চন্ডীদাসের পদাবলীর ভাব, ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রধান কবিব্যক্তিত্বের অধিকারী চন্ডীদাস। তিনি হলেন বাঙালীর ভাব সাধনার আদি কবিগুরু। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে চন্ডীদাস কে, কোথায় জন্ম, চন্ডীদাস কজন— সে সম্বন্ধে আজও পাঠকরা বিভ্রান্ত। এই সমস্যার সমাধান যেমন এককথায় সম্ভব নয়। কোনও একজন কবি নিশ্চয়ই ছিলেন যিনি নিজের জীবনে ও সাধনায় বাঙালীকে তাঁর পবিত্রতম কাব্যাধিকার দিয়েছেন। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে এক চন্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উভয়ের দৈহিক লালসা ও স্থূল প্রেমের বর্ণনা করেছেন। এ রাধা একেবারে ‘গ্রাম্য’ অনভিজ্ঞ কিশোরী, আর এক চন্ডীদাস রজকিনী রামীর সংস্পর্শে এসে বিশুদ্ধ প্রেমকাব্য রচনা করেন। এই দুজন চন্ডীদাস চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী পদাবলীর চন্ডীদাস।


সহজিয়াদের মত হল “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'। মানুষের ভেতরেই ঈশ্বরের লীলা। নরনারী নিজের উপর—কৃষ্ণ এবং রাধাভাব আরোপ করে। এই আরোপের ফলে শ্রীরূপলীলা হয় এবং পরে স্বরূপলীলায় পরিণত হয়। রজকিনীর প্রেম “কাম— গন্ধহীন” এবং “নিকষিত প্রেম’। সহজিয়া বৈষ্ণবের প্রেম দেহসম্পর্কহীন হতে পারে না। কিন্তু কামগন্ধহীন কিরূপে? ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের মন্তব্য এ বিষয়ে প্রাণিধানযোগ্য “সহজিয়াদের প্রথম সাধনা হইল শুধু বিশুদ্ধির সাধনা। সোনাকে যেমন পোড়াইয়া পোড়াইয়া নিখাদ করিয়া তুলিতে হয় তেমনি মর্ত্যের প্রাকৃত দেহমনকেও অবলম্বন করিয়া যে প্রেম তাহা তখন হইয়া ওঠে 'নিকষিত’ প্রেম। এখানেও প্রেমে দেহমিলন তবে রূপান্তরিত দেহে।”


চন্ডীদাস ছিলেন অকৃত্রিম বাঙালী কবি। বাঙালীর প্রাণরস সর্বাধিক উৎসারিত চন্ডীদাসের অশ্রুসজল কাব্যে এবং তিনি খাঁটি বাঙালী কবিভাষায় আবিষ্কর্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। বাঙলা দেশের হৃদয় হতে বঙ্গবাণী অপরূপ রূপে বাহির হয়েছে চন্ডীদাসের কাব্যসাধনায়। বাংলাভাষা গীতিকাব্যের, সংক্ষুদ্ধ মহাকাব্যের নয়। “বাঙালীর গীতিরস বেদনারসও বটে। এখানেই চন্ডীদাসের জয়। তিনি গানের মধ্যে অশ্রুর বন্যা মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে কানের ভিতর দিয়ে ‘মরমে’ সংগীত ঢেলেছেন। তারপর অবশিষ্ট রেখেছেন কি করব, কি হবে উপায়? এ যিনি করেছেন....তিনি চণ্ডীদাস।”


চন্ডীদাসের রাধিকা প্রথম থেকেই কৃষ্ণগতপ্রাণা। কিশোর বয়সেও বৈরাগ্য ভাব লক্ষিত হয়—

সদাই ধেয়ানে   চাহে মেঘ পানে

না চলে নয়ান তারা।

বিরতি আহারে    রাঙাবাস পরে

যেমতি যোগিনী পারা।


এখানে রাধা পার্থিব কামনা-বাসনার উর্ধ্বে স্থাপিতা। চন্ডীদাসের রাধা স্বয়ং সম্পূর্ণ—

সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম। 

কানের ভিতর দিয়া   মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।।


–প্রেমের একটি মধুর প্রভাতী সুর। বৈষ্ণব কাব্যের গায়ত্রী মন্ত্র স্বরূপ। এখানে আমাদের দৈনন্দিন ভাষাতেই কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ভাবের কি অপূর্ব সৌন্দর্য্য, অলংকারের নিপুণতা, ভাবের চারুত্ব যুক্ত প্রেমের এক স্বর্ণোদ্যানে কবি আমাদের উপনীত করেছেন। কিন্তু বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য আমরা অন্য রাধাকে পাই, সেখানে কৃষ্ণ পূর্ব কৃতিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে নিজেকে ঈশ্বর বলে জাহির করতে চেয়েছেন, রাধার নিকট বলপূর্বক প্রেম আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এই রাধাকৃষ্ণ আমাদের শ্রদ্ধা বিশেষ আকর্ষণ করে না। প্রেমের গভীরতা দেখানোর মত পদাবলীর চন্ডীদাসের সমক্ষে কেউ দাঁড়াতে পারে না। কবি যে প্রেমের কথা বলেছেন সে প্রেমের কোনও উপমা নেই। এ প্রেম তিলমাত্র উপেক্ষা সহ্য করতে পারে না। উপেক্ষার এই প্রেম অনুযোগ, অভিযোগ, অনুতাপ, আত্মগ্লানি ও মারণাকাঙ্ক্ষার রূপধারণ করে।


চন্ডীদাসের রাধিকা প্রিয়তমকে নিকটে পেয়েও যেন শাস্তি পাচ্ছেন না। সেখানেও বিরহের দাবানলে তিনি দগ্ধ, তাই ঈশ্বরের কাছে তাঁর কামনা—

কামনা করিয়া সাগরে মরিব সাধিত সাধা।

মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন তোমারে করিব রাধা।।


—তাহলেই রাধার বেদনা কৃষ্ণ উপলব্ধি করতে পারবেন। প্রাণের গভীর সত্য বাণী যেখানে রস রূপ ধরেছে, সেখানে অলঙ্কার শাস্ত্র, স্তম্ভিত। গভীর প্রেমের ভাষাই স্বতন্ত্র। এ ভাষা পূর্ববর্তী সাহিত্যে ছিলনা, এ ভাষার প্রবর্তক চন্ডীদাস। যুগ যুগ হতে বাঙালীর অন্তরেই যেন কথাগুলি ব্যক্ত হবার প্রতীক্ষায় ছিল—

বধু কি আর বলিব আমি।

জীবনে মরণে   জনমে জনমে

প্রাণনাথ হইও তুমি।।


এই গান বাঙালী বোঝে– লৌকিক জীবনেই হোক, আর আধ্যাত্মিক জীবনেই হোক, সকল প্রেমাম্পদের উদ্দেশ্যে বাঙালীর অন্তরের এটিই চিরন্তন আবেদন।


গ্রাম্য কবি চন্ডীদাস কোনও এক অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি বলে বাঙালীর দ্বারা ব্যবহৃত দেশজ শব্দসমুদ্রের ভেতর থেকে সেই মণি খন্ডগুলি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, যেগুলি হৃদয়ের নিকটবর্তী, অনুভূতির রেখাঙ্কিত এবং বহু নিভৃত স্বপ্ন সাধ ও সাধনার স্মৃতিময় ভাষাপূর্ণ। চন্ডীদাস বাইরের থেকে সংযোজন করেননি, ভেতর থেকে তুলে ধরেছেন। চন্ডীদাসের ভাষা বাঙালীর জীবনরূপকে মুক্তার লাবণ্যে বেঁধেছে। বাঙালীর জীবনের নিতান্ত গ্রাম্যরূপ, ঐ জীবনের প্রভাব, শাসন সংস্কার নীতি ও সেখানে প্রেমের আকস্মিক আবির্ভাবের প্রতিক্রিয়া, পূর্বাগত সংস্কার ও সমাজের রক্তচক্ষুর সঙ্গে উন্মত্ত বাসনার সংঘর্ষ ও তার দ্বারা বিদীর্ণ সত্তা—এ সকলের অভিব্যক্তি চন্ডীদাসের ভাষায় মিলেছে। সেখানে আরো দেখা যায় শত বাধার মধ্যেও প্রেমের দুরস্ত রূপ, বাংলার কোমল মৃত্তিকায় প্রেমের সর্বত্যাগী যোগিনী মূর্তি।