বাংলা কাব্যসাহিত্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭ খ্রীঃ-১৯৫৪ খ্রীঃ)

বাংলা কাব্যেযতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত


ভাববিলাসের বিরোধিতা, ব্যঙ্গ ও যুক্তিবাদী মনোভাব : এই ধরনের আবেগমুক্ত মনোভাব নিয়ে কৃত্রিম সংস্কার ও ভাববিলাস ঘুচিয়ে যিনি ঘোষণা করেছিলেন “প্রেম ও ধর্ম জাগিতে পারে না বারোটার বেশী রাতি”, সেই ইঞ্জিনিয়ার-কবি যতীন্দ্রনাথ ‘দুঃখবাদী’ রূপেই সুপরিচিত। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী, বাস্তবে অনুরাগ আর ব্যঙ্গপ্রবণ অভিলাষ নিয়ে যতীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। প্রেম-প্রকৃতি-ভগবান রোমান্টিকতার নামে যাবতীয় ভাববিলাস ও সংস্কার ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য। ‘ভারতী’ গোষ্ঠীর লেখকেরা যখন রবির ভাবে ও তাপে উত্তপ্ত, তখন ভাষায় ও বক্তব্যে, উপমায়-অলঙ্কারে-চিত্রকল্পে নিজস্ব দার্শনিকতায় রবীন্দ্র-যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবিরূপে যতীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ। বস্তুত আধুনিক কবিদের মধ্যে তার কবিতায় প্রথম দেখা গেল মুগ্ধ আত্মতৃপ্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ, নিমীলিত নেত্রে সৌন্দর্য-দর্শনের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ তীক্ষ্ণ আঘাত এবং গণ-সংযোগ প্রচেষ্টা। সেইদিক থেকে আধুনিক বাংলা কাব্যে তাঁর মাধ্যমেই গণকাব্যের সূচনা বলা চলে।


যতীন্দ্রনাথের জন্ম ও কর্মজীবন:

যতীন্দ্রনাথের পৈত্রিক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার শান্তিপুরে। তবে যতীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দের ২৬ জুন বর্ধমান জেলার পাতিল পাড়া গ্রামে। শিবপুর কলেজ থেকে বি. ই. ডিগ্রি লাভ করে কর্মজীবন শুরু করেন। রবীন্দ্রকাব্য এবং যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সংস্পর্শে এসে কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ হন।


যতীন্দ্রনাথের কাব্যসমূহ:

‘মরীচিকা' (১৯২৩), ‘মরুশিখা' (১৯২৭), 'মরুমায়া’ (১৯৩০), ‘সায়ম’ (১৯৪০), 'অনুপূর্বা' (১৯৪৬), 'ত্রিযামা' (১৯৪৮), 'নিশান্তিকা' (১৯৫৭, মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)।


যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদী-দার্শনিকতা ও প্রশ্নমুখরতা:

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নিজে তার কাব্য মানসকে এক বিশিষ্ট অভিধায় চিহ্নিত করতে আগ্রহী, নিজেকে বলেছেন 'দুঃখবাদী বৈরাগী'। তাঁর দৃষ্টিতে দুঃখ, লাঞ্ছনা, নৈরাশ্য ও মৃত্যু মানবভাগ্যের নিদারুণ এক অনিবার্য পরিণাম। তাই তাঁর কাছে প্রেম প্রকৃতি-নারী মানে বিশুদ্ধ ফাঁকি, সুখ-আনন্দ স্বপ্ন-প্রেম শুধু মরুমায়া, মরীচিকা, আলেয়ার খেলা মাত্র

“প্রভাত হৃদয়-বনে ছুটে মায়ামৃগ, 

দু’পুরে বুকের মরুমায়া মরীচিকা,

আঁখির ‘জলায়' সাঁঝে আলেয়ার খেলা,

নিশীথে হারায় পথ প্ৰাণ খদ্যোতিকা।”


কঠোর বাস্তববাদী কবি জানেন “বনের আঁধার মুখ” জোনাকির আলোয় যেটুকু দেখায়, মৃগতৃষ্ণার ছবিতে মরুর তৃষ্ণা যতটা বোঝায়, বা “আলেয়ার আলো” পথিককে যে বারে বারে ভোলায় তা কাব্যের উপমা মাত্র। কারণ,

“বন্ধু, বন্ধু হে কবিবন্ধু, উপমার ফাস গুণি,

আসল কথাটা চাপা দিতে ভাই কাব্যের জাল বুনি”।


তাই সঙ্গতভাবেই কবির প্রশ্ন

“কে গাবে নূতন গীতা-

কে ঘুচাবে এই সুখ সন্ন্যাস- গেরুয়ার বিলাসিতা?

