'আগমনী' ও 'বিজয়া' পর্যায়ের শাক্তগীতিতে একই সাথে মানবিক অনুভূতি ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি কীভাবে কাব্যরূপ লাভ করিতেছে তাহা উদাহরণসহ বুঝিয়ে দাও।

“শাক্ত পদাবলী যুগপৎ দিবারস পিপাসা ও সাহিত্যরস পিপাসা নিবৃত্তির এক অফুরন্ত উৎস।" শাক্ত পদাবলীর আধ্যাত্মিক ও কাব্যিক মূল্য নিরূপণ কালে এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে অথবা বিপক্ষে তোমার মতামত লিপিবদ্ধ করো।

'শাক্ত পদকর্তাগণ সংসারমুখী প্রবণতার পাশে মাতৃনির্ভর অধ্যাত্মসাধনা ও মুক্তিকামনাকে 'ভক্তের আকৃতি' শ্রেণীর পদে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে সমন্বিত করেছেন।”— অধীত পদগুলি থেকে উদ্ধৃতিসহ উক্তিটি আলোচনা করো।


শাক্ত পদাবলীর আধ্যাত্মিকতা ও কাব্যগুণ

বঙ্কিমচন্দ্র থেকে একটি উদ্ধৃতি— “একদিন বর্ষাকালে গঙ্গাতীরস্থ কোনো ভবনে বসিয়াছিলাম। প্রদোষকাল–প্রস্ফুটিত চন্দ্রালোকে বিশাল বিস্তীর্ণ ভাগীরথী লক্ষ বীচিবিক্ষেপ শালিনী—মৃদু পবন-হিল্লোলে তরঙ্গ-ভঙ্গ-চঞ্চল চন্দ্রকরমালা লক্ষ তারকার মত ফুটিতেছিল ও নিবিতেছিল।...আকাশে নক্ষত্র, নদীবক্ষে নৌকায় আলো, তরঙ্গে চন্দ্ররশ্মি। কাব্যের রাজ্য উপস্থিত হইল। মনে করিলাম, কবিতা পড়িয়া মনের তৃপ্তি সাধন করি। ইংরেজী কবিতায় তাহা হইল না। ইংরেজীর সঙ্গে এই ভাগীরথীর ত কিছুই মিলে না। কালিদাস ভবভূতিও অনেক দূরে। মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র–তাহাতেও তৃপ্তি হইল না। চুপ করিয়া রহিলাম। এমন সময় গঙ্গাবক্ষ হইতে সঙ্গীতধ্বনি শোনা গেল। জেলে জাল বাহিতে বাহিতে গাহিতেছে—

‘সাধো আছে মা মনে

দুর্গা বলে প্রাণ ত্যজিব

জাহ্নবী-জীবনে।'


তখন প্রাণ জুড়াইল—মনের সুর মিলিল—বাঙ্গালা ভাষায় বাঙ্গালীর মনের আশা শুনিতে পাইলাম—এ জাহ্নবী জীবনে দুর্গা বলিয়া প্রাণ তাজিবারই বটে, তাহা বুঝিলাম। তখন সেই শোভাময়ী জাহ্নবী, সেই সৌন্দর্যময় জগৎ, সকলই আপনার বলিয়া বোধ হইল—এতক্ষণ পরের বলিয়া বোধ হইতেছিল।" বস্তুত শাক্ত সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বাঙালী প্রাণের সার্বিক অভিব্যক্তি যেমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তেমন দৃষ্টাস্ত অন্যত্র দুর্লভ। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় প্রভূত পরিমাণ বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালীর বাস্তবজীবনের কোনো যোগ ছিল না। বৈষ্ণব পরকীয়া তত্ত্ব বাঙালীর গৃহজীবনে একান্তভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত, এর ঠাই ছিল গ্রাম প্রান্তে অবস্থিত বোষ্টমীর আখড়ায়। পক্ষান্তরে শক্তিসাধনায় যখন জগজ্জননীকে আপন গৃহে মাতৃরূপে স্থাপন করা হল এতে একদিকে যেমন বাঙালীর সাধনার স্বরূপ লক্ষ্য করা গেল, তেমনি অবারিতভাবে আত্মপ্রকাশ করল কবিত্বের ধারা। অর্থাৎ একদিক দিয়ে জগজ্জননীর দিব্যরূপ প্রকাশে যেমন বাঙালীর অধ্যা রসপিপাসার নিবৃত্তি ঘটে, তেমনি এর রস-স্বরূপ উদ্ঘাটনে কাব্যরস পিপাসাও পরিতৃপ্ত হ'তে পারে।


