প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী

প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী


পৃথিবীতে নরাকার জীবের বিবর্তন ঘটে প্লাওসিন যুগে। এর পরে শুরু প্লাইস্টোসীন যুগ। এই সময়কার কোন নরকঙ্কাল ভারতে এখনও পাওয়া যায় নি। কিন্তু তার আগের যুগের নরাকার জীবের অস্তিত্ব এশিয়ার তিনটি স্থান থেকে পাওয়া গেছে—ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ শিবলিক গিরিমালা (“হোমো এরেকটাস”), জাভা (পিথিকেনথ্রোপাস-এরেকটাস) এবং চীনের (“সিনানথ্রোপাস পিকিনিসিস্) চুংকিঙ অঞ্চলে। আশ্চর্যের বিষয়, এই তিনটি উৎসক্ষেত্রকে সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে কিন্তু ত্রিভুজের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে বাংলাদেশ (অতুল সুর)। অবশ্য অনুমানটি হয়ত খুবই দূরাস্তীর্ণ। তবু একথা ঠিক, প্রত্ন উপাদান এবং ভ্রষ্ট ভাষা-স্মৃতির সমবায়ে একালীন গবেষক শেষ পর্যন্ত একটা মীমাংসার তীরে উপনীত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন। ছিন্নযোগ যুগের সঙ্গে একালের একটি যোগসূত্র রচনার দায়িত্বপালন করেছেন। কেন-না ইতিহাসেরও অজ্ঞাত কিংবদন্তীতে আচ্ছন্ন সেই সূচীভেদ্য অতীতে ম্যামালিয়ান মানুষের আদিমতম স্তরে হোমো এরেকটাস হোমো নিয়ানডারথেলনিসিস বা হোমো স্যাপীয়েন্স ইত্যাদি মানুষের ‘বাইপেড' কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাদের জীবনযাত্রা ও আচার আচরণের বৃত্তান্ত জানার জন্য কিছু পাথরের অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্রাদি, নরকঙ্কাল–কিছু বা উত্তরপুরুষের নৃতাত্ত্বিক মাপজোখ এবং ভাষাতাত্ত্বিক শব্দগুচ্ছ মাত্র ছিল তাঁর অন্বেষণের উপাদান। তাই সেকালের কাহিনীর অধিকাংশই অনুমান আশ্রিত।


বাঙালী জনগণের আদি ইতিহাস সংশয়াচ্ছন্ন। তবু দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাস ও ইতিহাস যুগের নরগোষ্ঠী প্রধানত দুভাগে বিভক্ত ছিল প্রাগার্য নরগোষ্ঠী এবং আর্য নরগোষ্ঠী। প্রাগার্য নরগোষ্ঠী বাঙালী-জীবনের মেরুদণ্ড। পরবর্তীকালে উত্তরাপথের আর্যদের অনুসৃত ভাষা ও সাংস্কৃতিক সুমিতির স্পর্শে তাদের প্রগতি ঘটে। নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের অভিমত, প্রধানত চারটি বিভিন্ন race বা জাতির সংযোগে হয় বাঙালী জনগণের 'রূঢ়িক' স্তরের অস্তিক উদ্ভব ও বিকাশলাভ–

  • (১) নেগ্রিটো,
  • (২) অস্তিক,
  • (৩) দ্রাবিড়,
  • (৪) ভোটচীনীয় গোষ্ঠী।

মনে হয় নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটু জাতীয় মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগে আফ্রিকা থেকে স্থলপথে ভারতে এসে পৌঁছায়। আসামের নাগাদের মধ্যে এদের অস্তিত্বের সামান্য কিছু চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সময়ের দীর্ঘ দূরত্বের কারণে বাংলাদেশ বা অন্যত্র এদের আচার-আচরণ বা ভাষাগত সাদৃশ্যের চিহ্ন অধিকাংশতই অস্পষ্ট। কদাচিৎ কোন আদিবাসী মানুষের দেহ গঠনের মধ্যে হঠাৎ উপস্থিতি মাত্র দেখা যায়। বাংলাদেশে বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলা থেকে প্রত্নপ্রস্তর যুগের কিছু হাতিয়ার পাওয়া গেছে। একটি খুব বিচিত্র ব্যাপার এই যে, এইসব হাতিয়ারের আকার ও নির্মাণরীতির সঙ্গে ইউরোপে প্রাপ্ত হাতিয়ারগুলির এক ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।


পরবর্তী অস্ট্রিক গোষ্ঠীর সঙ্গেই বাঙালী জাতির যোগসূত্র মনে হয় সবচেয়ে আন্তরিক। অবশ্য সুনীতিকুমারের মতে, এরও আগে ভারতে আসে Proto-Australoid বা ‘প্রাথমিক অস্ত্রালাংকার' নামে একটি জাতি। এদের ভাষার কোন অস্তিত্ব না থাকলেও, এই জাতির দৈহিক আকার প্রকার সম্বন্ধে নৃতাত্ত্বিকগণ কিছু কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তামিলনাড়ুর তিনেভেলী জেলায় প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক যুগের নরকঙ্কালের মধ্যে এদের মাথার খুলি পাওয়া যায়।


