শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন


চর্যাপদে এবং জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’র মধ্যে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের যে প্রারম্ভিক নিদর্শনটি রূপ ও রেখার অঙ্কিত, বড়ু চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ তা অপূর্ব বর্ণ গরিমায় বিকশিত। কাব্যটির জনপ্রিয়তার কারণ, এই কাব্য বাঙালীর জীবনধর্মের সঙ্গে অদ্বৈত সম্পর্কযুক্ত। লিপিতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের বিচারানুযায়ী বিদগ্ধ পণ্ডিতসমাজ গ্রন্থটিকে প্রাক্-চৈতন্যযুগের সারস্বতার্ঘ্য বলে মন্তব্য করেছেন।


১৩১৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘরের মাচা থেকে শ্রদ্ধেয় বিদ্বদ্বল্লভ বসন্তরঞ্জন রায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ পুঁথিটি উদ্ধার করে ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশ করেন। তখন থেকে এ কাব্যটিকে ঘিরে চণ্ডীদাস সমস্যার রহস্যাবরণের সূত্রপাত হয়। শুধু ভাষা, রচয়িতা ও রচনাকাল নয়, কাব্যটি কোন্ আঙ্গিক লক্ষণাক্রান্ত তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে উঠেছে বিতর্কের ফেনিল স্রোত। কারুর মতে কাব্যটি ট্র্যাজেডি, হাস্যরসের প্রাবল্য দেখে অনেকে একে ‘কমিকের’ অভিধায় অভিযুক্ত করেছেন। কামাসক্ততার উলঙ্গ প্রকাশ দেখে ভক্ত-সমালোচক একে পদাবলীর পূত অঙ্গন থেকে বহিষ্কারে দৃঢ়সংকল্প, আবার চিরন্তনী ধারার অনশ্বর প্রেমের পরিচয় পেয়ে অনেকে একে যূথিকাশুভ্র পদাবলীর অন্দরমহলের অভ্যন্তরে স্থান দিতেও স্বীকৃত। জটিল ঘটনাবর্তের দ্রুত নাটকীয় প্রকাশভঙ্গী দেখে কেউ এঁকে বলেছেন ‘নাট্যগীতি কাব্য’, আবার 'বংশী' খণ্ডে ও ‘বিরহে’র মধ্যে এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা দেখে অনেকে কাব্যটিকে দিয়েছেন ‘গীতিকাব্যের’ কল্পলোকে প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র। আসলে সমস্ত উপাদানের বেণীবন্ধনে গ্রন্থটি কায়ানির্মিত। সকল উপাদানের মাত্রা অবশ্য সমান নয়। নাটক গীতিকবিতার বেলাভূমির উপর দিয়েই এ কাব্য-স্রোতের উল্লোল-গর্জন গভীর খাতে প্রবাহিত।


শ্রীকৃষ্ণ শৃঙ্গার-রসরাজ-বিগ্রহ। তাই কৃষ্ণলীলায় আদিরসের প্রাধান্য দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। অবশ্য কৃষ্ণের প্রথম থেকেই যে পরিচয় পরিলক্ষ্য তা শুধুমাত্র দেহজ বাসনার উল্লাস, প্রেমের প্রসূন সেখানে দুর্লক্ষ্য। তাই দেহ-অরণির মস্থনে, মানবের আদিম রিপুর বন্ধনে কৃষ্ণের পূর্বরাগ এখানে যেন গুমরে মরেছে। এই কাব্যের নায়িকাও পরকীয়া প্রেমের মহত্ত্বে সন্দিগ্ধা এবং দুরস্ত বালিকা। কৃষ্ণের বাসনা-বাসিত উৎসবের নায়িকা হতে সে নারাজ। তাই অনেকের মতে, কাব্যটি ধুলিময় মাটির কলঙ্করেখা, ব্যঞ্জনাহীন সীমিত স্থূল কাব্য। কেননা সাহিত্যের দিক দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, এইরূপভাবে কামের চিত্রাল্পনায় রসসৃষ্টি অসম্ভব। প্রকৃত রতিভাবকেই রসোত্তীর্ণ করা চলে। এই ভাবের মধ্যে একজনের এরূপ আন্তরিক বিরাগ থাকলে আদিরসের কাব্যও হয় না। বলপ্রয়োগ, গ্রাম্যভাষা প্রয়োগ, বর্বরোচিত আচরণের সমবায়ে আলঙ্কারিক বিচারে এই কাব্য রসাভাস দুষ্ট।


