ব নয়নগোচর । 

সবা উদ্ধারিবে কৃষ্ণ আপনে আসিয়া। 

বুঝাইব কৃষ্ণভক্তি তোমা সবা লৈয়া ॥”


আধ্যাত্মিক প্রয়োজনসহ এটাই ছিল, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের সামাজিক কারণ। বস্তুত, রঘুনন্দন-শাসিত বঙ্গদেশে তিনি যেন অলক্ষ্যভাবে ভক্তিবাদের ভিত্তিতে এক নতুন সামাজিক বিধান প্রতিষ্ঠা করলেন

“চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বলে। 

বিপ্র নহে বিপ্র যদি অন্যপথে চলে !”

অথবা,

“দরিদ্র অধমে যদি লয় কৃষ্ণ নাম।

সর্বদোষ থাকিলেও যায় কৃষ্ণধাম ॥


(২) বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্বরূপ বা রসভাষ্য :

ষোড়শ শতকের পূর্ব থেকে বৈষ্ণব পদ রচনা শুরু হয়েছিল। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ কবিরা ছিলেন এর সার্থক‌ রূপকার। তবু তা ছিল তত্ত্ব-বহির্ভূত। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের প্রেরণায় বৈষ্ণব ধর্মকে তত্ত্ব ও দর্শনের ভিত্তিভূমিতে স্থাপন করেছিলেন বৃন্দাবনের জ্ঞানী গোস্বামীগণ। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত মতবাদের নাম— ‘অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ’। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ সম্পর্ক বিদ্যমান। অবশ্য যুগপৎ ভেদ ও অভেদ সম্পর্ক‌ সাধারণভাবে অচিন্ত্যনীয়। তাই তত্ত্বটির নাম হয়েছে অচিন্ত্যভেদাভেদ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অপ্রাকৃত বৃন্দাবনে রাধা ও কৃষ্ণ নিত্যমিলনে আবদ্ধ। সেইজন্যে, তাঁরা অভেদপ্রাপ্ত। কিন্তু প্রকটলীলায় তাঁরা ভেদপ্রাপ্ত হয়েছেন। স্বরূপেতে অভেদে যাঁরা আবদ্ধ, বাইরে তাঁরা ভেদে স্বতন্ত্র। “চৈতন্যচরিতামৃতে’র আদিলীলার ৪র্থ পরিচ্ছেদে আছে—

“রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান। 

দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্রপরমান ॥”