প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে বাংলাদেশ ‘উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে নির্বাসিত আর্যসংস্কৃতি থেকে তার বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ, অসংস্কৃত অস্ট্রিক বা নিষাদ জাতির সংস্পর্শ। অবশ্য এদের আকৃতি এবং আগমন স্থান ও সময় নিয়ে সুধীজনের মধ্যে বিভিন্ন মতান্তর আছে। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে অস্ট্রিক জাতি বাংলাদেশে প্রবেশ করে অন্তত পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে। শুধু তাই নয়, সেই আদিম স্তরে নেগ্রিটো বা অন্যান্য পরবর্তী জাতিকে পরাজিত করে কৃষির ব্যবহার এবং জনজীবনে একটি সঙ্ঘবদ্ধ ও বাস্তব সভ্যতার রূপদানের প্রয়োজন তারাই প্রথম উপলব্ধি করে। অস্ট্রিক জাতির অস্তিত্বের সবচেয়ে উল্লেখ্য প্রমাণ এর ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শন। সাঁওতাল, মুণ্ডারী, কোল, হো, কুরকু, শবর, গদর প্রভৃতি পূর্ব ভারতের কতকগুলি ভাষা এবং আসামের খাসিয়া ভাষা এগুলির সঙ্গে ঐ ভাষার সমাত্মতায় বোঝা যায় এই সব আদিবাসীরা ঐ অস্ট্রিক জাতিরই প্রবংশ। বাঙালীর রক্তে এই জাতির প্রভাবই সর্বাধিক পরিমাণে লক্ষণীয়।


(১) আকৃতিগত : বাঙালী ব্রাহ্মণের পাঞ্জাবী ব্রাহ্মণের অপেক্ষা বাঙালী নিম্নবর্ণের সঙ্গেই দৈহিক সাদৃশ্য সমধিক।


(২) ভাষাগত : বাংলাভাষায় ব্যবহৃত বহু শব্দও অস্ট্রিকভাষা ঋদ্ধ, বাখারি, খামার, চোঙা, চোয়াল ইত্যাদি। অনেক নদনদীর নামেও আছে তার বহমান ধারা সঙ্কেত— দামোদর, গঙ্গা, কপোতাক্ষ প্রভৃতি। কিছু ফলের নামেরও তারাই উদ্ভাবক ও প্রবর্তক— নারকেল, কদলী, তাম্বুল, গুবাক ইত্যাদি।


(৩) আচারগত : বাঙালীর অনেক প্রচলিত সংস্কার ও অনুষ্ঠানে অস্ট্রিক জাতির প্রভাব অনুপেক্ষণীয়। যেমন, কৃষি সম্পর্কিত পৌষ-পার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি উৎসব, চড়ক ও গাজন, পূজায় ঘটের ব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাল-দূর্বা পান-সুপারি-সিঁদুর কলা ব্যবহার এবং নানামুখী মেয়েলী ব্রত আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি।


(৪) ধর্মগত : তান্ত্রিক বৌদ্ধ, নাথপন্থ, ধর্মঠাকুর, লিঙ্গরূপী শিবপূজা (অনেকের মতে, পুরীর জগন্নাথ-শিলাও অনার্য সম্পত্তি) ও মাতৃদেবীর পূজা, বৃক্ষপূজা, ইত্যাদির মাধ্যমে অভিজাত এবং অপজাত উভয় শ্রেণীর মধ্যে অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাবনা আজও বিদ্যমান বলে মনে করা হয়।


নাগরিক জীবনে বিশ্বাসী দ্রাবিড়গোষ্ঠীর উদ্ভব-ইতিহাসও অনিশ্চিত। সম্ভবত খ্রীস্টপূর্ব বেশ কয়েক হাজার বছর আগে ইরান, এশিয়া মাইনর এবং গ্রীসের উপদ্বীপ অঞ্চলে এদের উৎপত্তি। আবার আদিতান্নালুর অঞ্চলের সমাধিপাত্রে ও দক্ষিণ ভারতের সমাধি স্তূপগুলিতে প্রাপ্ত নরকঙ্কালগুলির সঙ্গে ‘ভূমধ্যীয়’ বা ‘মেডিটেরেনিয়ান’ নরগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্যও কৌতূহলজনক। এদের আকৃতি মধ্যাকার এবং মাথা লম্বা, গড়ন পাতলা, নাক ছোট ও রঙ ময়লা। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে এই গোষ্ঠীর প্রাধান্য দেখা গেলেও মনে হয়, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ধরেই এদের ভারতে অনুপ্রবেশ। খুব সম্ভবত বৈদিক সাহিত্যে উক্ত ‘পনিরা' ছিল এই গোষ্ঠীভুক্ত।