এ কাব্যের বিশিষ্টতা কামনাগন্ধযুক্ত সম্ভোগময় কেলিবিলাস চিত্রণে—এর ‘জন্মখণ্ড’ থেকে ‘বিরহ’ পর্যন্ত আদ্যন্ত আদিরসের গরলে প্রলিপ্ত। বৈষ্ণব ভাবাদর্শের দিক দিয়েও একাব্যের রসসৌষ্ঠব অসমর্থনীয়। কেননা বৈষ্ণবদের হৃদয়-মূল থেকে উদ্ভিন্ন মাধুর্য ভাবনায় কৃষ্ণের চিত্র অঙ্কিত নয়, স্রষ্টার মতে, কংসবধের জন্যই কৃষ্ণের আবির্ভাব। রাধার কাছেও তার ঐশ্বর্যের সম্পর্ধ হুঙ্কার “দেবের দেবরাজ আহ্মে বনমালী।” বাচ্যার্থের দিক দিয়েও এর রস পরিণতি অসমর্থনীয়। তবে কিছু কিছু সমালোচক এর মধ্যে আধ্যাত্মিক Interpretation দিতে প্রয়াসী। যেমন, 'দানখণ্ডে'র মধ্যে কৃষ্ণের দেহাকাঙ্ক্ষার মধ্যে গীতার 'সর্বধর্মসমর্পণে'র কথা বিধৃত। ‘নৌকাখণ্ডে’ ভবনদীর কাণ্ডারী হয়ে ভগবান ভক্তের ভার বইতে চান। গীতার ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহং'-এর না বলা বাণীই ‘ভারখণ্ডে’র নাকি ভাবচিত্র, 'ছত্রখণ্ডে' কৃপাচ্ছায়ায় ভক্তকে রক্ষা করার আশ্বাস আছে ব্যঞ্জনায়। বলা বাহুল্য, অনুমানগুলি যুক্তি-বিনির্ভর। রাধাকৃষ্ণকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক বালিকারূপে গ্রহণ করে নাটকীয় রীতিতে হাস্যরসাত্মক আদিরসের কাহিনী লেখাই ছিল সম্ভবতঃ কবির অন্তরতম উদ্দেশ্য। তবু গ্রন্থটিতে অশ্লীলতার বলিষ্ঠ প্রকাশ অনুপেক্ষনীয়। ভারতচন্দ্রের কবিতা কি স্নিগ্ধ রুচির পরাকাষ্ঠা? নিশ্চয়ই নয়। নইলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থকে মণিমুক্তাখচিত রাজকণ্ঠের মণিমালার সঙ্গে তুলনা করতেন না। তিনি স্বয়ং একটি কবিতায় বলেছেন

“যুগে যুগান্তরে

চিরদিন পৃথিবীতে যুবক-যুবতী

নর-নারী এমনি চঞ্চল মতিগতি।

দুইপক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা 

অবোধ অজ্ঞান। সৌন্দর্যের দস্যু তারা

লুটেপুটে নিতে চায় সব।”

এই আদর্শই যেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রাধা-কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে পরিস্ফুট।