স্বরূপ দামোদরের মতে, রাধা হলেন কৃষ্ণের প্রণয়বিকৃতি স্বরূপ, তার হ্লাদিনী শক্তি। এই কারণে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম। কিন্তু লীলার জন্য তারা দেহভেদ প্রাপ্ত হয়েছেন। কলিযুগে তারা আবার এক হয়ে ‘রাধাভাবদ্যুতিসুবলিততনু' শ্রীচৈতন্যের রূপ প্রাপ্ত হয়েছেন। এইভাবে বৈষ্ণব পদাবলী একদিকে হয়েছে বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য, তত্ত্বকথা রসরূপ লাভ করেছে। অন্যদিকে পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বরূপের সঙ্গে গৌরাঙ্গ তত্ত্বরূপকেও কবিরা প্রকাশ করেছেন। ফলে 'গৌরচন্দ্রিকা' পর্যায় ও অজস্র গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ এই যুগে সৃষ্টি হয়েছে। আবার রাধাকৃষ্ণের পালাকীর্তনের পূর্বে ‘তদুচিত’ভাবে শ্রোতার চিত্তকে উদ্বুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করে তোলার জন্য ‘গৌরচন্দ্রিকা' গান গাওয়ার রীতি প্রবর্তিত হয়। শ্রীরূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ নামক রসশাস্ত্রে বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস, চৌষট্টি প্রকার লীলা রস, অষ্টনায়িকা, শৃঙ্গাররসের নানা বৈচিত্র্য, সম্ভোগ বিপ্রলম্ভের প্রকারভেদ প্রভৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। চৈতন্যচরিতামৃতে গৌরতত্ত্ব, সখীতত্ত্ব বা মঞ্জরীভাবের সাধ্যসাধন, অচিন্ত্যভেদাভেদ প্রভৃতি বিশদ আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা হয়। ব্যক্তিগত রসচেতনা অপেক্ষা সম্প্রদায়গত তত্ত্বচেতনাই পদকর্তা মহাজনদের কাব্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে পদকর্তারা এই তত্ত্বকে পদের মধ্যে প্রকাশ করতে উদ্যোগী হন। তারা হয়ে ওঠেন দীক্ষিত বৈষ্ণব কবি, ‘মহাজন’ আখ্যা পান। তারা বিভিন্ন রসপর্যায় অনুসারে পদ রচনা করেন। শান্ত রসাশ্রিত প্রার্থনা-বিষয়ক পদ, দাস্য রসাশ্রিত ভক্তিমূলক পদ, গোষ্ঠলীলা-নির্ভর সখ্য ও বাৎসল্য রসের পদ এই যুগেই সৃষ্ট হয়। শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলাকে কাব্যের বিষয় করে নতুন ধরনের পদ রচিত হয়। জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বল্লভ দাস, রায়শেখর, বাণীশেখর প্রমুখ পদকর্তারা বাংলা ও ব্রজবুলিতে ছন্দ ও অলঙ্কারের মণ্ডনশিল্পে সাজিয়ে অসংখ্য উৎকৃষ্ট বৈষ্ণব পদ রচনা করেন। পদগুলি হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্যস্বরূপ। বৈষ্ণব পদাবলীর ভাবগত ও আঙ্গিকগত পরিবর্তন সাধিত হয়। উচ্চতম কবিত্ব ও শিল্পরূপের স্বর্ণপ্রভায় এই যুগের সাহিত্যাকাশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ফলে বৈষ্ণব পদসাহিত্যে স্বর্ণযুগের সৃষ্টি হয়।


(৩) চরিতসাহিত্য সৃষ্টি এবং বিভিন্ন বৈষ্ণব শাখার উদ্ভব:

শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যশাখায় এক নতুন শাখা ‘চরিতসাহিত্য’ সৃষ্টি হয়। মহাপ্রভুর অপ্রাকৃত এবং মানবজীবনের পরিচয় প্রকাশ পায় বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ (আনু. ১৫৪৬-১৫৫০ খ্রীঃ), লোচনদাসের 'চৈতন্যমঙ্গল’ (আনু. ১৫৬৬ খ্রীঃ), জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ (আনু. ১৫৬০ খ্রীঃ), কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত' (আনু. ১৬১৫ খ্রীঃ) গোবিন্দদাসের কড়চা প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহ। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের অনুচর পরিচরবর্গ ও গুরু-মোহান্তদের জীবনীরচনার মাধ্যমে এই শাখাটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। চৈতন্যদেবের তিরোধানের অব্যবহিত পরে কিছুকালের জন্য বৈষ্ণব আন্দোলন স্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু ষোড়শ শতকের শেষভাগে নতুন ভাবের জোয়ার আসে বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর (শ্রীরূপ, সনাতন, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট) পরিচালনায়। এঁদেরই শিষ্য বা প্রশিষ্যবর্গ হলেন শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম ঠাকুর, শ্যামানন্দ, বীরচন্দ্র, জাহ্নবা দেবী, সীতা দেবী প্রমুখ। এঁরা খড়দহ, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ডে নতুন বৈষ্ণব শাখা গড়ে তোলেন। এইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বৈষ্ণবধর্ম বাংলাদেশে প্রবল শক্তিরূপে দেখা দেয়। এর প্রভাবে রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বকে অবলম্বন করে এক বিশিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হয়।


(৪) মঙ্গলকাব্য-অনুবাদ কাব্যের মধ্যে ভাবগত পরিবর্তন:

