সাধক কবি কমলাকান্তের কবিকৃতির মূল্যায়ন | পাঠ্য পদগুলি অবলম্বনে কমলাকান্তের কবি প্রতিভার পরিচয়

শাক্তপদ-রচনায় কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের বিশিষ্টতা


শাক্ত পদাবলী রচয়িতা হিসাবে কমলাকান্তের কাব্যপ্রতিভার লক্ষণীয় দিকগুলি চিহ্নিত করো।

মধ্যযুগের একেবারে অস্তিমলগ্নে সাধক কবি রামপ্রসাদের হাতে শাক্তপদাবলীর আবির্ভাব ঘটলেও তা’ ক্রান্তিকাল উত্তীর্ণ হয়ে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে- মধ্যযুগের অপর কোনো কাব্যধারা এই সুযোগ লাভ করতে পারেনি। ফ্রান্তিকালের কবি, যাত্রা, তর্জা, পাঁচালী, আখড়াই আদি গীত-রচয়িতারাও অনেকেই কিছু কিছু শাক্তপদ রচনা করেছেন। একালের কবি মধুসুদন বৈষ্ণব কবিতার আদর্শে 'ব্রজাঙ্গনা কাব্য' রচনা করলেও তা' বৈষ্ণব কবিতা হয়নি, অথচ তার একটি কবিতাকে নিঃসন্দিগ্ধভাবেই শাক্তপদ বলে গ্রহণ করা চলে। এমন কি রবীন্দ্রনাথকেও শাক্তপদ রচয়িতা বলে অভিহিত করা চলে। এই তিন যুগে ব্যাপ্ত শাক্তপদের উদ্ভাবক রামপ্রসাদের নামের পরই যে নামটি স্বভাবত উচ্চারিত হয়ে থাকে, সেই নামটি ‘দ্বিজ কমলাকাস্ত'। কমলাকান্তও ছিলেন সাধক– দেবী বিশালাক্ষীর উপাসক; তিনি ছিলেন জ্ঞানী পণ্ডিত, তিনি ছিলেন বর্ধমানরাজের সভাপণ্ডিত এবং সম্ভবত রাজগুরুও; সর্বোপরি তিনি ছিলেন প্রকৃত কবিপ্রতিভার অধিকারী, সচেতন কবিশিল্পী। তিনি রামপ্রসাদের মতো শুধু ভাবের ঘোরেই পদ রচনা করেন নি, তিনি যেন সজ্ঞানেই সাহিত্যসাধনা করেছিলেন। কমলাকান্ত রচিত পদের সংখ্যা অস্তত পক্ষে আড়াইশ'।


সাধক কবি কমলাকান্ত বিভিন্ন ধারার পদ রচনা করলেও তার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে ‘আগমনী-বিজয়া’র পদে। বস্তুত আগমনী-বিজয়ার শ্রেষ্ঠ পদগুলির অধিকাংশ কমলাকান্ত রচিত। অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “রামপ্রসাদে যে 'আগমনী' গানের সূচনা, কমলাকাস্তে তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ। মাতা, পিতা, কন্যা ও স্বামীর মনস্তত্ত্ব-উদ্ঘাটনে কমলাকান্ত নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন। কমলাকান্তের আগমনী গান ভরা ভাদরের নদীর মত বেগবতী— উচ্ছ্বাস, উদ্বেল; তাহার বিজয়া সঙ্গীত বিজয়ার সানাইয়ের মত করুণ ও মর্মস্পর্শী।"


দ্বিজ কমলাকান্ত আগমনী বিজয়ার যে বিচ্ছিন্ন পদগুলি রচনা করেছেন, সেগুলিকে যথার্থভাবে জুড়ে দিতে পারলে বস্তুত একটি কাহিনীই দাঁড়িয়ে যায়—গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার একমাত্র কন্যা উমা, তিনি মহাদেব শঙ্করের সঙ্গে বিবাহিতা। বিবাহের পর তিনি পতিগৃহেই রয়েছেন। মেনকা দীর্ঘকাল কন্যা-দর্শন থেকে বঞ্চিতা তাই যত দিন যায়, মাতৃহৃদয় ততই হাহাকার ক'রে ওঠে। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে মেনকার মাথায় মনে শুধু উমার ভাবনা। তিনি স্বপ্নে দেখলেন

