'ফুল্লরার বারমাস্যা' বর্ণনায় কবি বাস্তবতা ও সামাজিকতাবোধের এবং চরিত্রচিত্রণাদি যে সকল গুণের পরিচয় দিয়েছেন, তার পরিচয় দাও।

"ফুল্লরার বারমাস্যা' অংশটির জন্য মুকুন্দরামকে কি দুঃখবাদী কবিরূপে অভিহিত করা যায়?


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাস্তবধর্মী রচনার উজ্জ্বলতম দৃষ্টাপ্ত কবিকঙ্কণ-রচিত 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যের 'ফুল্লরার বারমাস্যা'। দেবী চণ্ডী ব্যাধ-সস্তান কালকেতুর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্য ছদ্মবেশে এক ষোড়শী রূপসীরূপে তার গৃহে দেখা দিয়েছেন। কালকেতু-পত্নী অকস্মাৎ তাঁকে দেখে চমকিত হ'লে এমন দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় দেবী তার পরিচয় দিলেন, যা থেকে ফুল্লরার ধারণা হ’ল সতীনের জ্বালা সইতে না পেরে এই রমণী গৃহত্যাগ করেছে এবং কালকেতুই তাকে ঘরে এনে তুলেছে। ফুল্লরার আশঙ্কা হ'ল— এই রমণী বুঝি তার সতীন হ'য়ে এ ঘরে থাকতে চায়। তাই নানাপ্রকার হিতবাক্য, বৈষয়িক জ্ঞান এবং পুরাণাদি থেকে দৃষ্টান্ত তুলে ফুল্লরা এই রমণীকে স্বগৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করলো। কিন্তু ছদ্মবেশিনী দেবী তো তাদের দুঃখ দূর করতে এসেছেন, কাজেই চলে যাবেন কেন—তিনি গোঁ ধরে বসে রইলেন। তখন ফুল্লরা ভাবলো—সে আর সংসার জীবনের অভাব দারিদ্র্য দুঃখকষ্টের একটি ভয়াবহ চিত্র এই রমণীর সামনে তুলে ধরতে পারে, তবে হয়তো ভয়ে এই নারী সংসার ছেড়ে যেতে। পারে। এই অনুমানে ফুল্লরা ঐ রমণীর নিকট তার বারমাসের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করতে লাগলো।


ফুল্লরা বাস করে যে ঘরে, সেটি একটি তালপাতার ছাউনি দেওয়া ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘর, ভেরেণ্ডার থামের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। কালবৈশাখীর ঝড়ে প্রায়ই সে ঘর ভেঙে যায়। বৈশাখের খরতাপ আগুনের মতোই তাঁর গাছের ছায়াও নেই, যেখানে পশরা নামিয়ে সে বিশ্রাম করতে পারে। রবিতাপে উত্তপ্ত বালুকায় পা রাখা যায় না, পরিধেয় ক্ষুঞার বসনও এত খাটো যে মাথাও ঢাকা যায় না। সর্বোপরি বৈশাখ মাস নিয়ম সেবার মাস বলে কেউ মাংস খায় না–অতএব ফুল্লরা মাংসও বিক্রয় করতে পারে না বলে বৈশারের অভাব বিষের মতোই তাদের দহন করে।


জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড সূর্যতাপে শরীর যেন পুড়ে যেতে চায়। তৃষ্ণায় কণ্ঠ শুকিয়ে গেলেও পশরা রেখে কোথাও জল পর্যন্ত খেতে যেতে পারে না ফুল্লরা-চিলে হয়তো আধসারি মাংসই নিয়ে যাবে। কাজেই বৈঁচির ফল খেয়ে ফুল্লরাকে পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে দিন কাটাতে হয়।


আষাঢ় মাসে নব মেঘে জল দেখা দেয়, তখন বড় বড় গৃহস্থেরও ঘরে কিছু সম্বল থাকে না। তাই মাংসের পশরা নিয়ে ঘরে ঘরে ঘুরলে হয়তো কিছু খুদকুঁড়া জোটে, কিন্তু তাতে উদর পুর্তি হয় না। এই দুঃখের দিনে শুধু বাপ-মাকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার থাকে না।