শ্রীচৈতন্যের ব্যক্তিত্ব ও প্রেমধর্মের প্রভাবে বাংলা মহাকাব্য এবং অনুবাদ কাব্যধারার মধ্যে আঙ্গিক ও ভাবগত দিক থেকে কিছু পরিবর্তন ঘটে। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে ‘দেবদেবীর বন্দনা’ অংশে শ্রীচৈতন্যের বন্দনা করা হয়। কবির ধর্মমত বা ধর্মবিশ্বাসের উল্লেখসহ বংশপরিচয়, গ্রন্থোৎপত্তি বা কবির আত্মপরিচয়ের সূত্রপাত মোটামুটিভাবে এই সময়েই (আনু. ১৫ ১৬ শতাব্দীর মধ্যে) হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ অনুবাদে এর অনতি-পূর্বরূপ এবং মুকুন্দরামের ‘অভয়ামঙ্গলে' তার সার্থক প্রকাশ চোখে পড়ে।


ভাবগত দিক থেকে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নানা রূপে; যেমন প্রথমেই চোখে পড়ে বন্দনা-অংশে বিভিন্ন দেব-দেবীর সহাবস্থান। তাঁদের মধ্যে শক্তিলাভের প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু বন্দনা অংশে দেখা গেল সমাজে সকলের শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব জীবনযাপনের মত মনসার কাহিনী বর্ণনায় চণ্ডীর বন্দনা, ধর্মের প্রতাপ প্রচার করতে গিয়ে শিবের ধ্যান, দ্বৈতলীলা বর্ণনায় অদ্বৈতের ইঙ্গিত, এমন কি হিন্দু ও ইসলামী কাব্যগুলির মধ্যে আল্লা ও ব্রহ্মের একত্র সহাবস্থান ঘটেছে।


প্রাক্ চৈতন্য যুগের মঙ্গলকাব্যে দেবদেবীর আচরণ ও স্বভাব ছিল নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ। বিজয়গুপ্ত, নারায়ণদেব প্রমুখ কবিদের কাব্যে মনসা মমতাহীনা প্রতিহিংসাময়ী ভয়ঙ্করী দেবী। চাঁদ সদাগরও অনমনীয় ও হিংস্র। বিজয়গুপ্তের কাব্যে আছে মনসা ও চণ্ডীর কুৎসিৎ কলহ-বর্ণনা, মনসার জন্মকথায় আছে কামাতুর শিবের পরিচয় ইত্যাদি। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে মানবিক অনুভূতি, অহিংস ঔদার্য, প্রেমের গৌরব বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়। ভাষা ও ছন্দের ক্ষেত্রে শিল্পগুণ প্রাধান্য পায়। সেইজন্য দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমুখের মনসামঙ্গল কাব্যে অনুগ্র মানবিকতা, সুশালীন আচরণ, ত্যাগ ও ক্ষমার মনোভাব চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।


কাব্যের আঙ্গিক প্রকরণে ভাষা ও ছন্দ প্রয়োগে অনেক সময় পদাবলীর প্রভাব লক্ষিত হয়; যেমন কেতকাদাসের কাব্যে একাবলী ছন্দে বেহুলার বিলাপের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর ‘মাথুর’ গানের ঝংকার শোনা যায়—“পতিহীন যেই জীবে। করে করি বিষ পিয়ে। ধরণ না যায় ছাতি। উঠ উঠ প্রাণ পতি।” এইভাবে একাধিক দৃষ্টান্তসহ দেখানো যেতে পারে যে কিভাবে চৈতন্য-প্রবর্তিত প্রেমধর্মের প্রভাবে মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে দেব ও মানবচরিত্র রূপায়ণে উন্নত নীতিজ্ঞান, শালীনতা এবং শিল্পসুষমা দেখা দিয়েছিল। তন্ত্রবিভূতি, জীবন মৈত্র, জগজীবন ঘোষাল, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমুখ কবিরা কাহিনীর পরিণামে করুণরসের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে অনুবাদ সাহিত্যে কাশীরাম দাসের মতো কবিরা হরিভক্তির জয়গান করেছেন। ফলে ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যের প্রভাবেই মঙ্গলকাব্য এবং অনুবাদকাব্যে কাহিনী ও চরিত্রের ভাব ও আচরণে মানবিকতার আবেগ এবং রূপরচনায় শিল্পসৌষ্ঠব ফুটে উঠেছিল। আর এইসব কারণেই ষোড়শ শতককে 'বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণযুগ' আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।


