আঙ্গিক-প্রসঙ্গ : সংস্কৃতচিন্তা ও লোকচেতনার সমন্বয় (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে)

আঙ্গিক-প্রসঙ্গ : সংস্কৃতচিন্তা ও লোকচেতনার সমন্বয়


দুর্লভতা পণ্ডিতের লক্ষণ, কবির নয়; দুর্বোধ্যতা শাস্ত্রের লক্ষণ, কাব্যের নয়। তবু কাব্য যখন জটিলতর ও সুন্দরতর হয়ে ওঠে কথায় ও কুশীলবে, পৌরাণিক প্রকল্পনায় ও লৌকিক অভিজ্ঞতায়, ঝঙ্কারে অলঙ্কারে, সঙ্গীতে আর ভঙ্গীতে, সংঘর্ষে ও সমন্বয়ে, তখন অনুভব করা যায় তার পেছনে আছে স্রষ্টায় পাণ্ডিত্য এবং প্রজ্ঞাসিদ্ধ কল্পদৃষ্টি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য সাধারণের জন্য লেখা। তবু রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস যে আদৌ অপণ্ডিত ছিলেন না, গ্রন্থের স্তরে স্তরে তার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। তাঁর সেই সচেতন প্রবর্তনা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্নভাবে।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রথম লক্ষণীয় কবির কৃতিত্ব, পুরাণের প্রসঙ্গ গ্রহণে এবং তার পরিবর্তনে। জন্মখণ্ড বৃন্দাবন-কালীয়দমন-বস্ত্রহরণ ইত্যাদি খণ্ডে দেখা যায় ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, গীতগোবিন্দ, গর্গ সংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থের অংশবিশেষ অনুসরণ; স্থানে স্থানে আছে পৌরাণিক প্রসঙ্গের স্মৃতি-রতি (যেমন রাধা-কৃষ্ণের সংলাপ)। এই অনুসরণ কেন সামগ্রিক নয় সে সম্বন্ধে সংশয় জাগতে পারে। তবু বলা যায়, সব যুগে সব দেশে শিল্পীর একটি অনুচ্চারিত দাবী থাকেই অন্তরের নির্দেশ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেবার এবং তাকে রূপান্তরিত করার। তাছাড়া, ‘পুরাণ’ কথাটির মধ্যেই ছিল পূরণের ইঙ্গিত। তাই দান-নৌকা-যমুনা-হার-বংশী প্রভৃতি খণ্ডে রাধাকৃষ্ণের লীলাকথা অপৌরাণিক হলেও মূল কাহিনীর সঙ্গে সম্বন্ধ রেখে তাদের বিন্যাস করার মধ্যে স্রষ্টার মুন্সীয়ানার পরিচয় পাই। বস্তুতপক্ষে, তার গ্রহণ-বর্জন নীতিটির ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে একদিকে লোকায়ত জীবনের পক্ষে আস্থাশীল একটি সহৃদয় ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে সেই লোকায়ত কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে পুরাণ প্রসঙ্গের সঙ্গে সমতালে উপস্থাপনার মতো একটি মিশ্র আঙ্গিক। আবার কাহিনীর বহুমুখিনতা আঙ্গিকের মধ্যেও দেখা গেছে। একালীন গবেষকরা কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন উত্তরখণ্ডের ধামালী বা জাগের গানের সঙ্গে যোগ, কেউ দেখেছেন ‘ঝুমুর গানে'র আদর্শ, কেউ-বা অসমীয়া নাটকের কুশল বা সংস্কৃত নিয়ম-বিনির্ভর ‘নাট’ রীতির দেশীয় ঐতিহ্য-অনুসরণ (রাম সরস্বতী-কৃত ‘গীত গোবিন্দে’র অসমীয়া ভাষান্তর গ্রন্থ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য)। তথ্যগত সাক্ষ্যে অবশ্য ঠিক প্রমাণ করা যায় না, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র কবি বিশেষ কোন্ রীতিটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বোঝা যায়, এই বিচিত্র আঙ্গিক অনুসরণ করেই কবি-চিত্ত পেয়েছে সংলাপ সৃষ্টিতে আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য এবং প্রায় নাট্যকার-সুলভ নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ।