‘বংশীখণ্ড’ থেকে এ কাব্যের কামকেলি বিলাসের জোয়ারে ভাটা পড়েছে। এখান থেকেই কাব্যটি অশ্লীলতা-বিনির্ভর স্বতন্ত্র রাগিণীতে যেন সঙ্গীতায়িত হয়েছে—“কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ কূলে/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে/....আঝর ঝরএ মোর নয়নের পানী/ বাঁশী শবদে বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরানী।”—এই আশ্চর্য কবিতা পাঠে স্বয়ং রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীও হয়েছেন মুগ্ধবিবশ। কালিন্দীর নদীকূলে, গোকুলের গোষ্ঠে যে অবিরাম বংশীধ্বনি হচ্ছে, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন তার তৃষ্ণা নিয়ে গোলোক অভিমুখে যাত্রারত। এ বাঁশীর স্বরে সমস্ত শাস্ত্রকথা মিলিয়ে যায়। যে রাধা কৃষ্ণকে “নান্দের ঘরের গরু-রাখোয়াল” বলে উপেক্ষা করেছিল, আজ তারই পায়ে তনু-মন সমর্পণের কি বিপুল ব্যাকুলতা

“দাসী হাঁ তার পায়ে নিশিবো আপনা”,

“বড়ায়ি গো, কত দুঃখ কহিবোঁ কাহিনী। 

...মোএ নারী বড় অভাগিনী ৷৷”


—এ যেন পদাবলীর মর্মনিঃসৃত করুণ বিপ্রলম্ভের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি। মূঢ় বালিকা এখানে শাশ্বত প্রেমবোধে প্রৌঢ় পারাবতী। মাঝে মাঝে রাধার বসনে এসেছে গৈরিকস্পর্শ, কণ্ঠেও শোনা গেছে দূরাগত অসীমের রহস্য-ব্যঞ্জনা

“মুণ্ডিআঁ পোলাইবো কেশ জাইবো সাগর 

যোগিনী রূপ ধরি লইবো দেশান্তর।

যবে কাহ্ন না মিলিবে করমের ফলে 

হাথে তুলিআঁ মো খাইবো গরলে ॥”


–এই একই বাণী “বহুযুগের ওপার হতে” জ্ঞানদাসের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়

“মুড়াব মাথার কেশ ধরিব যোগিনী বেশ

যদি সই প্রিয়া না আইল

এ হেন যৌবন পরশ রতন কাচের সমান ভেল।”


নব মেঘ মালার সস্তামসী রাত্রির অন্ধকারে চারিদিক আচ্ছন্ন, “মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশী” কিন্তু রাধার “জাগরণে যায় বিভাবরী”। ব্যাকুল মন মর্মভেদী আক্ষেপ করে

“ভাদর মাসে অহোনিশি আন্ধকারে।

শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে ৷৷

তাত না দেখিবোঁ যবে কাহ্নঞির মুখ।

চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফাটি জায়িবে বুক ৷”


পিপাসায় কণ্ঠ কাতর। কাছেই সিন্ধু, অথচ কোথায় সেই তৃপ্তির পথ? এ যেন পত্রপল্লবে আছাড় খাওয়া বিরহী সমীরণের মর্মরিত দীর্ঘশ্বাস। এখানেই কাব্যটি যেন ইন্দ্রিয়ের কলুষ কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্মলোকের দিব্য পথে যাত্রা করেছে। রাধিকার এই ধ্যানগম্ভীর মূর্তির রূপাঙ্কনেই কাব্যটির সমাপ্তি।


‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি “কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা।” শুধু অশ্রুবিধুর নয়, এর অনেকাংশ হাস্যমধুর। নির্মল এবং অমার্জিত হাস্যরসের বন্যাধারায় কাব্যটি প্রবাহিত। নারদ সম্পর্কে চিত্রণ—“পাকিল দাড়ি মাথার কেশ/বামন শরীর মাকড় বেশ” কিম্বা বড়ায়ি বুড়ীর বর্ণনা হাস্যরসে প্রোজ্জ্বল– “শ্বেত চামর সমকেশে/কপাল ভাঙ্গিল দুঙগ পাশে।” কখনও কখনও কবি আশ্চর্য চিত্রণ দক্ষতায় আমাদের হাসিয়েছেন; যেমন রাধাকে শ্রীকৃষ্ণ যখন বলে তার রূপ দেখে কৃষ্ণের বুক ফাটে, তখন রাধার দ্বিধাহীন উত্তর : “যার প্রাণ ফুটে বুকে ধরিতে না পারে। গলাতে পাথর বান্ধী দহে পসী মরে ৷” এখানে হাস্যরস বুদ্ধিদীপ্ত সুষমায় মণ্ডিত।