শাক্ত পদাবলীর দুটি প্রথম পর্যায় একটি উমা-সঙ্গীত' বা 'আগমনী-বিজয়া’র গান, অপরটি 'শ্যামাসঙ্গীত' তথা 'সাধনসঙ্গীত'। আগমনী- বিজয়ার পদে উপাস্যা দেবী কন্যারূপিণী উমা, এখানে দেবীর দিব্যভাব প্রকাশের সুযোগ অপেক্ষাকৃত স্বল্প হলেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। ভক্ত কবি যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই উমাকে দিব্যশক্তির আধার জগজ্জননী-রূপে উপস্থাপিত করেছেন। মেনকার আকৃতিতে কৈলাসে গিয়ে গিরিরাজ উমাকে নিয়ে গৃহে ফিরলেন, —উমা তখন চণ্ডী বা দুর্গারূপেই যেন দেখা দিয়েছেন, মেনকা ভীত চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আর তাকে চিনতে পারেন না, তাই বলেন—

'গিরি, কার কণ্ঠহার আনিলে গিরি-পুরে? 

এ তো সে উমা নয় ভয়ঙ্করী হে, দশভুজা মেয়ে।'

উমার এই দিব্যমূর্তি-প্রকাশের মধ্য দিয়ে শাক্তকবিদের অধ্যাত্মারসপিপাসারই পরিচয় পাওয়া যায়।


শক্তি সাধনাকে বাঙালীর নিজস্ব সাধনা বলে অভিহিত করলে অত্যুক্তি হয় না। বৈষ্ণব সাধনা সর্বভারতে পরিব্যাপ্ত, কিন্তু শক্তি সাধনার যে দুটি বিশেষ রূপ—'কন্যাসাধনা' ও ‘মাতৃসাধনা' শাক্ত পদাবলীর মাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছে, তেমনটি আর কোথাও হয়নি। ধর্মীয় আচার-আচরণ অথবা শাস্ত্রীয় মন্ত্রতন্ত্রাদির অতিরিক্ত অথবা তা' থেকে পৃথক এই সাধনা রূপ ও রসমূর্তি লাভ করেছে শাক্ত সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে। শাক্ত কবিদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে তাঁরা সহজ সরল প্রাণের ভাষায় প্রকাশ করেছেন; প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে উৎসারিত এই পদগুলির মধ্যে প্রাণের দেবতার অধিষ্ঠান যেমন নিঃসন্দিগ্ধ, তেমনি তাতে রয়েছে অকৃত্রিম কাব্যরসের নির্ঝর। বস্তুত শাক্তপদের বিভিন্ন পর্যায়ে আধ্যাত্মিকতা ও কাব্যরস এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে যে একটি থেকে অপরটিকে পৃথক করা দুঃসাধ্য অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—“সাধারণ কাব্যবিচারের মানদণ্ডের আদর্শে শাক্ত পদাবলী বিচার করিতে গেলে কবি সাধকদের প্রতি অবিচার করা হইবে। কারণ ইহারা কেহই নিছক কাব্য করিবার জন্য বা শ্রোতাদের সঙ্গীতপিপাসা নিবারণ করিবার জন্য এই গীতিকাসমূহ রচনা করেন নাই। তাহারা মূলত সাধক ও মোক্ষাভিলাষী, গৌণত কবি। তাই সাধারণ কাব্যকবিতার আদর্শে দেখিলে শাক্ত পদাবলীর অনেকটাই খর্ব মনে হইবে। কবিসাধকগণ নানা উপমা-অলঙ্কার ইঙ্গিতের আভাসে জগজ্জননী আদ্যাশক্তির স্বরূপ নির্ধারণ করিতে গিয়াছেন, কারণ যাঁহাকে ভক্তি করিতে হয় তাঁহার একটা রূপায়তন না হইলে চলে না। (যখন) কবি তন্ত্রে বর্ণিত বাঁধা জগতের কালীরূপে বর্ণনা করেন—যাহাতে কবিত্ব প্রকাশের বিশেষ অবকাশ নাই। কিন্তু যেখানে কবি কালভয়নিবারিণী মহাকালীকে নিজ অস্তরে উপলব্ধি করেন, তখনই তাহা শিল্পরূপ লাভ করে

'সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমোহিনী...

যখন ব্ৰহ্মাণ্ড না ছিল হেথা মুণ্ডমালা কোথা পেলি।'


কিংবা যখন সাভিমানে কালিকাকে সম্বোধন করিয়া বলেন

'যে ভালো করেছ কালী আর ভালোতে কাজ নাই। 

জানিলাম শত শত কপাল ছাড়া পথ নাই।'

