গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলার কারণ কী তাহা আলোচনা করিয়া বুঝাইয়া দাও।

গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলার কারণ

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য ছিলেন– কথাটা বহুল উচ্চারিত। একে তো তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি' নামে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর আবার বিদ্যাপতির সঙ্গে ভণিতায়ও তার নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছে, অতএব বিদ্যাপতির ভাবশিষ্যরূপে পরিচিত হবার দাবি এখানেই প্রতিষ্ঠিত। এগুলি অবশ্যই বাইরের কারণ; কিন্তু যারা বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের কাব্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, তারাও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। গোবিন্দদাস নিজেও বিদ্যাপতির শিষ্যত্বের কথা স্বীকার করেছেন—

'বিদ্যাপতি-পদ-যুগল-সরোরুহ-নিঃসান্দিত মকরদে। 

তত্ত্ব মঝু মানস মাতল মধুকর পিবইতে করু অনুবন্ধে।'


গোবিন্দদাস যখন প্রথম পদ রচনায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি বৈষ্ণব ছিলেন না। সম্ভবত পঞ্চোসাধক বিদ্যাপতির ব্রজবুলির আকর্ষণেই গোবিন্দদাস ঐ ভাষায় পদ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তিনি যে সজ্ঞানে বিদ্যাপতির অনুসরণ করেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এই কারণেই উভয়ের রচনায় ভাবগত ঐক্যও বর্তমান। “এঁদের কাব্যে ভাব এবং রীতির মধ্যে ব্যবধান দুরতিক্রমী হয়ে উঠেছে। উভয় কবিই বস্তুতে বিভোর হয়েছেন কিন্তু আত্মবিস্মৃত হননি, উভয় কবির কাব্যেই বস্তুবিভোরতা ফুটেছে কিন্তু আত্মতন্ময়তা ফুটেনি, ফলে এঁদের কাব্যের সর্বত্রই ভাবের সাথে রূপের, শিল্পের সাথে শিল্পীর, মনের সাথে মননের একটি শঙ্কাতুর ব্যবধান রয়ে গেছে। বিদ্যাপতির মতোই তিনিও কাব্যের বহিরঙ্গের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।


অবিমিশ্র ব্রজবুলি ভাষা, ছন্দের বৈচিত্র্য, অলঙ্কারের বহুল ব্যবহার ইত্যাদিতে বিদ্যাপতির অনুসরণপ্রিয়তাই লক্ষ্য করা যায়। এমনকি তিনিও বিদ্যাপতির মতোই কৃষ্ণলীলাকাহিনীর বিলাস-কলা-কুতূহলের দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। মান-মাথুর-বিরহের পদে গোবিন্দদাস বিশেষ কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দান করতে পারেননি। বিদ্যাপতি আপন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতেই লীলামাধুর্যের স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গোবিন্দদাস ছিলেন এ বিষয়ে অধিকতর সৌভাগ্যবান। কারণ তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন মহাপ্রভু আপন জীবনের ভিতর দিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনীকে প্রকাশ করে গেছেন।


অতএব বলা চলে, গোবিন্দদাস লীলামাধুর্যের প্রত্যক্ষ স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। কাজেই কৃষ্ণলীলাকে একান্তভাবে বাইরে থেকে দেখতে হয়নি তাকে। তিনিও সমসাময়িক যুগমানসের অংশভাগী ছিলেন, কাজেই যুগের ভাবুকতায়ও তিনি আপন উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করে তোলবার অবকাশ পেয়েছিলেন। এই কারণেই কেউ কেউ অনুরূপ ক্ষেত্রে গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতি অপেক্ষাও সার্থকতর কবি মনে করেন। বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস উভয়েই সচেতন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও কাব্যকলাপ্রয়োগের কতকগুলি বিশেষ দিকে গোবিন্দদাস উৎকৃষ্টতর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছন্দোবৈচিত্র্য, অলঙ্করণের সৌকুমার্য এবং পদবিন্যাসের চাতুর্য।


ভাবোল্লাস ও প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি সমধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু অভিসারের পদে গোবিন্দদাস তাঁকে অতিক্রম করে গেছেন। গৌরচন্দ্রিকার পদ-রচনায় গোবিন্দদাস ভাবোচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে কাব্যের বহিরঙ্গ-গঠনে সংযত কবি-কল্পনার পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতির অবশ্য গৌরচন্দ্রিকা রচনার কোনো সুযোগই ছিল না।


অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী বলেন, “.. গোবিন্দদাস সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়ো কথা গোষ্ঠীগত ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি, ব্যক্তিগত প্রতিভা চমৎকৃতি ও অনুভূতি-নিবিড়তার প্রভাবে তিনি বৈষ্ণব পদসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে গুরুর সিদ্ধিকেও হয়ত অতিক্রম করে যেতে পেরেছিলেন। আরও একটা ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি অপেক্ষাও গোবিন্দদাসের কৃতিত্বকে উচ্চস্থান দিতে হয়। গোবিন্দদাসের কাব্যে যে একটা অপূর্ব গীতি-মূর্ছনা লক্ষ করা যায়, তেমনটা বিদ্যাপতির ছন্দ-সুষমাযুক্ত পদেও পাওয়া যায় না। অতএব গোবিন্দদাসের এই সুরচেতনা বিদ্যাপতি থেকে লব্ধ নয়, এর জন্য গোবিন্দদাস ঋণী জয়দেবের কাছে। গোবিন্দদাসের কাব্যে যে সুরের সম্পূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়, বিদ্যাপতির কাব্যে ছন্দ-ধ্বনি-অলঙ্কার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সুরের মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাক থেকে যায়। বাক্যজালের জটিলতায় জড়িয়ে বিদ্যাপতির কাব্য যেখানে নীরস বলে প্রতিভাত হয়, গোবিন্দদাসের নিটোল কাব্যদেহ সেখানে রসে টই-টঙ্কুর। “বিদ্যাপতির নিকট গোবিন্দদাসের ঋণ ছন্দের জন্য, সুরের জন্য নয়। বিদ্যাপতির অনেক পদ বাহ্যরূপে অপেক্ষাকৃত ছন্দ-পুরুষ অথচ তাহাদের ভাবগৌরবের তুলনা নাই। সেখানে গোবিন্দদাস অনেক পিছনে। তথাপি গোবিন্দদাসের চূড়ান্ত প্রতিভা অর্থাৎ সুরপ্রতিভার প্রশ্নে বিদ্যাপতির স্থান নিম্নেই।"


মিলনের পদ-রচনায় বিদ্যাপতির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন রূপের, জীবনভোগের কবি, তাই তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায় যৌবনের উচ্ছ্বাস ও প্রেমের নৃত্য। মিলনের মতোই বিরহের পদ রচনাতেও বিদ্যাপতি ছিলেন অধিকতর সার্থক। 'এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর' কিংবা 'শুন ভেল নগরী। শুন ভেল দশ দিশ, শুন ভেল সগরি। প্রভৃতি পদের কাব্যসৌন্দর্য ভাবগভীরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদ্যাপতিকে অসাধারণ কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে গোবিন্দদাস অনেকটাই ব্যর্থ। ভাষার ঐশ্বর্য আর ছন্দ ঝঙ্কারের মধ্য দিয়ে শ্রীমতীর আর্তি যথাযথভাবে ফুটে উঠবার অবকাশ পায়নি।


মূল ভাবকে প্রবল করে তুলতে গিয়ে বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাস দুজনেই

‘লোচননীর তটিনী নিরমাণে।

করএ কমলমুখী তথিহি সিনানে৷৷'


চোখের জলে রাধা নদী সৃষ্টি করলেন। আর গোবিন্দদাস বলেন

'আঙ্গুলিক মুদরী সোই ভেল কঙ্কণ

কঙ্কণ গীষ্মক হার।'

বিরহিণী রাধা এত কুশ হয়েছেন যে হাতের আংটি হয়েছে তার কঙ্কণ এবং কঙ্কণ হল গলার হার।


বিদ্যাপতি ছিলেন প্রেম ও সৌন্দর্য-উপাসক কবি, তিনি ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন না, আর গোবিন্দ দাস কবি হয়েও ছিলেন নৈষ্ঠিক ভক্ত বৈষ্ণব। কাজেই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পার্থক্য থাকবেই এঁদের কাব্য আলোচনা করতে গিয়ে তাই ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার বলেন, “গোবিন্দ দাস বিদ্যাপতির কাছে ঋণী বটে, বিদ্যাপতি প্রায়শঃই বহির্মুখী, সৌন্দর্যের আকর্ষণে তিনি চঞ্চল, আর গোবিন্দদাস অনেকটা অস্ত্রমুখী, ভাবের আবেগে স্থির ও গম্ভীর গোবিন্দদাস অল্প একটু বলিয়া বাকিটা পাঠককে কল্পনা করিয়া লইতে বলেন।"