গ্রন্থটির ছন্দ বেশিরভাগই পয়ার। প্রাকৃতপৈঙ্গল পাটিকা বিদ্যাপতিতে তরলায়িত হয়ে বাংলা পয়ারের কাছাকাছি এসেছিল। বাংলাদেশে 'চর্যাপদে’র পাটিকা হতে পয়ারের জন্মের মাধ্যমিক স্তরগুলির ইতিহাস আজও অপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে আবদ্ধ। বড়ু চণ্ডীদাসের একটি পদে পাটিকার আসল রূপটি ধরা পড়েছে- “নীলজলদসম কুম্ভলভারা/বেকত বিজুলি শোভে চম্পকমালা। / শিশত শোভএ তোর কাম সিন্দুর/ প্রভাত সময়ে যেন উয়ি গেল সুর।” এখানে ‘নীলের' 'ঈ' কার উচ্চারণ এবং ‘কুন্তল’ ‘চম্পক’ ও ‘সিন্দুর’ এই তিনটি শব্দে যুক্তাক্ষরের জন্য দু মাত্রা ধরা হয়েছে। এ কাব্যের বেশিরভাগই ছন্দ পয়ার। ত্রিপদী সুষম না হলেও ‘রাধাবিরহের’—“আছিল মো শিশুমতী—না জানি গো রঙ্গমতী” ইত্যাদি পদটি দীর্ঘ ত্রিপদীর নিখুঁত নিদর্শন।


চর্যাপদের মত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও গ্রামীণ বাংলার এক মূল্যবান Album। নৈতিক ধ্বংসস্তূপের উপর ব্যভিচার-উন্মত্ত বাঙালীর গ্রামীণ জীবনের যে ভাবচিত্র এখানে প্রতিফলিত, এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় তা বাস্তবজীবনের এক রঙীন রেখাচিত্র। দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর এই সুদীর্ঘ তিন শতকে দেশের সামাজিক জীবনে ব্যভিচারের ধ্বস নেমেছিল। সমাজ ছিল এই আনন্দবোধের সহচর। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' সেই বিকৃত রুচিহীন সমাজের সার্থক জীবন চিত্রায়ণ। এ কাব্যের যে অশ্লীলতা তা কবির হয়ত ইচ্ছাকৃত নয়, তা সে যুগের সমাজজীবনের অবিমিশ্র বাস্তবালেখ্য এবং জীবন চিত্রায়ণের অপরিহার্য অঙ্গ : “Literature is an expression of language through the medium of language.” বাংলার গ্রাম্যজীবনের প্রবাদ-প্রবচনের, বক্রোক্তি ও সরস বচনের স্মারক—“দেখিল পাকিল বেল গাছের উপরে/আর তিল কাক তাক ভখিতে না পারে।।” “মাকড়ের হাতে যেহ্ন ঝুনা নারিকেল”, “জরুয়া দেখিয়া যেহ্ন রুচক অম্বল,” “সোনা ভাঙ্গিলে আছে উপাত্র জুড়িএ আগুন তাপে। পুরুষ নেহা ভাঙ্গিলে জুড়িএ কাহার বাপে” ইত্যাদি তারই অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই সুদূর অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন মৌলিক জীবন “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের” আলোকে হঠাৎ ঝলকিত হয়েছে। বাস্তবানুভূতির বিস্ময়কর চিত্রণ এবং লোকজীবনের গভীরতম স্পন্দনে এই কাব্য তাই অনন্যসুন্দর। লোকজীবনের একনিষ্ঠ ভাবনাজাত সার্থক লোককাব্য হল বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।”