শ্রাবণ মাসে অঝোর ধারায় দিবানিশি বর্ষণ হয় বলে শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষের কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। দেহে কোনো আচ্ছাদন না থাকায় মাংস-ধোয়া জল গায়ে পড়ে, আর তারি লোভে কত মাছি এসে গারের মাংস খুঁটে খায়। জোঁকের কামড় সইতে হয় ফুল্লরাকে, কিন্তু সে যে কেন সাপের কামড়ে মরে না এটাকেই সে বড় দুর্ভাগ্য বলে মনে করে।


ভাদ্র মাসের দুরস্ত বর্ষায় চারিদিক জলে একাকার হয়ে যায়। কিরাত নগরে বাস করে ফুল্লরা, এখানে এমন কোনো বন্ধুজন নেই যার কাছ থেকে ধার নিয়ে এই দুঃখের দিনগুলো সে কাটাতে পারে। অতি সাধারণ বৃষ্টিতেও তখন ঘরে বান ডেকে যায়,– কাজেই ফুল্লরার দুঃখ যে কত তীব্র তা যেন সেই রমণী অবধান করতে পারে।


আশ্বিন মাসে ঘরে ঘরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, সেই পূজায় ছাগ, মেষ ও মহিষ বলি দেওয়া হয়। তখন সকল রমণীই নতুন বসন পরিধান করে, শুধু অভাগী ফুল্লরাকেই তখন উদরের চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয় কারণ, ঘরে ঘরে দেবীর প্রসাদী মাংস থাকে বলে, কেউ আর মাংস কিনে যায় না।


কার্তিক মাসে হিমের আগমনে সকলেই শীত নিবারণে তৎপর হয়। ভগবান সকলেরই শীতবস্ত্রের সংস্থান করেছেন, শুধু অভাগী ফুল্লরাই হরিণের চামড়া প'রে দিন কাটায় ৷


অগ্রহায়ণ মাসে হাটে-মাঠে-গোঠে সর্বত্র ধানের সমারোহ বলে এই সময়টা উদরের চিন্তা করতে হয় না—কিন্তু শীত তখন যমের মতো জাঁকিয়ে বসে। পিরান বা দোপাটা-আদি গাত্রবস্ত্রেরও টানাটানি, অতএব হাঁটুতে মুখ ঢেকে, সূর্যতাপে অথবা আগুনের সামনে বসে শীত থেকে পরিত্রাণ পেতে হয়।


পৌষ মাসের প্রবল শীতে জগৎ-জন সুখী, কারণ তারা ভোগ করতে পারে তৈল, তুলাবস্ত্র। তনুনপাৎ বা অগ্নি, তাম্বুল এবং তপন। হরিণের বদলে ফুল্লরা কোনো এক গৃহস্থ ঘর থেকে যে পুরান খোসলা পেয়েছিল, তা গায়ে দিলে সর্ব দেহ ধূলায় ভরে যায়। ধূলার ভয়ে শুয়ে তাকানো যায় না, ফলে তার বণিতাজমনই ব্যর্থ।


মাঘ মাসে সর্বদাই কুয়াশা ঢাকা থাকে বলে আঁধারের আড়ালে থাকা মৃগ আখেটিক বা ব্যাধের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ফুল্লরার কপালদোষে তখন কাননে তোলবার মতো শাকও পাওয়া যায় না। ফুল্লরা তাই ঐ রমণীকে জিজ্ঞেস করে কোন সুখে তিনি ফুল্লরার মতো ব্যাধিনী হ'তে চান!


স্বভাবত শীতল ফাল্গুন মাসে রমণীগণ মিলনকামনায় আবুল থাকে, কপালদোষে ক্ষুধার জ্বালায় অভাগী ফুল্লরার অঙ্গ পোড়ে।


চৈত্র মাসে মৃদুমন্দ বাতাস বয়, মধুকর মালতীর মধু পান করে। কিন্তু অনলসমান চৈতের খরায় অভাগী ফুল্লরাকে এক সের চাউলের জন্য তার একমাত্র সম্বল মাটির পাত্রও বাঁধা রাখতে হয়। যদি এ'কথা ঐ রমণীর বিশ্বাস না হয়, তাই ফুল্লরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—

"আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।”


ফুল্লরার দুঃখকাহিনী শুনে দেবী তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে তার আর দুঃখ থাকবে না, কারণ

'আজি হৈতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।'