আমি কি হেরিলাম নিশি-স্বপনে।

এই এখনি শিয়রে ছিল,    গৌরী আমার কোথায় গেল হে, 

আধ আধ মা বলিয়ে বিষ্ণু-বদনে।”


কন্যা উমাকে স্বপ্নে দেখবার পর মায়ের মন বড় উচাটন হয়ে ওঠে। তিনি পতিগৃহবাসিনী উমার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছেন, স্বামী তার সংসারী নয়- পাগলের মতো ব্যবহার—

শুনেছি নারদের ঠাঁই    গায়ে মাখে চিতা ছাই:

ভূষণ ভীষণ তার, গলে ফণি-হার।

এ-কথা কহিব কায়,    সুধা তাজি বিষ খায়,

কহ দেখি এ কোন্ বিচার।।”


অতএব একবার গৌরীকে দেখতে না পেলে আর মন মানছে না, মেনকা গিরিরাজকে বারবার অনুরোধ জানান, তিনি কৈলাসে গিয়ে পতিগৃহ থেকে কন্যা উমাকে একবার নিয়ে আসুন। গিরিরাজ ধৈর্যশীল পুরুষ। তিনি জানেন, পতিই কন্যা উমার জীবনের সারাৎসার, তেমনি জামাতা শঙ্করও উমাহীন সংসারের কথা কল্পনা করতে পারেন না। কাজেই তিনি গেলেই যে শঙ্কর ঊমাকে ছেড়ে দেবেন, এমন মনে হয় না। তাই তিনি বলেন,—

'বারে বারে বহ রাণী    গৌরী আনিবারে।

জান তো জামাতার রীত অশেষ প্রকারে।।

বরঞ্চ ত্যজিয়ে মণি    ক্ষণেক বাঁচয়ে ফণী।

ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা মারে।।

তিলে না দেখিলে মরে    সদা রাখে হৃদি পরে। 

সে কেন পাঠাবে তারে সরল অস্তরে।।'


কিন্তু স্বামীর যুক্তিতে মেনকা কর্ণপাত না করে আবেদন জানালেন নারীহহৃদয়ের ব্যথা দরদ মিশিয়ে—

'কামিনী করিল বিধি,    তেঁই হে তোমারে সাধি,

নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে।'


এবার মেনকার আবেদনকে তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না, অতএব ধীরগতিতে তিনি চলেন কৈলাসের পথে।

'গিরিরাজ গমন করিল হরপুরে। 

হারিয়ে বিষাদে প্রমোদে-প্রমাদে

ক্ষণে দ্রুত ক্ষণে চলে ধীরে।।'

কৈলাসে উপনীত হয়ে গিরিরাজ কিন্তু সরাসরি জামাতা শঙ্করের কাছে গেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, কার্য উদ্ধারের জন্য গৌরীমায়ের সঙ্গেই আগে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন। তাই

'প্রবেশি কৈলাসপুরী    না ভেটিয়ে ত্রিপুরারি

গমন করিল গিরি শয়ন-মন্দিরে।'

পিতার মুখে মাতৃহহৃদয়ের ব্যাকুলতার কথা শুনে গৌরী শঙ্করের নিকট -

গঙ্গাধর হে শিব শঙ্কর    কর অনুমতি হর

যাইতে জনক-ভবনে।'


হঠাৎ কেন পিতৃগৃহে যাবেন, তার কারণস্বরূপ তিনি জানালেন তিনি মাকে স্বপ্নে দেখেছেন

মায়ের ছল ছল দুটি আঁখি    আমারে কোলেতে রাখি

কত না চুম্বয়ে বদনে।


অতএব স্বামী মহাদেবের আর আপত্তির অবকাশ রইল না। তিনি গৌরীকে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি দান করলেন। এবার গিরিরাজ গৌরীকে নিয়ে চলে এলেন তার মায়ের কাছে।


