প্রাক্-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব আখ্যান কাব্য

গীতায় শ্রীভগবানের একটি সতর্ক বাণী


“অবজানস্তি মাং মূঢ়া মানুষীম্ তনুমাশ্রিতম্”এই উক্তি যথার্থ। এই সীমাবদ্ধতার একটি কারণ, সম্ভবত বৈষ্ণব ধর্ম ও কৃষ্ণের স্বরূপত্ব সম্বন্ধে জনমানসে ভক্তি-চৈতন্যের যথার্থ বিকাশ পুণ্যশ্লোক চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত দেখা যায় নি। কিন্তু তবু চৈতন্য-আশ্রয়ী বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠার পূর্বে একাধিক ধর্মাচার্যদের স্মরণ্য মতবাদে এবং বিবিধ লিপি-দর্শনে সাহিত্যে তার প্রথম প্রকাশ সুস্পষ্ট। অবশ্য চৈতন্য-পুর্ববর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে বিষ্ণুকে নায়ক রূপে স্বীকার হয়ত শুধু ভক্তির কারণে নয়, শৌর্যে-বীর্যে প্রেমে নরাবতার বিষ্ণু যেন পুরাণের রাজকুমার হয়ে উঠেছেন—শত্রুজয়ী, চির-সুন্দর, প্রেমিক-বল্লভ। নানা দেবতার ভাবে ভাবিত হয়েও ভারতীয় সাহিত্যে তিনিই সর্ববাঞ্ছিত নায়ক। কেননা ব্রহ্মার ভূমিকা ভারতীয় সাহিত্যে গৌণ, তাঁর নিরঞ্জন নিরাকার স্বরূপের পরম উপলব্ধি মহাসাধকেরই ধারণা-নির্ভর, বেদে পুরুহৃতঃ ইন্দ্রের চরিত্রও পৌরাণিক ভাবনায় প্রশংসনীয় নয়। মহেশ্বর নিঃসন্দেহে মহীয়ান, কিন্তু পুরাণে তাঁর আত্মভোলা প্রৌঢ় মূর্তি প্রাচীন কবি-কল্পনার নিছক কৌতুকের উপাদান। কিন্তু চিত্তজিৎ নায়ক বিষ্ণু অন্ধকার প্রতীক দুর্গতি-বিনাশের জন্য যেন সূর্য-বিষ্ণু রূপে উপস্থিত। তাই বিভীষিকাময়ী রাত্রির মধুকৈটভকে বধ করে তিনি সর্বজীবের ‘শ্রী’ বা লক্ষ্মীর অধিপতি হয়েছেন। রামায়ণে তাঁর ‘সূর্যবংশে’ নরচন্দ্রমা রূপে জন্মলাভ; মহাভারতের রক্তফেনিল রণক্ষেত্রে চক্রধারী মূর্তিতে ব্রহ্মাবর্ত আর্যভূমির ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ; বৃন্দাবনলীলার রসতরঙ্গে উচ্ছল চিরকিশোর নায়ক। গ্রীক পুরাণের ‘দাফ্‌ণে’ (Daphne) বা 'ইয়স' (Eos)-এর অনুবর্তী ‘ফিবাস্ আপেলো’র মত তার নিঃসীম প্রেমাকুতি; আবার মেদুসা-বিনাশী পার্সিয়সের সঙ্গেও যেন কংসারী-কৃষ্ণ একপ্রাণ। শৌর্যপ্রকাশেও স্মরণীয়। তাঁদের কাব্য সেই মিশ্রলীলার রূপায়ণ।


পূর্ব চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব আখ্যানকাব্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’, বিল্বমঙ্গলের ‘কৃষ্ণকর্ণামৃত’, ঈশ্বরপুরীর ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ ও ‘রুক্মিণী-স্বয়ংবর’ এবং বাংলায় বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ও মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য। এছাড়া বিষ্ণুপুরীর বিষ্ণুভক্তিরত্নাবলী’, লক্ষ্মীধরের ‘ভগন্নামকৌমুদী’, শ্রীধর স্বামীর ‘ভাবার্থদীপিকা’ এবং ‘ব্রহ্মসংহিতা’ ইত্যাদি গ্রন্থের দার্শনিক তত্ত্ব ছিল চৈতন্যপূর্ব বৈষ্ণব ধর্মের ভাবাদর্শ। বাংলা দেশের সুধী সমাজে তখন অদ্বৈতমতের সমধিক প্রসার; স্মরণ মনন-নিদিধ্যাসনমূলক ভক্তিবাদ তখন আদৌ জনপ্রিয় নয়। মাধবেন্দ্রপুরী, বাসুদেব সার্বভৌম, ঈশ্বরপুরী, অদ্বৈত আচার্য প্রমুখ দার্শনিক ভক্তগণ অবশ্য ছিলেন মায়াবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে সমন্বয়কামী।