(৫) 'গৌরচন্দ্রিকা’ পদ এবং ভণিতা অংশের গুরুত্ব লাভ:

মহাপ্রভুর আবেগ-আর্তির মধ্য দিয়ে 'মহাভাব স্বরূপিণী' শ্রীরাধার ভাবরূপকে বোঝবার জন্য, রাধাকৃষ্ণের সম্মিলিত অবতাররূপে শ্রীচৈতন্যকে বোঝাবার জন্য দেখা দেয় বিশেষ বিশেষ পালা-কীর্তনের পূর্বে ‘তদুচিত শ্রীগৌরচন্দ্র' গীতি রীতি; যেমন রাধার অভিসার বর্ণনার পূর্বে,

“ব্রজ অভিসারিণী

ভাব বিভাসিত

নবদ্বীপ চাঁদ বিভোর”

কিম্বা, দানী গৌরাঙ্গের বর্ণনা- “দান দেহ বলি ডাকে গোরা দ্বিজমণি” ইত্যাদি।


এই গীতি বা কীর্তনের ফলে (মান্দারিণী, রেনেটি, মনোহরশাহী, গরাণহাটি এই চতুরঙ্গ রীতি) কবিতার সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লহর, মাতন, মূৰ্চ্ছনার আবেগ বা আখরের বিস্তার অনুযায়ী কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, দেখা দেয় বৈষ্ণব গীতি কবিতায় ভাবপ্রকাশের ব্যক্তি-অনুভবে স্বাধীনতার অবকাশ। '‘ভক্তিরত্নাকরে’ বলা হয়েছেঃ “আভোগেতে কবি নায়কের নাম হয়”


কবির নাম গানের সর্বশেষ অংশে অর্থাৎ 'আভোগে’ প্রদত্ত হয়। এই অংশটি ‘ভণিতা’ নামেই প্রসিদ্ধ। কবিদের ব্যক্তিস্বভাবের অভিজ্ঞতা ও উপাদান এখানে গভীরভাবে ব্যবহৃত হয়। বলা বাহুল্য, এই ব্যক্তিস্বভাব ভক্তিযুক্ত, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের তত্ত্বাদর্শের অনুগত “চলইতে দীগভরম জনি হোয়। গোবিন্দদাস সঙ্গে চলু গোয় ।” আবার ব্যক্তিহৃদয়ের অনুভূতি এই ধর্মে মাঝে মাঝে তত্ত্বচেতনার ঊর্ধ্বে বড় হয়ে উঠতে পেরেছে ব’লেই ঐ একই পদকর্তা বলতে পেরেছেন : “মম হৃদয়-বৃন্দাবনে কানু ঘুমাওল/প্রেমপ্রহরী রহু জাগি।” কবীরের কথাতেও আছে এই ব্যাখ্যা “এহ তো ঘর হৈ প্ৰেমকা। যব শোয়ো তব্‌ দুইজনা যব জাগে তব্‌ এক ॥”


(৬) ব্রজবুলির ব্যবহার :

পদাবলীর মাধ্যম ব্রজবুলিও এই কালের অন্যতম সৃষ্টি। একথা ঠিক, চৈতন্যদেব ও তাঁকে আশ্রয় করে কেন্দ্রীভূত হয় পদাবলী-সাহিত্য, পদাবলীর রাধাকৃষ্ণ কথা গড়ে ওঠার আগে উমাপতি উপাধ্যায়, বিদ্যাপতি, যশোরাজ খান হয়ত এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার সঙ্কেত দিয়ে গিয়েছিলেন, তবু মহাপ্রভু ও ষড় গোস্বামীর প্রচেষ্টায় নিখিল ভারতীয় প্রাণচেতনার সংযোগের জন্যেই এই ভাষা পদাবলীতে সার্থক পরিণতি লাভ করেছিল।


