“বাঙ্গালা দেশের এবং বাঙ্গালী মানুষের এমন পরিপূর্ণ চিত্র বাঙ্গালা সাহিত্যের আর কোথাও মিলে কিনা সন্দেহ।” 'কবিকঙ্কণ চণ্ডী' বিষয়ে উদ্ধৃত এই উক্তিটির যাথার্থ্য বিচার করো।

“এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।"- কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী সম্পর্কে এই উক্তিটির যাথার্থ্য নিরূপণ করো।

সে যুগে উপন্যাস রচনা সম্ভব হলে কবিকঙ্কণ একজন ঔপন্যাসিকরূপে পরিচিত হতে পারতেন—প্রচলিত এই ধারণার পিছনে কোনো যুক্তি আছে কি না তা’ তার চণ্ডীমঙ্গল (কালকেতু উপাখ্যান) অবলম্বনে স্থির করো।


চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ঔপন্যাসিক চেতনা

পৃথিবীর সর্বদেশের সাহিত্য-বিশ্লেষণে অনায়াসে একটি সাধারণ মস্তব্য করা চলে যে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের জলাভূমিতে ছিল পদ্যজাতীয় সাহিত্যের সমারোহ। সবদেশেই গদ্যের ডাঙা দেখা দেয় অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে। মানবধর্ম-বিবর্জিত সে সমস্ত কাহিনীর আধার ছিল পদ্য ভাষা, গদ্য আবির্ভাবে সেই পদ্য আধার রূপে হ’ল পরিত্যক্ত এবং গদ্যে আধেয় বিষয়েও কিছুটা রূপান্তর ঘটে। পদ্যের মহাকাব্যই স্থানকালোচিত পরিবর্তন সহ গদ্যে উপন্যাসের রূপ ধারণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনাতেও দেখা যায় সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে ছিল পদ্যের একাধিপত্য সেই পদ্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য গীতিকবিতা এবং কাহিনীকাব্য। এই কাহিনী কাব্যের প্রধান ধারাটিই ছিল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যগুলিতে কাহিনীর বৈচিত্রা থাকলেও সেগুলি মূলত দেবযানী সাহিত্য অর্থাৎ মঙ্গলকাব্যে কোন-না-কোন দেবতার মাহাত্ম্য-কীর্তনই ছিল প্রধান লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই উপলক্ষ রূপে রচিত হ'য়েছিল বিস্তর মানব-মানবীর কাহিনী। কিন্তু কাহিনীগুলিতে অলৌকিকতার প্রভাব থাকায় সেগুলি মানব-সম্পর্কিত হলেও মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। বহু কবি একই কাহিনীকে অবলম্বন ক'রে স্ব-স্ব প্রতিভা অনুযায়ী কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করলেও কাহিনী কিংবা চরিত্র–কোনটিকেই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে পারেন নি। এই গতানুগতিকতার যুগে ষোড়শ শতকে আবির্ভূত কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীহি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন ক'রে কাহিনী ও চরিত্রে প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করে সেকালের পক্ষে প্রায় অস্বাভাবিক এক নতুন বস্তু সৃষ্টি করলেন —যাকে একালের পরিভাষায় আমরা প্রায় উপন্যাসের মর্যাদা দান করতে পারি।


বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মনীষী প্রাবন্ধিক ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন : “মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ফুটোজ্জ্বল। বাস্তবচিত্রে, দক্ষ চরিত্রাহ্মণে, কুশল ঘটনা সন্নিবেশে ও সর্বোপরি, আখ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে আমরা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাইয়া থাকি। মুকুন্দরাম কেবল সময়ের প্রভাব অতিক্রম করিতে, অতীত প্রথার সহিত আপনাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিতে, অলৌকিকতার হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করিতে পারেন নাই বলিয়াই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হইতে পারেন নাই। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাহার মধ্যে বর্তমান ছিল। এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।


কবিবঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যরচনা প্রসঙ্গে গ্রন্থের নামকরণ করেছেন 'অভয়া মঙ্গল’ এবং বার বারই তাঁর কাব্যকে ‘নৌতুন মঙ্গল’ অর্থাৎ 'নতুন মঙ্গল' বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই 'নৌতুন' অভিধা নিশ্চয়ই কাব্যটির নয়, কারণ মুকুন্দকবির পূর্বেই যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য প্রচলিত ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তার পূর্ববর্তী কবি-রূপে মানিক দত্তের নাম মুকুন্দ নিজেই উল্লেখ করেছেন এবং মুকুন্দের সমসাময়িক কালে কিংবা কিঞ্চিৎ আগে-পরে দ্বিজ মাধবও একই বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। অতএব মুকুন্দ ব্যবহৃত 'নৌতুন' বা 'নূতন' শব্দটির তাৎপর্য অন্যভাবে বিচার করতে হবে। আমরা তার বিশ্লেষণ ক’রে দেখতে পাচ্ছি,—গতানুগতিকতার মধ্যে কাহিনীকে বজায় রেখেও তিনি যে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছেন, তাকেই তিনি 'নূতন' বলে অভিহিত করেছেন। আর এই নূতনত্বটুকুই হ’ল তার ঔপন্যাসিক ধর্ম।


বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সর্বত্রই উপন্যাস এ-কালের সৃষ্টি, আমাদের দেশেও ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটে পাশ্চাত্যের উপন্যাসের অনুকরণেই। কাজেই কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকে কোনক্রমেই উপন্যাস বলে অভিহিত করা সঙ্গত কিংবা সম্ভব নয়। উপন্যাস একান্তভাবেই বাস্তবধর্মী সাহিত্য, কিন্তু মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে পরিপূর্ণ বাস্তবতা অকল্পনীয়, কারণ তাতে অলৌকিকতা অপরিহার্য। অতএব আমরাও কোনক্রমেই মুকুন্দ রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকে 'উপন্যাস' বলে অভিহিত করতে পারিনা, কিন্তু তাতে যে বিভিন্ন ঔপন্যাসিক গুণ ও লক্ষণ বর্তমান রয়েছে গ্রন্থ-বিশ্লেষণে এ কথাও অস্বীকার করবার উপায় নেই।


উপন্যাসের প্রধান শর্ত একটি প্রধান নিটোল কাহিনী। কয়েকটি বাস্তব চরিত্রের সহায়তায় বিভিন্ন কর্মতৎপরতা এবং কার্যকারণের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে এই কাহিনীকে গড়ে তোলা হয়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রথম খণ্ডে আসলে রয়েছে দু'টি কাহিনী একটির সঙ্গে অপরটির বাস্তবে কোনো অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই, কিন্তু মঙ্গলকাব্য বলেই দ্বিতীয় তথা প্রধান কাহিনীটির উৎপত্তি ঘটেছে প্রথম কাহিনীটির অনিবার্য তাগিদে। প্রথম কাহিনীটি—হর গৌরীর কাহিনী এবং দ্বিতীয়টি কালকেতু ফুল্লরার কাহিনী।


চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে যে দেবীর মাহাত্মা কীর্তন করা হয়েছে, তিনি দেবী চণ্ডী—যাঁকে আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নরূপেই দেখানো হয়েছে। চণ্ডীর একটি চণ্ডমুগুবিঘাতিনী' প্রচণ্ড চামুণ্ডারূপা পরিচয় আমাদের পুরাণে থাকলেও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তাকে কখনো অশুভ শক্তির প্রতীকরূপে দেখা যায় না। বরং গ্রন্থের প্রথম কাহিনী ‘দেবখণ্ডে’ তিনি পৌরাণিক দেবী সতী এবং উনা রূপেই দেখা দিয়েছেন। দক্ষকন্যা সতী ছিলেন শিবের প্রথমা পত্নী। দক্ষযজ্ঞে দক্ষ শিবনিন্দা করলে পতিনিন্দা শ্রবণে সতী দেহত্যাগ করেন। তিনি আবার হিমালয়-গৃহে মেনকা গর্ভে পার্বতী উমা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তপস্যার বলে উমা এ জন্মেও শিবকে পতিরূপে লাভ করেন এবং বিবাহের পর স্বামীগৃহেই অবস্থান করেন। মেনকার সঙ্গে মনান্তর হ'লে উমা স্বামীকে নিয়ে পতিগৃহ কৈলাসে চলে আসেন। আর্থিক অনটনের জন্য এখানেও স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয় এবং তার ফলেই দেবী মর্ত্যলোকে নিজের পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচারে সচেষ্ট হন। শিবের সহায়তায় তিনি ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপগ্রস্ত ক'রে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেন–উদ্দেশ্য, মর্ত্যলোকে তিনিই দেবীর পূজা প্রচার করবেন। নীলাম্বর মর্ত্যলোকে কালকেতু-রূপে এবং নীলাম্বর পত্নী ছায়া ফুল্লরা-রূপে জন্মগ্রহণ করেন। এই কালকেতু-ফুল্লরা নিজেই গ্রন্থের প্রধান বাহিনী। হরগৌরীর কাহিনীটিকে স্বর্গখণ্ডের অন্তৰ্গত বলা হলেও এতে কোনো অলৌকিক জগতের বিবরণ নেই। এ একেবারেই লৌকিক জগতের নিম্নবিত্ত ঘরের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী। সামান্য কাঁচি চালিয়েই এটিকে একালের কাহিনীতে পরিণত করা যায়। এটি প্রধান কাহিনী নয় বলেই এতে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে না; নতুবা এর মধ্যেও বাস্তবতা, চরিত্রচিত্রণক্ষমতা, মনস্তত্ত্ব-জ্ঞান প্রভৃতির অপূর্ব সমাহার লক্ষ্য করা যায়। এই কাহিনীটির পরিকল্পনায় কবি নিজস্বতারও কিছু পরিচয় দিয়েছেন। অন্যান্য কবিদের কাব্যের মতো দেবীর উগ্রমূর্তি নেই এখানে, পরিবর্তে মাতৃকেন্দ্রিক বাঙালী জীবনে দেবীকে মধ্যবিত্ত বাঙালী গৃহিণী ক'রে উপস্থাপিত করায় সাধারণ বাঙালী এঁকে একান্ত আপনার করে নিতে পেরেছে।


গ্রন্থের প্রধান কাহিনী—কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনী। অনুমান করা হয়, কাহিনীটি সম্ভবত পাঁচালী আকারে কবিকঙ্কণের বহু পূর্ব থেকেই জনসাধারণের নিকট পরিচিত ছিল। চৈতন্য জীবনীকার বৃন্দাবন দাস সমকালের নবদ্বীপের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, 'মঙ্গলচণ্ডীর গতী করে জাগরণে। কাজেই এই অতি-প্রচলিত কাহিনীর রূপান্তর সাধন কবিকঙ্কণের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না, হয়তো বা রূপান্তরিত আকারে এটি গ্রহণযোগ্যও হতো না। তাই কাহিনীতে মৌলিকত্ব দেখানোর কোনো চেষ্টাই কবি করেন নি, কিন্তু প্রচলিত কাহিনীর ঘটনাপারস্পর্যের মধ্যে যেখানেই তিনি সামান্যতম ফাক পেয়েছেন সেখানেই মূল কাহিনীধারার সঙ্গে স্বকীয় ধারা মিশিয়ে দিয়েছেন অতি নিপুণভাবে।