বড়ু চণ্ডীদাসের পাণ্ডিত্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত কাব্যের মধ্যে সংস্কৃত শ্লোক রচনা। (শ্লোকগুলি তাঁর স্বকীয় সৃষ্টি কি না সে সম্বন্ধে সমালোচক মহলে সংশয় আছে) একটি দুটি নয়, সমগ্র কাব্যে শ্লোক আছে ১৬১টি। কখনো স্বয়ং ব্যাখ্যায়, কখনো চরিত্রের মাধ্যমে যোজনার জন্য কাহিনীর পক্ষে তার ব্যবহার হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, অনুষ্টুভ, প্রমিতাক্ষরা, রসোদ্ধতা, তোটক, ইন্দ্ৰবজ্রা, মালিনী প্রভৃতি বিবিধ ছন্দে এগুলি রচনার ফলে সংস্কৃত ভাষায় কবির অধিকার এবং মণ্ডন-নিপুণতা হয়েছে সুচিহ্নিত। কাব্য মধ্যে পাহাড়ী রাগ, গৌরী রাগ, মালবশ্রী রাগ ইত্যাদি রাগ-রাগিণীর উল্লেখে কবির সঙ্গীতশাস্ত্রের অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়।


জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ' কাব্যের বহু পক্তির ভাবানুবাদ করার মধ্যেও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে কবির স্বচ্ছ ধারণার পরিচয় অনুভব করা যায়।


শুধু সর্গের সূচনায় সংস্কৃত শ্লোক সন্নিবেশে নয়, কাহিনীতে চরিত্রের শারীর-সমাচার রূপায়ণের মধ্যেও সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের আনুগত্য দেখা যায়— “ডমরু মধ্য নাভি গম্ভীরে” (তুলনীয় দৃষ্টাত্ত কুমারসম্ভবে, মধ্যেন সা বেদিবিলগ্নমধা বলিত্রয়ং চারু বভার বালা’), ‘তোহ্মার নয়নমলিন নলিন ধরে কোকনদরূপে” (তুলনীয় পক্তি গীতগোবিন্দের “নীলনলিনাভমণি ত্বন্বি তব লোচনম্ ধারয়তি কোকনদরূপম্”) ইত্যাদি। এছাড়া প্রেম ও বিরহ উপলক্ষে চন্দ্র, চন্দন, মলয়পবন, কিশলয়শয়ন প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের বহুব্যবহৃত কবিপ্রসিদ্ধিও বড়ু চণ্ডীদাস স্বীকার করেছেন তাঁর কাব্যে। যেমন “নিন্দএ চান্দ চন্দন রাধা সব খনে। গরল সমান মানে মলয় পবনে” বর্ণনা গীতগোবিন্দে যেমন আছে “নিন্দতি চন্দনসিন্ধু কিরণমনুবিন্দতি” ইত্যাদি শ্লোকে তেমনি আছে দশকুমারচরিতে অবস্তীসুন্দরীর আক্ষেপেও— “সখি চন্দ্রম-সংবাড়বানলাদতিতাপকরং মন্যে...” ইত্যাদি উক্তিতে। এইভাবেই “শরদ উদিত চান্দ বদনকমল”, “থলকমল মন্থরগমনে”, “বিধি কৈল জঙ্গমে কনকপ্রতিমা” প্রভৃতি অলংকার মূলতঃ সংস্কৃত কবিদেরই হাতে গড়া অলংকারের পুরোনো প্যাটার্ন মাত্র। দানখণ্ডে কৃষ্ণ যখন রাধার রূপবর্ণনায় বলে—

“নীল জলদসম কুম্ভলভারা। 

বেকত বিজুলি শোভে চম্পকমালা ।।”

তখন মনে হয় এর অলঙ্কারের সোনা সনাতনী, তবু কারুকার্য প্রায় নতুন।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে চরিত্রগুলি রুচিবোধে তাদের উক্তি-প্রত্যুক্তি অবলম্বন করে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায় একটি তির্যক রস-পরিহাসের বুদ্ধিবিলাস। যেমন দানখণ্ডে কৃষ্ণ যখন বলে রাধা রূপ দেখে তার “প্রাণ যেহ্ন ফুটি জাএ বুক মেলে চীর” তখন রাধার মুখের মতো জবাব বা “রিট্রট” – “যার প্রাণ ফুটে বুকে ধরিতে না পারে। গলাত পাথর বান্ধী দহে পসী মরে ।।” সাধারণতঃ রাধার কথাতেই এর বহুল প্রকাশ। তবে কৃষ্ণের মধ্যেও পাই। যেমন রাধা যখন কৃষ্ণের নির্লজ্জ বাসনাকে লজ্জা দিয়ে বলে— “গঙ্গাজলে পৈস গলে কলসি বান্ধিআঁ” তখন কামুক কৃষ্ণের স্বভাবসুলভ উক্তি—“তোর দুই কুচকুম্ভ বান্ধি নিজ গলে। বোল রাধা পৈসোঁ মো লাবণ্যগঙ্গাজলে ৷৷” বলা বাহুল্য, এ ধরনের অসংখ্য পক্তি সৃষ্টির মূলে কৃতবিদ্য কবি-চিত্তের এক বিশিষ্ট রস-দৃষ্টি অনুভব করা যায়।