তখন তাহাতে মর্ত্যের স্নেহাভিমান চমৎকার রসরূপ লাভ করে।


আগমনী-বিজয়ার গানে তত্ত্বকথা প্রায় নেই—তথায় একটা পারিবারিক পরিবেশে শাক্তপদকর্তারা কবিত্বশক্তি বিকাশের যে সুযোগ লাভ করেছেন, 'ভক্তের আকৃতি পর্যায়ে ‘উপাসনাতত্ত্বে’ সহজ কবিদের তেমন সুযোগ নেই। কিন্তু এই সাধনা যেহেতু 'মাতৃবন্ধন', ভক্ত যেখানে সস্তানমাত্র, অতএব উপাস্য-উপাসকের মধ্যে যে দুরতিক্রম্য দূরত্ব স্বাভাবিক, তা এখানে অনুপস্থিত। ফলত শাক্তকবিগণ এখানেও সহজ কবিত্ব প্রকাশের সুযোগ গ্রহণ করবার অবকাশ পেয়েছেন। ভক্তের আকৃতিতে তাদের একমাত্র লক্ষ্য মাতৃপদ – সেই লক্ষ্যে উপনীত হবার সাধনায় তাঁরা যে জ্ঞান ও যোগের পথ ধরে পথ পরিক্রমা করেন, তা নীরস আত্মধ্যান নয়, তা ভক্তি-বিমণ্ডিত। ফলে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কাব্যধর্মের বিরোধীতার কোনো প্রশ্ন নেই এখানে, বরং একে অপরের হাত ধরে চলতে পারে।


মাতৃস্নেহাভিলাষী সস্তানের নিকট সংসার যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে, শাক্তকবিগণ কতরকম রূপকাদি অলঙ্কারের সাহায্যে তাকে প্রকাশ করেছেন। রামপ্রসাদের একটি পদে জীবকে ‘দুঃখের ডিক্রিজারির আসামী' বলে মনে করছেন, ষড়রিপুরূপ ছয়জন পেয়াদা তাকে - নির্যাতন করছে, মনরূপ উক্লিও তার বিরুদ্ধে, তাই কবির কাতরোক্তি 'পলাইতে পথ নাই মা, বল উপায় কি করি।” কবি অপর একটি পদে ‘ভূতের' বেগার খেটে মরার কথা বলছেন। পঞ্চভূত, ষড়রিপু, দশ-ইন্দ্রিয় আদি মহাবলবান লাঠিয়ালরা জীবনকে সর্বস্বান্ত করে তাদের মজুরি কেড়ে নেয়।


আর এক কবি জীবকে অকূল সাগরের ভাসমান যাত্রী বলে মনে করেছে তার তরী জীর্ণ। মাঝি আনাড়ী এবং গোয়ার ছয়জন দাঁড়ি। প্রচণ্ড ঝড়ে তরী টলমল— 'তরী হল বানচাল, বল কি করি।'


মোহবদ্ধ জীবকে কবিরা নানাভাবে চিত্রিত করেছেন এমন জীব কোথাও চিত্রের পদ্মেতে পড়া' ভ্রাপ্ত ভ্রমর, কোথাও 'কলুর বলদ', কোথাও বা ভানুমতীর কুহকে মোহমুগ্ধ ‘বেদে’ ইত্যাদি। বাঙালীর প্রাণের অকৃত্রিম ভাষাতে শাক্তপদকর্তাগণ যে পদ রচনা করেছেন তাদের সরল সহজ কবিত্বধর্ম এদের বিশিষ্ট সম্পদ। ভাষা ব্যবহারে ‘জারিভাঙ্গা, কায়দা করা, দেঁতোর হাসি, ভোজের বাজি, ঠারে ঠারে, চোখের ঠুলি' প্রভৃতি বিশিষ্টার্থক পদের ব্যবহার, ‘পাকা ধানে মই ভূতের বেগার, ছেলের হাতের মোয়া, কিল খেয়ে কিল চুরি করা প্রভৃতি প্রৌঢ়োক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শাক্ত সঙ্গীতের ভাষাকে চলমান জীবনের বেগবতী ভাষায় পরিণত করেছেন। রূপকাদির ব্যবহার সম্বন্ধে সমালোচক বলেন, “রূপকগুলি প্রাঞ্জল বলিয়াই 'শাক্ত পদাবলী'র বাচ্য অস্পষ্টতাদোষে দুষ্ট নয়। কাব্যের সৌন্দর্যবিচারে এই অকুন্ঠ প্রাঞ্জল প্রকাশভঙ্গির স্বতন্ত্র মূল্য আছে।... রামপ্রসাদের অধিকাংশ পদ তত্ত্ববিলসিত হইয়াও উপলব্ধির নিবিড়তায় ভাবসমৃদ্ধ—মাতৃমহাভাবসাগরে এগুলি যেন কবির মননজাত ভাবের অসংখ্য ঊর্মি। .....যেখানেই কবির হৃদয়ভাবের স্পর্শ লাগিয়াছে, সেখানেই তত্ত্বমুখর শাক্তগীতি রসোত্তীর্ণ কবিতায় রূপান্তরিত হইয়াছে।"