(৫) ভাষাগত প্রভাবঃ দ্রাবিড়গোষ্ঠীর অনুভাবে বাঙালীর চিন্তাধারার প্রভাব যতটা ভাষাগত, ততটা বস্তুগত নয়। কেননা নগরকুশলী এই জাতি বাংলাদেশে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পার অনুরূপ কোন নগরসভ্যতার বিশেষ সূচনা করেনি। (অবশ্য ড. অতুলচন্দ্র সুরের মতে, 'পাণ্ডুরাজার ঢিবি' এধরনের নগরের প্রতীক) কিন্তু বাংলা ভাষায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যেমন—ডোমজুড়, শিলিগুড়ি, চাপড়া, ইত্যাদি গ্রাম নামে এবং কলা, কপি, মর্কট, কাইবিচি, খাড়ি, ছোলা, ছেলে, পিলে (পিল্লাই) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে অনুভব করা যায়।


বাংলার ইতিহাসে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, পরবর্তীকালে বিজিত অস্ট্রিক জাতির সঙ্গে সংমিশ্রণে একটি সঙ্ঘবদ্ধ ঐকাহিক অনার্যগোষ্ঠীর জন্মদান। বস্তুত এই দ্বৈত গোষ্ঠীর দৈহিক ও মানসিক, ভাষা ও চিন্তাধারার জরাসন্ধ-রূপায়ণেই ভবিষ্যৎ বাঙালীর অনার্যরূপে স্বীকৃতিলাভ। ব্রহ্মাবর্তবাসী আর্যদের বঙ্গদেশের প্রতি বিরূপ মনোভঙ্গীর কারণও প্রধানতঃ এই অস্ট্রো-দ্রাবিড় জাতির জন্যই। ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে, বঙ্গ-মগধ-চেরপাদ জাতি পক্ষিকল্প অর্থাৎ, পাখির মত (বোধহয় 'পাখি' তাদের ‘টোটেম’ ছিল) অস্ফুটভাষী। যাযাবর, পুণ্ডরা, ‘দস্যু’ নামে চিহ্নিত। বৈদিক যুগে বাংলাদেশের অধিবাসীদের প্রতি এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভাব প্রায় বৌধায়ন ধর্মসূত্রের যুগ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল।


আমরা জানি, বাংলার আকাশে বাতাসে আর্য-স্বরক্ষেপের বৈদিক-উদ্ভাস সূচনায় মোটেই মধুময় নয়। বরং এদেশীয় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে ও বাচনে এক কর্কশ ছন্দপতনের সুর শোনা যায় অথর্ববেদ ঐতরেয় আরণ্যক শতপথ ব্রাহ্মণে। কারণ নর্ডিক‌ বা বৈদিক আর্যরা প্রথমাবস্থায় এক ধর্মধ্বজী যোদ্ধারূপে সীমাহীন দিগন্ত জয়ের আবেগে উদ্বেল হয়েছিলেন। খ্রীস্টপূর্ব দুই হাজার থেকে এক হাজার বছরের অন্তবর্তী কোন এক সময়ে উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি ছেড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তারা অগ্রসর হন। তখন এদের সঙ্গে কাস্সুরা ছিল। ১৫০০ খ্রীস্টপূর্ব নাগাদ উত্তর-পশ্চিম গিরিপথ দিয়ে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করে এবং পঞ্চনদের (সরস্বতী ও দৃষদ্বর্তী নদীর কাছে) উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে ব্রহ্মাবর্ত, আর্যাবর্ত নামে নিজেদের গণ্ডীবদ্ধ করে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে।


আর্যসংস্কৃতির মূল কথা হল, ‘গ্রহণীশক্তি’ বা অন্য ভাবধারা বিলোপের ‘শোষণশক্তি’। তাই ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের পর এদেশীয় মানুষের সঙ্গে দীর্ঘকালের পরিচয়ে তাঁরা এদের জীবনধারার অংশী ও সঙ্গী হয়ে পড়েন। মৌর্য বিজয় থেকে গুপ্তাধিকার পর্যন্ত অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত এই কয়েক’শ বছর ধরে বাংলায় আর্যীকরণের ধারা চলে। অঙ্গ ও মগধে আর্যীকরণের প্রথম আরম্ভ, তারপর দেখা দেয় রাঢ় ও পুণ্ড্রে অর্থাৎ পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গে। অনুমান খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত অর্থাৎ মৌর্যযুগ থেকে য়ুনান চুয়াঙের আগমন কালের হাজার বছরের মধ্যে বাঙালীর আর্যীকরণের ধারা সম্পূর্ণ হয়েছিল।


বাংলাদেশে আর্যীকরণের পর উত্তর-চীন হতে তিব্বতে এবং পরে হিমালয় অতিক্রম করে আসামের পথ ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতে সন্নিবিষ্ট হয় আর একটি জাতি—‘ভোট-চীন’ গোষ্ঠী। বাংলার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এদের অস্তিত্ব এখনও লক্ষণীয়। বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে এদের বিশেষ কোন প্রভাব নেই কেবল মাঝে মাঝে বাঙালীর দেহবর্ণে পীতাভ অস্তিত্ব ছাড়া।