কোথা সে অগ্নিবাণী

জ্বালিয়া সত্য, দেখাবে দুঃখের নগ্ন মূর্তিখানি!

কালোকে দেখাবে কালো ক’রে আর বুড়োকে দেখাবে বুড়ো; 

পুড়ে উড়ে যাবে বাজারের যত বর্ণ-ফেরানো গুঁড়ো!”


যতীন্দ্রনাথের নৈরাশ্যবাদ:

স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন

“প্রেম বলে কিছু নাই,

চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে 

সব সমাধান পাই।”


শশিভূষণ দাশগুপ্ত এই ‘ঘুমের ঘোরে’ পর্যায়ের কবিতাগুচ্ছের সঙ্গে ইংরেজ কবি Don-এর 'Satires' কবিতার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। এ কথা ঠিক, এই দুঃখবাদ কবিকে অংশত নৈরাশ্যবাদী করে তুলেছিল। এই নৈরাশ্যবাদের সূত্রপাত দার্শনিক লাইবনিৎসের 'Theodicee' থেকে। জগৎসৃষ্টির মধ্যে যে সুদক্ষ শৃঙ্খলা, সজ্ঞান পরিচালনার নেতৃত্ব এবং পরিপূর্ণতার পথে জগৎ ও জীবনের যে যাত্রা নির্দেশ করা হয়েছিল, সেই আশাবাদী দর্শনের বিরোধিতাই তাই একসময় নৈরাশ্যবাদের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। পরে বৌদ্ধ ‘নির্বাণে’, বেদান্তের ‘জগম্মিথ্যায়’ অথবা শোপেনহাওয়ারের 'Will' তত্ত্বে তার বিচিত্র অভিব্যক্তি দেখা যায়। যতীন্দ্রনাথও যেন ‘ঘুমের ঘোরে’ দীর্ঘ কবিতাবলীর এক একটি ঝোকে তাঁর নৈরাশ্যভাবনাকে সূত্রাকারে প্রকাশ করেছেন; যেমন—“জগৎ একটা হেঁয়ালি, যত বা নিয়ম তত অনিয়ম, গোঁজামিল খামখেয়ালী”, দেবতা? সে তো রাক্ষস—“চিতার বহ্নি যত বিধবার সিঁথির সিঁদুর চেটে, বিশ্বম্ভর হে গণেশবর যোগায় তোমারি পেটে।” ভক্তি মানে “প্রবলের সাথে এক তরফা সে সন্ধি” আর জীবনের পরিণাম?


“ধান ভানা ছাড়া কোনো উঁচু মানে থাকে না

ঢেঁকির রবে।”

আর এই অবস্থা থেকে বাঁচার সহজতম সমাধান— ‘ঘুমিওপ্যাথি’

“ঝুম ঝুম নিঝঝুম—

মেঘের উপরে মেঘ জমে আয়-ঘুমের উপর ঘুম”


যতীন্দ্রনাথের আত্মসমীক্ষা:

কিন্তু তবু এই দুঃখবাদ ও নৈরাশ্যবাদের অতল অন্ধকারে কবি বিলুপ্ত হতে চান নি। সমালোচকের ভাষায় - “সেইজন্যেই ‘যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ’ শেষ পর্যন্ত নৈরাশ্যের অন্ধকারে—পরিণামহীন শূন্যতার পথে আকাঙ্ক্ষার অতৃপ্ত জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কোন বিবর্ণ মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে যায় নি। তার শ্লেষের আঘাত আত্মধ্বংসমূলক হয়—তা আত্মসমীক্ষামূলক; ভণ্ডামি, মূঢ়তা বঞ্চনা আর বাষ্পবিলতার বিরুদ্ধে তার খরধার আক্রমণ”

তাই ‘ঘুমের ঘোরে’-র শেষ পর্যায়ের কবিতায় দুঃখের দেবতাকে অশ্রুধারায় অভিষিক্ত করে কবি মানবপ্রেমের জয়গান করেছেন

“শুনহ মানুষ ভাই!

সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা আছে বা নাই।

যদিও তোমাদের ঘেরিয়া রয়েছে মৃত্যুর মহারাত্রি,

সৃষ্টির মাঝে তুমিই সৃষ্টি ছাড়া দুখ-পথ যাত্রী।”


যতীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম:

যতীন্দ্রনাথের কবিতায় আর এক বৈশিষ্ট্য মানবপ্রেম বা মানুষের জয়গান। প্রকৃতপক্ষে মানুষের দুঃখ-অপমান লাঞ্ছনার জন্যই তার ভাববিলাসের বিপক্ষে আক্রমণ। ভণ্ড দেশপ্রেমিকদের প্রতি তাঁর মর্মভেদী আঘাত

“সেই দুর্যোগ উৎসব যবে ঘনাইবে চারিধার 

মেঘে ঝড়ে জলে বজ্র বাদলে রচিয়া অন্ধকার,

-স’রে পড়ি যদি ক্ষমা কোরো দাদা!

খাঁটি চাষা ছাড়া কে মাখিবে কাদা?

মনে কোরো ভাই মোরা চাষী নই-চাষার ব্যারিস্টার।”


বলা বাহুল্য, ‘চির নাবালক চাষা'-র সমর্থনে তাঁর এই রোষ, শিক্ষিত বিত্তবান দেশনেতার উদ্দেশে এই শ্লেষাঘাত, আত্মধ্বংসে নয় পাঠককে আত্মসমীক্ষায় প্ররোচিত করে। তাঁর ‘কৃষ্ণা’ কবিতায় আছে অবমানিত নারীত্বের প্রতি বজ্রমন্থ আহ্বান। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, মানুষজনের প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা ‘মানুষ’, ‘চাষার বেগার’, ‘বার নারী’ প্রভৃতি কবিতায় সোচ্চার। ‘পাঁচীর ছেলে’র মৃত্যুকাহিনী আজও বেদনায়, যন্ত্রণায় পাঠক মনকে বিদ্ধ করে

“পথ্য পায়নি, আজ পথ্য পেতো 

কেউটের বিষে যদি বেঁচে সে, যেতো।

ছাইকুড়ে মান-তলে

দীনের ফসল ফলে,

তাই তুলে চালে-জলে সিজায়ে খেতো,

পাঁচী যদি সুখা কাঠ কুড়ায়ে পেতো। 

শুখা কাঠও পেয়েছিল এই বাদলে,

তাই হয়,-যবে যার বরাত খোলে।

আনন্দে ভুখা ছেলে

ছেঁড়া কাঁথা টেনে ফেলে 

ছাইকুড়ে, মান খুঁড়ে যেমনি তোলে,

‘মাগো!’ বলে ছুটে এসে পড়িল ট’লে।”

প্রলেতারিয়-সাহিত্যের সর্বলক্ষণই এর মধ্যে যেন ফুটে উঠেছে।


যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ বা নৈরাশ্যবাদ তার শেষ পর্যায়ের কাব্যসমূহের ‘বঞ্চিতরাজ’ শঙ্করের আবাহনে মানবতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই শিব শঙ্কর আগম-নিগম-পুরাণ বক্তা নন, ইনি মন্ত্রহীন ব্রাত্য দুর্গত মানুষের প্রতিনিধি। বস্তুত, “মোহাচ্ছন্ন জীবনের আত্মরতির বিরুদ্ধে তাঁর শিবরাত্রি যাপন। যতীন্দ্রনাথের শিবপূজা ব্যর্থ হয়নি। শীত প্রাস্তে তুষার-বর্ষণের মধ্যে যেমন করে দরিদ্ররূপী ভগবান এসেছিলেন তলস্তয়ের কাছে—তার কবিতাতেও তেমনি 'কচি ডাবের’ পসরাবাহী বৃদ্ধ এক হিমের রাত্রিতে নীলকণ্ঠরূপে দেখা দিয়েছেন” (দ্রষ্টব্যঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৩০৯)। নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি সুগভীর বেদনাবোধে, দুঃখময় জীবনের প্রতি আত্মীয়তার অনুভবে এই ‘কচি ডাব’ কবিতাটি হয়েছে বাংলা কাব্যের অনশ্বর সম্পদ

“দারুণ শীতের সাজ হে আমার নটরাজ 

কোন্ রূপে এসেছিলে দ্বারে? 