প্রাচীন বৈষ্ণব ভাবাদর্শ বিকাশের মূলে রাজ-আনুকূল্য এবং জনসংযোগ ছিল। গুপ্ত রাজগণের ‘পরমভাগবত’ উপাধি-ধারণ, ধর্মপাল ও নারায়ণ পালের নন্ন নারায়ণের ‘দেবকুল’ ও গরুড় স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা, হালের ‘গাথা সপ্তশতী’ ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এর রাই-এর উল্লেখ, সেনরাজগণের মধ্যে বিশেষতঃ লক্ষ্মণ সেনের সময়ে ‘গীতগোবিন্দ’, ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, ‘কবীন্দ্রবচন' প্রভৃতি গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণ প্রসঙ্গ-প্রচলন, রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ও জন ঐতিহ্যের পরিচয় দেয়। পণ্ডিতগণের অনুমান, খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে উত্তর ভারতে বিষ্ণু-উপাসনার অবক্ষয় শুরু হয়। অভিজাত ও অপজাত জনজীবনে পুরাণে বর্ণিত রাধাকৃষ্ণ লীলা বর্ণনার হয় জনপ্রিয়তা লাভ। খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পরে মুসলমান যুগেও মালাধর বসুর ইসলামী শাসকের (রুকনুদ্দীন বরবকশাহ্) পৃষ্ঠপোষকতা এবং বৃহস্পতি মিশ্র ও বাসুদেব সার্বভৌমের বৈষ্ণব ধর্মানুগত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকেরও আগে বিদ্যাপতি ও বড়ু চণ্ডীদাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাধা-প্রধান কৃষ্ণলীলার প্রসার ঘটে। সুতরাং, বলা চলে, কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক আখ্যানকাব্য রচনার পেছনে রাজ-সহযোগিতা এবং জন সমর্থন ছিল।


মহাপ্রভুর পূর্বে ভক্ত ও কবিমানসে বৈষ্ণব ভাবনার যে পরিচয় আখ্যান কাব্যগুলিতে পাওয়া যায় তার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের ভাবরূপ উপলব্ধিতে পরবর্তীকালের গৌড়ীয় বৈষ্ণব গোষ্ঠীর আবির্ভাব-ভক্তি-লীলা এবং প্রেমগত দৃষ্টিকোণে কিছু কিছু ব্যবধান লক্ষ করা যায়।


(ক) পৌরাণিক ধারণার অনুবর্তন : প্রাক্-চৈতন্য যুগের আখ্যানকাব্যে কৃষ্ণের আবির্ভাবের মৌল কারণ সম্বন্ধে কবিদের পৌরাণিক ধারণার অনুকরণ দেখা যায়। যেমন, বড়ু চণ্ডীদাস পদ্মপুরাণের ভাবানুযায়ী ভূভার হরণ ও কংসবধের জন্য কৃষ্ণকে অবতার রূপে স্মরণে উৎসুক। জয়দেবের কাব্যে রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রভাব অনুভূত হয় (তুলনীয় জয়দেবের “মেঘৈমেদুরমম্বরং বনভুবঃ....” ইত্যাদি পঙ্ক্তির সঙ্গে ঐ পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের “একদা কৃষ্ণসহিতো নন্দো বৃন্দাবনং যযৌ.... ইত্যাদি শ্লোকের)। আবার শুধু পুরাণ নয়, সম্ভবত লোকজীবন-উপাদান-নির্ভরতাও ছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকের (যেমন মালাধর বসু) হয়ত কাব্যরচনার বা কৃষ্ণ-শরণাগতির মূলে সমকালীন সঙ্কট ত্রাণ অথবা মুক্তি চিন্তাও কিছু পরিমাণে ছিল। মালাধর বসু বলেন—“লোক নিস্তারিতে যাই পাঞ্চালী রচিয়া।”