উপন্যাসকে তুলনা করা হয় মহাকাব্যের সঙ্গে, কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গলে এই মহাকাব্যের লক্ষণ প্রকট। ডঃ সুকুমার সেনও বলেছেন, বইটির মধ্যে মহাকাব্যের (epic) ঔদার্য গুণ কিছু আছে। ফলে এর গতি মহর–পারিপার্শ্বিককে সঙ্গে নিয়ে এই গ্রন্থ একটু একটু ক'রে এগিয়েছে। কালকেতুর বাল্যজীবন কবিকঙ্কণের হাতে যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং উপযুক্ত সুযোগ পেলে যে তা বিকশিত হ'য়ে উঠতে পারে কবি তারও ইঙ্গিত ক'রে রেখেছেন। কালকেতুর কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে কবি শুরু করেছেন নিদয়ার গর্ভসঞ্চার, সাধ ভক্ষণ, কালকেতুর জাতকর্মাদি, তার বিবাহের জন্য ঘটক নিয়োগ এবং বিবাহের গন্ধাধিবাস থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে। কবি যেমন কাহিনীর সমগ্রতাসাধনে তৎপর হয়েছেন, তেমনি তার বাস্তবতাবোধ এবং সমাজসচেতনতা বিষয়ে আপন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। পুত্র-পুত্রবধূকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত ক'রে দিয়ে ধর্মকেতু ধর্মসাধন- উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কাশীবাসী হ'লেন। গ্রন্থের নায়ক কালকেতু হ'লেও কবি অপরাপর চরিত্র বা কাহিনীর প্রতি উদাসীন নন। কাহিনীর সম্পূর্ণতা সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থাই তিনি অবলম্বন করেছেন।


এরপর দৈবকৃপায় প্রচুর ধন লাভ ক'রে কালকেতু গুজরাট বন কেটে নগর পত্তন করলেন এবং বিভিন্ন জাতীয় ও বৃত্তিধারী প্রজা বসালেন। এই প্রজাদের মধ্যে একজন ছিল ভাঁড়ু দত্ত উপন্যাসোপম 'চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম খল চরিত্র। কালকেতুর জীবনে এটি মুর্তিমান শনিগ্রহ। অবশ্য এ কথাও সত্যি যে, এই চরিত্রটির জন্যই পরবর্তী ঘটনায় যেমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তেমনি তা প্রচণ্ড গতিও লাভ করেছে। প্রভূত পরিমাণ বুদ্ধির খেলা ও নির্বুদ্ধিতা, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নায়ক কালকেতু জয়ী হয়ে স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পুত্র পুষ্পকেতুর হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে গমন করেন।


কাহিনী-সৃষ্টিতে গতানুগতিকতার মধ্যেও মুকুন্দ কবি যেমন তার প্রতিভার পরিচয় দান করেছেন, তেমনি বাস্তবানুগ চরিত্র সৃষ্টিতেও তিনি যথার্থ সার্থকতা অর্জন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সমগ্র কাব্যে একমাত্র ফুল্লরা ছাড়া অপর কোনো চরিত্রের উৎকর্ষ স্বীকার করেন নি. তিনি কালকেতুকে 'একটা বিস্তৃত বৃহৎ স্থাণুমাত্র’ বলে অভিহিত করেছেন কিন্তু বাস্তব বিচারে কালকেতু-চরিত্রের যে অবস্থানুযায়ী যথেষ্ট বিকাশ সাধিত হয়েছিল তা' অস্বীকার করা চলে না। কালকেতুর বর্ণনায় কবি যদিও বলেছেন, 'শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিকাল। ছোট গ্রাস তোলে যেন তে-য়াটিয়া তাল।' এবং সে হাঁড়ি হাঁড়ি সুপ এবং খুদের জাউ খায়, তাহলেও সে একটা জরগব স্থাণুমাত্র নয়—এমন উল্লেখযোগ্য পরিচয় পাওয়া যায় বনের পশুদের ওপর অত্যাচারে। কবি এই অত্যাচারের যে বিবরণ দিয়েছেন তাকে ডিহিদার মামুদ সরীফের অত্যাচারের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। কাজেই কালকেতু যে অসাধারণ শক্তিমান পুরুষ ছিল, তা’ অস্বীকার করা চলে না। এখানে আরও একটি মন্তব্য আছে। পশুদের সঙ্গে ব্যবহারে তাকে অতিশয় অত্যাচারী বলেই মনে হয়, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে জড়িত রয়েছে তার জীবিকার প্রশ্ন। অতিশয় দারিদ্র্য্যই কালকেতুকে যেন অত্যাচারী শাসকে পরিণত করেছিল। কিন্তু যখন আর তার অর্থ কৃচ্ছতা রইল না, তখন কিন্তু কালকেতু একজন আদর্শ জনহিতব্রতী শাসকে পরিণত হ'ল। গুজরাট নগর পতনে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর প্রতি তার যে সমাদর লক্ষ্য করা যায়, কৃষক প্রজাদের প্রতি তার যে সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়, চরিত্রের যথোচিত বিকাশ না ঘটলে তেমনটি হওয়া সম্ভব নয়। কালকেতু কলিঙ্গ-রাজার বিরুদ্ধে যথেষ্ট বীরত্বেরও পরিচয় দিয়েছেন। তার পরাজয়ের পশ্চাতে রয়েছে স্ত্রী ফুল্লরার নির্বুদ্ধিতা এবং ভাড়ুদত্তের শঠতা।