গৌরী আসছেন—এই সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরবাসিনীদের প্রতিক্রিয়াটিও যথাযথভাবে কমলাকান্তের লেখনিতে ধরা পড়েছে—

'যত নগর-নাগরী সারি সারি দৌড়ি গৌরী-মুখ পানে চায়।। 

কারু পূর্ণ কলসী কক্ষে কারু শিশু-বালক বক্ষে,

কারু আধ শিরসি বেণী, কারু আধ অলকাশ্রেণী:

বলে, 'চল চল চল, অচল-তনয়া হেরি ও মা দৌড়ে আয় ।।'


জননী মেনকা কিন্তু সংবাদটি পেয়েই পাগলিনীর মত ছুটে বেরুলেন

'অমনি উঠিয়ে পুলকিত হৈয়ে ধাইল যেন পাগলিনী।

চলিতে চঞ্চল, বসিল কুস্তল, অঞ্চল লোটায়ে ধরণী।।'


কিন্তু মাত্র ত্রিরাত্রি বাসের পরই যখন মহাদেব শৃঙ্গধ্বনি করে হিমালয় গৃহে উপস্থিত হয়ে জানালেন যে তিনি গৌরীকে নিয়ে যেতে এসেছেন, তখন মেনকা জয়াকে মধ্যস্থ করে বলছেন—

'জয়া, বল গো পাঠানো হবে না।

হর, মায়ের বেদনা কেমন জানে না।'


স্বভাব-সিদ্ধ কবিত্বের অধিকারী কমলাকান্ত আগমনী-বিজয়ার গানে পারিবারিক সম্পর্কে বয়নসূত্রে স্বাভাবিকভাবেই কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি একজন সিদ্ধপুরুষও ছিলেন। তাই শাক্তপদাবলীর তাত্ত্বিক পদগুলিতেও তিনি যথার্থ কবিত্বশক্তি প্রদর্শনের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। তবে সাধনার ব্যাপারে রামপ্রসাদের সঙ্গে কমলাকাস্তের একটি প্রধান পার্থক্য এই রামপ্রসাদ জগজ্জননীকে এতটাই কাছে পেয়েছিলেন যে মায়ের প্রতি ছেলের অভিমান, অভিযোগ আদি যেমন স্বাভাবিক বলে মনে হয়, রামপ্রসাদের মধ্যে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে, কমলাকান্ত যেন উভয়ের মধ্যে একটু দূরত্ব বোধ করতেন, এমন অভিমানের সুর তার রচনায় দুর্লভ। তবে মায়ের অভয় চরণের আশ্রয়টুকুই তারও কামনার বস্তু।


জনৈক অধ্যাপক সমালোচক বলেন: “ভক্তিপূর্ণ বিশ্বস্ত মাতৃসেবার মধ্যে কমলাকান্তের শাস্ত নিরুদ্বিগ্ন জীবনে যে আত্মোপলব্ধি ঘটিয়াছিল তাহাই তাহার সঙ্গীত সাধনায় অনুপ্রেরণার সঞ্চার করিয়াছিল। মাতৃসাধনার ব্যাকুলতাই তাহার কণ্ঠে সুর হইয়া বাজিয়াছে, সঙ্গীতে পল্লবিত হইয়াছে এবং লোকচেতনায় সঞ্চারিত হইয়াছে। রামপ্রসাদের মত তাঁহার গানে বিচিত্র সুর ধ্বনিত না হইলেও সুরুচি সংযোগবোধ, ভক্তের নিবিড়তা ও জ্ঞানের প্রভা কমলাকাস্তের রচনায় যে ভাব-গম্ভীর পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করিয়াছে, তাহাতে তাহার শ্যামাসঙ্গীতগুলি গাম্ভীর্যের সুদুর্লভ মহিমায় মহিমান্বিয় হইয়া উঠিয়াছে।”


রামপ্রসাদের মতো কমলাকান্তও ছিলেন সমন্বয় সাধক। তাই তার দৃষ্টিতে

'কালী কেবল মেয়ে নয়

মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ

কখন কখন পুরুষ হয়।'