(খ) প্রাথমিক বৈষ্ণব ধর্মের ভিত্তি বৈদান্তিক ঈশ্বরবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত: ‘বিষ্ণু’ (ব্যাপ্নোতি ইতি বিষ্ণুঃ') এবং বিষ্ণুর অবতার ‘কৃষ্ণ’, বৈদান্তিক ঈশ্বর। কিন্তু তাঁর পরিচয় শুধু প্রজ্ঞাঘন নয়, তিনি রসময় এবং আনন্দস্বরূপেও স্বীকৃত। কৃষ্ণের এই ব্যাপ্ত স্বরূপের ফলে, কবিদের ধারণাতেও ঐশ্বর্য-মিশ্র ভক্তির প্রকাশ হয়ে ওঠে অনিবার্য। তাঁদের নান্দনিক উপলব্ধিতে তাই কৃষ্ণ কেবল মধুর নন, ঐশ্বর্য বা শক্তিরও প্রকাশক। জয়দেবের দশাবতার স্তোত্র, বড়ুর কৃষ্ণের দেবত্ব ক্ষমতার হুঙ্কার, বা মালাধরের ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে অনুভব করা যায় সেই বোধেরই উপস্থাপনা—

“কারে কেহো নাহি জিনে    কারে কেহো নাহি মারে।

কালরূপ হরি সবার ভালমন্দ করে ।”


(গ) ধর্ম এবং চিন্তার দ্বৈত প্রকাশ : কণ্ঠপীঠে কৃষ্ণনাম প্রতিষ্ঠা করে কাব্য রচনা করলেও পূর্বোক্ত আখ্যান কাব্যের কবিরা কেউ দীক্ষিত বৈষ্ণব নন; বড়ু চণ্ডীদাস বাশুলীর উপাসক। জয়দেবও 'সদুক্তিকর্ণামৃতে সাধারণ স্মার্ত হিন্দুর মত বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতি ভক্তি-নিবেদনে অকুণ্ঠ। বস্তুত তাঁদের কৃষ্ণপ্রাণতার মূলে ছিল সম্ভবত ভাগবতে বর্ণিত বৈধী ভক্তি, লৌকিক ও রাজসভাগত ঐতিহ্য এবং মোক্ষবাসনা— ‘ভবসিন্ধু’ থেকে পরিত্রাণের জন্য এযুগের কবিরা প্রার্থনায় হয়েছেন নমনীত। সেক্ষেত্রে তাদের আচরিত ধর্ম এবং ভাবিত বিশ্বাসে তাই কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। প্রাচীন বৈষ্ণবদের উপাস্য ছিলেন বিষ্ণু। মুক্তিলাভের জন্যই তাদের তনু-মন সমর্পণের তর্পণ; কিন্তু পরবর্তীকালে চৈতন্য-ভাবিত বৈষ্ণব সাধকের আরাধ্য হলেন কৃষ্ণ, ‘অহৈতুকী ভক্তি’ প্রাপ্তির জন্য কস্তুরী ধূপের মত জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হওয়াই হল তাদের স্বভাব-ধর্ম।


(ঘ) প্রেম বর্ণনায় আদিরসাত্মক ভক্তি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী: রাধাকৃষ্ণ লীলা-বিষয়ক প্রাচীন আখ্যানকাব্যে কবিদের উদ্দেশ্য “শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান” রচনা নয়। এই লীলা বর্ণনা চিত্র তাদের কাব্যে যতখানি দৈহিক ততখানি আধ্যাত্মিক নয়। আবার সুফী ধর্মের ‘লায়লা-মজনু’ বা ‘শিরী-ফরহাদে'র অথবা বাইবেলের ‘The Song of Solomon'-এর মত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’ কিম্বা কিছুটা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ কবির প্রেম-চেতনার সঙ্গে একটি আদিরসাত্মক ভক্তিভাবের স্বর সংযোগ আমরা লক্ষ্য করি।


চৈতন্যপূর্ব যুগে বিষ্ণু ছিলেন প্রাচীন বৈষ্ণব এবং লোকসমাজের কাছে মূলতঃ ‘বিশ্বম্ভর’ আশ্রয়। তাই দেখা যায়, বাংলা থেকে কামতা-কামরূপ-আসাম পর্যন্ত কবিদের কণ্ঠে বারবার বৈষ্ণব ভাবের আবেশ; জয়দেব-চণ্ডীদাস থেকে পীতাম্বর-শঙ্করদেব পর্যন্ত কবিদের মধ্যে সেই ভক্তি ও কবি-মানসের একটি সেতুবন্ধী ঐতিহ্য-রূপ। পরবর্তীকালের চৈতন্য-ভাবিত বৈষ্ণব ধারণার সঙ্গে তাঁদের ভাবগত পার্থক্য অনেক, যেমন ‘খ্রীস্ট’ উভয়ের উপাস্য হলেও ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে বিভেদ দেখা গেছে। তবু বৈষ্ণব দর্শন ও ভক্তিবাদের প্রাথমিক ইতিহাস রূপে পূর্ববর্তী বৈষ্ণবগণের আশ্রিত কৃষ্ণ ভাবনার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।