ভাড়ুদত্ত কবিকঙ্কণের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, চরিত্রটি কবির মৌলিক আবিষ্কার না হলেও স্বল্প পরিসরে চরিত্রটিকে কবি সম্পূর্ণতা দানে সক্ষম হয়েছেন। চরিত্রটি সম্পর্কে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বলেন, “এই সবচেয়ে গ্রাম্য ব্যক্তিটি সাহিত্যিক গ্রাম্যতাদোবের ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে।” ভাড়ুদত্ত নিজের কথা বার্তায় এবং আচার-আচরণে অতিশয় জীবস্ত হ'য়ে উঠেছে। সমগ্র কাব্যে এই চরিত্রটির উৎকর্ষ বিষয়ে সমালোচকগণ অভিন্নমত ঠিক অনুরূপ অপর একটি চরিত্র অতিশয় দুঃশীল মুরারী শীল। এই চরিত্রটি কবিকঙ্কণের নিজস্ব সৃষ্টি এবং এর ক্রিয়াশীলতা কাব্যের স্বল্পতম স্থানেই আবদ্ধ। তাই, কস্তুত কলমের দু’টি-একটি আঁচড়ে এমন একটি চরিত্র সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্যে আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। মুরারী শীল আর তার স্ত্রী ঠিক যেন 'হাঁড়ির মুখে সরা'। শ্রেণীগত এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই চরিত্রযুগল ষোড়শ শতকের পটভূমিকায় এক চিরন্তন মানবচরিত্র হয়ে আছে।


কালকেতু-কাহিনীতে একটিমাত্রই উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্র–ফুল্লরা চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিলাভে ধন্য। তাঁর মেয়েলির বুদ্ধির তথা কবির নারীমনস্তত্ত্বজ্ঞানের পরিচয় ফয়েক স্থানে অতিশয় সুস্পষ্ট। ষোড়শীরূপিণী দেবীকে ভুল বুঝে তাকে তাড়ানোর চেষ্টায় ফুল্লরা প্রভূত পরিমাণে যুক্তি-তর্ক ও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছে। তারপর বারমাস্যায় তার সম্বৎসর ব্যাপী দুঃখদৈন্যের যে চিত্র ফুণ্মরা তুলে ধরেছে, তাতে তার বাস্তববুদ্ধিরও সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও যখন ঐ ষোড়শীকে সরানো সম্ভবপর হ’ল না—তখন বুঝলো, কালকেতুই বোধ হয় এর জন্য দায়ী। তাই কালকেতুর প্রতি সে প্রয়োগ করলো নারীর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র চোখের জল। ফুল্লরা যে প্রকৃতই একটি দরিদ্র ব্যাধকন্যা প্রকৃত ধনরত্নের সঙ্গে যে তার পরিচয় নেই এবং তার মূল্যও যে বোঝে না, তার প্রমাণ দেবীপ্রদত্ত মাণিক্যের অঙ্গুরী গ্রহণে অস্বীকৃতি। এটি তার লোভহীনতার পরিচয় নয় – দৈবধন পেলে যে তা ঘড়াভরতি হওয়া চাই–ঐ দিকেই তার লোভ। ব্যাধকন্যার পক্ষে এইটিই স্বাভাবিক এবং বাস্তবতাসম্মত। ফুল্লরার স্ত্রীবুদ্ধি তথা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে ভাডু দত্তের কূটবুদ্ধির নিকট পরাজয়ে। বস্তুত এই সমস্ত দুর্বলতা এবং অসঙ্গতির জন্যই ফুল্লরা এত স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।