কমলাকান্ত সাধনার এমন স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হলে আর বাইরের যাগযজ্ঞ পূজা পার্বণের প্রমোজন হয় না—

'তীর্থগমন, দুঃখভ্রমণ, মন উচাটন হয়ো না রে। 

তুমি আনন্দ -ত্রিবেণীর স্নানে শীতল হও না মূলাধারে।।'


সাধক তখন হন মানসপুজার অধিকারী, আপন উপাস্য দেবতাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে নীরবে নিভৃতে চলে ভগবানের সঙ্গে ভক্তের প্রেমলীলা। বিষয়সুখের প্রতি ভক্তের তখন আর কোনো আকর্ষণ থাকে না।

‘আদর করে হাদে রাখ আদরিণী শ্যামা মাকে।

তুমি দ্যাখ আমি দেখি আর যেন ভাই কেউ না দেখে।।

কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি আয় মন বিরলে দেখি।

রসনারে সঙ্গে রাখি সেও যেন মা বলে ডাকে।।'

সাধক কবির তখন সুখে দুঃখে সমানুভূতি, আচার ও লৌকিক বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত।

'মজিল মনমরা কালীপদ নীলকমলে।

যত বিষয়মধু তুচ্ছ হলো কামাদি কুসুম সকলে।।

চরণ কালো ভ্রমর কালো কালোয় কালো মিশে গেল।

দেখ, সুখদুঃখ সমান হল, আনন্দসাগর উথলে।।'


কোনো কোনো সমালোচকের মতে কমলাকান্ত সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করতে পারেন নি কিন্তু তাদের সংশয় যে অমূলক তার প্রমাণ পাওয়া যাবে কমলাকাস্তের নিম্নবর্ণিত পদটিতে

'সদানন্দমরী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী গো মা।

তুমি আপন সুখে আপনি নাচ, আপনি দাও মা করতালি।। 

আদি ভূতা সনাতনী, শূন্য রূপা শশী ভালী। 

যখন ব্ৰহ্মাণ্ড না ছিল হে মা, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।। 

সবেমাত্র তুমি যন্ত্রী, যন্ত্র আমরা তন্ত্রে চলি।

তুমি যেমন রাখ তেমনি থাকি, যেমন বলাও তেমনি বলি।।'


কমলাকাস্ত ছিলেন রাজসভার কবি, কিন্তু ভারতচন্দ্র কিংবা রামপ্রসাদের মতো তিনি রাজসভার উচ্ছৃঙ্খল বিলাসকলা কিংবা আড়ম্বর জৌলুস দ্বারা প্রভাবান্বিত হন নি। তাঁর রচনায় অশ্লীলতা এবং গ্রাম্যতাদোষ নেই, রুচির বিকারও নেই। কমলাকান্তের রচনায় বৈষ্ণবীর বিনতি বা আকৃতি লক্ষ্য করা যায়— তিনি কখনও উদ্ধত বা স্পর্ধিত হয়ে উঠতে পারেন নি। কমলাকাস্ত ছিলেন সচেতন শিল্পী – ছন্দের মাধুরী এবং শ্রুতিমধুর শব্দ-অলঙ্কারের প্রতি ছিল তার সজাগ - দৃষ্টি। তাই তার পক্ষে রচনা করা সম্ভব এমন পদ

‘শুকনো তরু মুঞ্জরে না, ভয় লাগে মা ভাঙ্গে পাছে।

তরু পবন বলে সদাই দোলে, প্রাণ কাপে মা থাকতে গাছে।।'


কমলাকাস্ত সম্বন্ধে অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ সুনির্বাচিত শব্দের প্রতি অনুরাগ এবং শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের বিচিত্র কারুকার্য কমলাকান্তের এই পদাবলীকে গাঢ়বদ্ধ ভাবগূঢ় গীতিকবিতার সৌন্দর্য ও মাধুর্যে পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। এইখানেই শাক্তকবি কমলাকান্ত ও বৈষ্ণব মহাজন গোবিন্দদাস কবিরাজ সমধর্মী উভয়েই ভক্ত অথচ সচেতন রূপদক্ষ শিল্পী।"