কিন্তু এই আশ্বাসে ফুল্লরার আশ্বস্ত হবার কোনো কারণ নেই, কারণ ফুল্লরা ধন চায় না, সে চায় তার স্বামীর ওপর অসপত্য অধিকার।


বার মাসের কাহিনী যাতে বর্ণিত হয়, তাকেই বলা হয় 'বারমাস্যা'। এই বারমাস্যা সুখেরও হ'তে পারে, দুঃখেরও হ'তে পারে তবে সাধারণত এটি দুঃখেরই হয়ে থাকে। প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যেই বারমাস্যার কাহিনী অপরিহার্য বিবেচিত হয়। শুধু মঙ্গলকাব্যেই বা কেন, রামায়ণে আছে 'কৌশল্যার বারমাস্যা', বৈষ্ণব পদে আছে শ্রীরাধার বারমাস্যা'। বাংলার বাইরেও এ ধরনের প্রাচীন সাহিত্যে বারমাস্যার প্রচলন আছে।


ফুণ্ণরার বারমাস্যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণ– নিম্নবিত্ত বাঙালী জীবনের যে বাস্তব চিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে, তেমন বাস্তবতার পরিচয় মধ্যযুগের অপর কোনো কাব্যে পাওয়া যায় না। শুধু বাস্তবতাই নয়, কবি মুকুন্দ এখানে সমাজচেতনতারও যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। সমসাময়িক সমাজ জীবনের নানা পরিচয় সুত্রও এখানে বিধৃত হয়েছে। এ ছাড়া নারীমনস্তত্ত্বেরও সুন্দর রূপায়ণ হয়েছে ফুল্লরার বারমাস্যায়।


কেউ কেউ এই অংশে দুঃখের আতিশয্য-দর্শনে কবি মুকুন্দকে দুঃখবাদী কবি বলে অভিহিত করতে চান। কিন্তু এখানে দুঃখের মাহাত্ম্য যেমন বর্ণিত হয়নি, তেমনি দুঃখকেই সত্য বলে গ্রহণ করা হয়নি। এমন কি, এই যে বিস্তৃত কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে, তাতে ফুল্লরার অভাব অনটনেরই পরিচয় রয়েছে, ফুল্লরার কোনো দুঃখবোধ নেই। কিন্তু বাইরে থেকে যাকে ফুল্লরার দুঃখ বলে মনে হয়- এটি তার ছলনা। সে স্বামীপ্রেমে সুখী, যাতে এই সুখে কেউ অংশ বসাতে না চায়, তারি জন্য সে দুঃখদারিদ্র্য ও অভাবের ভয় দেখিয়ে তাকে তাড়াতে চায়। ছলনাময়ী নারীচরিত্র অঙ্কনে কবি এখানে অসাধারণ মনস্তত্ত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।


দুঃখের উল্লেখ শুধু একবারই আছে, যখন ফুল্লরা বলে—

'অভাগ্য মনে গণি অভাগ্য মনে গণি।

কত শত খায় জোঁক, নাহি খায় ফণী।।'

-মনে হয়, ফুল্লরার জীবনে এত দুঃখ যে মৃত্যুই বুঝি তার কাম্য, সাপের কামড়ে একবার মরলেই বুঝি সে চিরকালের মতো দুর্ভাগ্যের হাত থেকে পরিত্রাণ পায়। কিন্তু এটি যে শুধুই ফুল্লরার মুখের কথা, একেবারেই মনের কথা নয়, সামান্য বিশ্লেষণেই তা ধরা পড়ে যায়। ফুল্লরা যদি সত্যি সত্যি সংসার জীবনকে অসহনীয় বিবেচনা করতো, তবে তো প্রথমেই সেই ষোড়শীর হাতে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে নিজে সংসার ত্যাগী হতে পারতো, তাকে এত ছলচাতুরী ক'রে তাকে তাড়াবার জন্য ফন্দীফিকির করতো না। আসলে স্বামীর প্রেমে ফুল্লরা এতোই সুখী যে অপর কোনো রমণী যদি সেখানে ভাগ বসায়, সেই আশঙ্কাতেই তার এই মৃত্যু কামনার ছলনা ও দুঃখের ভাণ। ফুল্লরার অভাব আছে, তার বারমাস্যার বর্ণনাও একান্তই বাস্তব, শুধু দুঃখবোধটাই ছলনা।