কবিকঙ্কণের বাস্তবচিত্রাঙ্কন ক্ষমতা, সমাজ সচেতনতা ও মনস্তত্ত্বজ্ঞানের উৎকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় চণ্ডীমঙ্গলের বিভিন্ন উপকাহিনীতে এবং ঘটনা পরম্পরায়। 'গ্রন্থোৎপত্তির বিবরণ' হরগৌরীর সংসারযাত্রা, পশুদের কাতর ক্রন্দন, ফুল্লরার বারমাস্যা, গুজরাট নগর পত্তন প্রভৃতি উপকাহিনীর বিশ্লেষণেই আমরা মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রকৃত প্রতিভার পরিচয় পাই—এই পরিচয় ঔপন্যাসিক মুকুন্দ চক্রবর্তীর। কবি মুকুন্দর এই কৃতিত্ব বিষয়ে একটু বিস্তৃতভাবেই আলোচনা করেছেন ডঃ সুকুমার সেন। তিনি লিখেছেন “...দেশি বিদ্যায় অর্থাৎ লোক-ব্যবহার, ছেলে-ভুলানো, ছেলেখেলা, মেয়েলি ক্রিয়াকাণ্ড, ঘরকান্নার ব্যবস্থা, রান্নাবাড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অনপেক্ষিত সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারেও তিনি বিস্ময়কর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণ নরনারীদের মনে সাংসারিক ঘটনা-দুর্ঘটনায় যে স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত তাহা তিনি সুনিপুণ অথচ অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে প্রতিফলিত করিয়াছেন। শুধু আপনার বা প্রতিবেশীর ঘরের কথায় নয়, নিজের বা আশেপাশের সমাজের কথায়ও নয়, দেশের যেখানে যতটুকু তাহার গোচরে আসিয়াছিল তাহার সবকিছুতেই তাহার কৌতূহল ছিল। সে কৌতূহল তাহার রচনার স্থানে স্থানে প্রস্ফুটিত হইয়া তাহার শিল্পকে সমসাময়িক মানের ঊর্ধ্বে তুলিয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আগে বাঙ্গালা ভাষায় যদি এমন কোনো একটি গ্রন্থের নাম করিতে হয় যাহাতে আধুনিক কালের সাহিত্যবস্তুর উপন্যাসের রস কিছু পরিমাণেও পাওয়া যাইতে পারে তবে সে গ্রন্থ কী—তাহা সহৃদয় যিনি মানে বুঝিয়া মুকুন্দের রচনা পড়িয়াছেন তিনিই বুঝিবেন। নিপুণ পর্যবেক্ষণ, সহহৃদয়তা, জীবনে আস্থা, ব্যাপক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি যে-সব গুণ ভালো উপন্যাস লেখকের রচনায় প্রত্যাশিত যে-সব গুণ, সেকালের পক্ষে যথোচিত পরিমাণে, মুকুন্দের রচনাতেই পাই। বাঙ্গালা দেশের এবং বাঙ্গালী মানুষের এমন পরিপূর্ণ চিত্র বাঙ্গালা সাহিত্যের আর কোথাও মিলে কিনা সন্দেহ।”