বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : গোবিন্দদাস কবিরাজ (আনু. ১৫৩৭ বঙ্গাব্দ–১৬১৫ বঙ্গাব্দ)

বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : গোবিন্দদাস কবিরাজ


চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা গোবিন্দদাস কবিরাজ সম্পর্কে কবি বল্লভদাস বলেছিলেন

“ব্রজের মধুরলীলা, যা শুনি দরবে শিলা, রচিলেন কবি বিদ্যাপতি। 

তাহা হৈতে নহে ন্যূন, গোবিন্দের কবিত্বগুণ, গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি ॥”


এই গোবিন্দদাসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সাহিত্যের ইতিহাসে কিন্তু তথ্য তেমন যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না। এই তথ্য উপাদানের প্রাথমিক সূত্র কবির লেখা অধুনালুপ্ত ‘সঙ্গীতমাধব’ নাটকের ('ভক্তিরত্নাকর' ও 'নরোত্তমবিলাস’ গ্রন্থ দুটিতে কিছু অংশ উদ্ধৃত হয়েছে) অংশ বিশেষ, রামগোপাল দাসের 'রসকল্পবল্লী' এবং নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর' এবং 'নরোত্তমবিলাস' গ্রন্থসমূহ। এখান থেকে জানা যায়, তার পিতা, মাতা ও মাতামহের নাম ছিল যথাক্রমে চিরঞ্জীব, সুনন্দা এবং দামোদর সেন। দামোদর ছিলেন মহাকবি এবং শ্রীখণ্ডের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। অল্প বয়সে পিতার জীবনাবসান হওয়ায় কবির জীবন এই মাতামহ দামোদরের আশ্রয়েই কাটে। গোবিন্দদাস কবিরাজ ছিলেন চৈতন্যভক্ত চিরঞ্জীব সেনের দ্বিতীয় পুত্র। তার পিত্রালয় কুমারনগর, ধর্মমতে প্রথমে তিনি ছিলেন শাক্ত। পরে ৪০ বৎসর বয়সে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। কবি যশোরাধিপতি প্রতাপাদিত্যের পরিচিত ছিলেন। শ্রীজীব গোস্বামীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। খেতুড়ির ভূস্বামী সত্তোষ দত্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল।


গোবিন্দদাসের জীবৎকাল নির্ণয়ে বৈষ্ণব শাস্ত্রবেত্তা জগদ্বন্ধু ভদ্র বলেছেন ১৫৩৭ বঙ্গাব্দে কবির জন্ম, ১৬১৫ বঙ্গাব্দে তার তিরোধান হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের আদিলীলায় ১১শ পরিচ্ছেদে নিত্যানন্দের শিষ্য বলে গোবিন্দদাস কবিরাজ ও রামচন্দ্র কবিরাজের নামোল্লেখ আছে। নিত্যানন্দ ১৫৪০ খ্রীস্টাব্দের পরে জীবিত ছিলেন না। সেক্ষেত্রে ১৫২৫ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে কবি গোবিন্দদাসের জন্ম ধরা যায়। অন্যদিকে অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম’ গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন ১৫৬৬-৬৭ খ্রীস্টাব্দের পরে তিনি শ্রীনিবাস আচার্যের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।


গোবিন্দদাসের কয়েকটি পদ থেকে ইতিহাসের তথ্য সূত্র পাওয়া যায়, যেমন “প্রেম আগুনি মনহি গুনি গুনি”, “শুনহ নিরদয় হৃদয় মাধব সে যে সুন্দরী রাই” ইত্যাদি দুটি পদের ভণিতায় যথাক্রমে ‘প্রতাপ আদিত্য’ এবং ‘প্রতাপ আদিত’ উল্লেখ দেখে। বিখ্যাত যশোহররাজ প্রতাপাদিত্য ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পাদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৬১১ খ্রীস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। কাজেই গোবিন্দদাস যদি প্রতাপাদিত্যের সমকালীন হন তবে অন্তত ১৬০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা যেতে পারে। কবি গোবিন্দদাসের শেষজীবন অতিবাহিত হয়েছিল বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত ভগবানগোলার নিকটবর্তী তেলিয়া-বুধরী গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে।


শোনা যায়, এক কঠিন অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করে গোবিন্দদাস বৈষ্ণব হয়েছিলেন। তিনি ধ্যানে “সঞ্চরমান অভিনব হেম কল্পতরু” গৌরাঙ্গদেবকে অনুভব করে পদরচনায় বৃত হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যরচনার অন্তরালে ছিল বিদগ্ধ কবি মাতামহ দামোদরের পারিবারিক উত্তরাধিকার, হাল-অমরু-জয়দেব-কলহন-বিদ্যাপতি ও রূপ গোস্বামী ও অন্যান্য সংস্কৃত কবিদের কাব্য-কল্পনার ঐতিহ্য এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তাত্ত্বিক পটভূমি। ফলে কবিত্বের সঙ্গে দার্শনিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। এই সমন্বয়ের কারণে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সর্বাঙ্গীণ অনুমোদন লাভ করেছিল তার কবিতা। সাধারণ ভক্ত থেকে শুরু করে স্বয়ং জীব গোস্বামীর মতো রসিক পণ্ডিতও ছিলেন তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক : “শ্রীগোবিন্দ কবিরাজ মহাভাগবতেষু 'জীবস্য কৃষ্ণস্মরণং শ্রীমতাং ভবতাং শুভানুধ্যানে ...সম্প্রতি যৎ কৃষ্ণবর্ণনাময় স্বীয় গীতানি প্রস্থাপিতানি, পূর্বমপি যানি, তৈরামৄতৈরিব তৃপ্তবর্ত্তামহে; পুনরপি নূতন তত্তদশয়া মুহূরতৃপ্তিঞ্চ লভামহে। তন্মাত্র চ দয়াবধানং কর্ত্তব্যং।”