অশ্রুর সাগর মন্থ    হে আমার নীলকণ্ঠ 

ভাগ্যে ফিরাইনি একেবারে...! 

যে-মোহিনী স্বর্ণ টাটে    পাতে পাতে সুধা বাঁটে 

সে যাদের করে প্রবঞ্চনা, 

হে মোর বঞ্চিতরাজ নিঃশেষে বুঝেছি আজ – 

আমি যে তাদেরি একজনা! 

তাই তুমি নানা ছলে আমার অন্তরতলে, 

আমার দুয়ারে আঙিনায়

ঘুরিয়া ঘুরিয়া আসো কাঁদি ব’লি ভালোবাসো 

মোর অশ্রু তোমারে কাঁদায়।”

‘ঘুমের ঘোরে’র অবিশ্বাসী অজ্ঞেয়বাদী কবি এইভাবেই সর্বহারা দীন দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতায় ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছেন ‘মানবপ্রেমিকে’।


বাংলা কাব্যে যতীন্দ্রনাথের অবদান:

যতীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতায় অবদান তাই সূত্রকারে এইভাবে বলা যায়


(ক) নিছক ভাববিলাস ও আত্মপ্রেমের কৃত্রিমতা থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তিদান। কবিতায় সযত্ন লালিত আস্তিক্যদর্শনকে সমকালের ঐতিহাসিক পটভূমিতে ও দুঃখবাদের আগ্নেয় অভিজ্ঞতায় যাচাই করার প্রচেষ্টা

“চেরাপুঞ্জির থেকে

একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে?”


(খ) দরিদ্র, লাঞ্ছিত মানুষের জীবনের দুঃখময় অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে কবিতাকে গণমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা। ভাষা ও ভাবের এই অভিনবত্ব স্মরণ করে অনতি-পরবর্তী কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন : “যতীন্দ্রনাথের কাছে...পেয়েছিলাম এই আশ্বাস যে আবেগের রুদ্ধশ্বাস জগৎ থেকে সাংসারিক সমতলে নেমে এসেও কবিতা বেঁচে থাকতে পারে। পেয়েছিলাম একটি উদাহরণ যে পরিশীলিত ভাষা ও সুবিন্যস্ত ছন্দের বাইরে চলে এলেও কবিতার জাত যায় না”


(গ) ‘মরু’ প্রাত্তর ও রাত্রিভাবনার রূপকায়িত কাব্য নামে আধুনিক জীবনের হতাশা ও নৈরাশ্যকে প্রকাশ করা। পরবর্তী কবি-প্রজন্মের কাছে তাই যতীন্দ্রনাথের কবিতা রবীন্দ্রনাথ থেকে ভিন্নতর ভাবের উপকরণ ও দৃষ্টিকোণ অনুসন্ধানের প্রেরণা দিয়েছে।


(ঘ) রবিদ্রোহিতার বশে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যধ্যানকে প্রথমে আঘাত করলেও পরে দ্বি-প্রহরের মরু উত্তাপ কিভাবে সন্ধ্যার শীতল-স্নিগ্ধ বাতাসকে আপন করে নেয়— যতীন্দ্রনাথের কাব্যধারার ক্রম অনুসরণে পরবর্তী অনুজ কবিদের (বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ) কাছে তা শিক্ষণীয় আদর্শ হয়ে উঠেছিল।


ছন্দে-শব্দচয়নে-লোকায়ত জীবধর্মে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাই একালের সাহিত্য-রসিক বাঙালী-পাঠকের একান্ত আত্মজন হয়ে উঠেছিলেন।