সপ্তদশ শতক: সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদসাহিত্যের কোন অভিনব উৎকর্ষ দেখা যায় নি। এই যুগকে ‘অনুবাদ ও আলঙ্করিক কৃতিত্বে’র যুগ বলা হয়ে থাকে। পূর্বযুগের গৌরব আঁকড়ে ধরে কবিরা রসচর্চা করেছিলেন, অনুবাদ বা সঙ্কলনগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেমন : বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষণদাগীতচিত্তামণি’, রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদামৃতসমুদ্র’, দীনবন্ধু দাসের ‘সঙ্কীর্ত্তনামৃত’, নরহরি চক্রবর্তীর ‘গীতচন্দ্রোদয়’, সুন্দরদাসের ‘কীর্ত্তনানন্দ’, বৈষ্ণবদাসের ‘পদকল্পতরু’, ‘পদাবলী সংগ্রহ' ইত্যাদি।


রসের দিক দিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলীর পরিবর্তন সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা পূর্ব চৈতন্যযুগে ছিল শুধু শৃঙ্গার রসাত্মক কাব্যমাত্র। কিন্তু চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে বৈষ্ণব পদাবলীতে পঞ্চরস অর্থাৎ, শান্ত রসাশ্রিত প্রার্থনা পদ, দাস্য রসাশ্রিত ভক্তিমূলক পদ, সখ্য ও বাৎসল্য রসাশ্রিত গোষ্ঠ ও বাল্যলীলার পদ এবং মধুর রসাশ্রিত বহু পদ রচিত হয়। স্বীকৃত হয়, পদাবলীতে বিরহ ছাড়া মিলনের সমৃদ্ধি নেই (“ন বিনা বিপ্রলম্ভেন সম্ভোগঃ পুষ্টিমশুতে”)। অষ্টনায়িকা কল্পনা, রসোদগার, সখী-সংবাদ জাতীয় বহু রচনার সাহায্যে রস-বৈচিত্র্য দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের অনেক কবি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা অবলম্বনে কৌতুকরস ও লঘুতরল নানা প্রসঙ্গ কল্পনা করেছেন। চন্দ্রশেখর নামক কবি রাধার অবৈধ প্রেমের তত্ত্ব উদ্ভাবন করে, দীনবন্ধু দাস গোষ্ঠলীলা বর্ণনায় শৃঙ্গার রসের আমদানি করে সুবলের মাধ্যমে রাধাকে কৃষ্ণমিলনে উৎসাহদান করেছেন আবার কখনো বা দাস, বৈদ্য বা নাপিতানী বেশে কৃষ্ণ মিলিত হয়েছেন রাধার সঙ্গে। এক কথায় এই যুগের পদসাহিত্য হয় তত্ত্বে বদ্ধ, নয়ত কৃত্রিম আলঙ্কারিকতায় আবদ্ধ।


সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণব পদাবলী ছিল অনুবাদ ও আলঙ্করিক কৃতিত্বের যুগ। ঘনশ্যাম দাস, মনোহর দাস, বলরাম দাস প্রমুখ কবিরা ছিলেন পূর্বাচার্যদের বাধ্য অনুবাদক, বিশেষতঃ গোবিন্দ দাসের। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত গোবিন্দদাসের স্বয়ং উপস্থিতি এবং কাব্য-প্রভাব হয়ত ছিল তার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ এযুগের কবিদের পক্ষে প্রায় অনিবার্য ছিল তাঁর অনুকরণ, যদিও অসম্ভব ছিল তাঁর ধ্রুপদী আঙ্গিক ও গভীর বিশ্বাসের অনুসরণ। তবু নিরপেক্ষ বিচারে একথাও সত্য, অদ্ভুত বৈষ্ণব সংস্কৃত কবির কাব্যের অনুবাদে এবং কাব্যপ্রকরণের নিষ্ঠায় এযুগের কবিরা নিরীক্ষাভীরু ছিলেন না।


অষ্টাদশ শতক : অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল মূলতঃ পালাকীর্তন রচনা ও সঙ্কলনের কাল। পদসঙ্কলন গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’ (১৭০৪ খ্রীঃ)। ৩০টি ‘ক্ষণদা' বা বিভাগে ইনি রসপর্যায়ক্রমে ৪৫ জন কবির ৩০০-র বেশি পদ সঙ্কলন করেন। বৈষ্ণবপদের অন্বেষণের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের গুরুত্ব সর্বাধিক। এর পরে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল নরহরি চক্রবর্তী বা ঘনশ্যাম দাসের ‘গীতচন্দ্রোদয়' এবং ‘গৌরচরিত্রচিত্তামণি’ নামে দু'খানি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ। এছাড়া অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে শ্রীনিবাস আচার্যের পৗত্র রাধামোহন ঠাকুর ৭৪৬ পদ সংগ্রহ করে সংকলন করেন ‘পদামৃতসমুদ্র’। ইনি ‘মহাভাবানুসারিণী' নামে সংস্কৃতভাষায় একটি টীকাও রচনা করেন। সর্বাপেক্ষা বৃহৎ এবং সুপরিচিত সংকলন গ্রন্থ হল ‘পদকল্পতরু’, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়। সংকলকের নাম গোকুলানন্দ সেন (বা বৈষ্ণব দাস)। এখানে আছে ৪টি শাখা এবং প্রত্যেকটি শাখা কয়েকটি পল্লবে বিভক্ত। এখানে প্রায় ১৩০ জন কবির লেখা তিন হাজারেরও বেশি পদ স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থের মুদ্রণকাল সম্ভবতঃ ১৮৮৬ খ্রীঃ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত এবং সতীশচন্দ্র রায় সম্পাদিত সংস্করণ ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আছে ৬০ জন কবির সাড়ে ছশোর পদের সংকলন, গৌরসুন্দর দাসের ‘কীর্তনানন্দ’, ৪০ জন কবির পাঁচশ পদের সংকলন, দীনবন্ধু দাসের ‘সংকীর্তনামৃত’ প্রভৃতি।


পালাকীর্তনে যেমন প্রসিদ্ধ কবিদের পদগুলি গ্রহণ করা হত, তেমনি কাহিনী– কৌতূহল সৃষ্টির জন্য জনরুচির পরিতৃপ্তির জন্য অভিনব ঘটনা প্রসঙ্গ উদ্ভাবন করা হত। তবু বলা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর মানবিক রস, ষোড়শ শতাব্দীর তত্ত্বগাম্ভীর্যকে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের পদাবলীকারেরা অনাহত মর্যাদায় রক্ষা করতে পারেন নি। দীনেশচন্দ্র সেন তুলনা করে বলেছিলেন কিছু সাদৃশ্য সত্ত্বেও বৈষ্ণব পদাবলী Palgrave-এর Golden Treasury-র অন্তর্গত লিরিকগুলির মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং একটি পারম্পর্যের সম্পর্কে আবদ্ধ।


বৈষ্ণব পদাবলীকে যদি 'আধ্যাত্মিক ট্র্যাজেডি' বলে ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে গৌরচন্দ্রিকা যেন তার প্রস্তাবনা (Prologue), পূর্বরাগ উন্মোচন (exposition), আক্ষেপানুরাগ তীব্র গতিবেগ (rising action) অভিসার শীর্ষবিন্দু (climax), মিলন ও মান স্তিমিত গতিবেগ (falling action), মাথুর সর্বনাশী সমাপ্তি (Catastrophe) ও ভাবসম্মেলনকে উপসংহার (epilogue) বলা যায়। এইভাবেই পূর্ববর্তী পদকর্তাদের রোমান্টিক অভিজ্ঞতা পরিশেষে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাধক কবির মরমিয়া অভিজ্ঞানে পরিবর্তিত হয়েছে। যা ছিল ব্যক্তিগত, তা রূপান্তরিত হয়েছে চৈতন্য প্রভাবে ও গৌড়ীয় দর্শনের প্রভাবে গোষ্ঠী-নির্ভর সুগ্রথিত মহত্তম উপলব্ধিতে।