শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবি জয়দেবের প্রভাব

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবি জয়দেবের প্রভাব


শতাব্দীর সিঁড়ি বেয়ে প্রাচীনের সীমান্ত পেরিয়ে জয়দেব তাঁর কাব্যের ভাব ভাষা ও আখ্যানের সমবায়ে প্রথম যে বাঙালী কবির চেতনায় আত্মীয় হয়ে ওঠেন—তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা চণ্ডীদাস। একথা অনস্বীকার্য 'নৃপচ্চকৈব' জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যভাণ্ডার থেকে সজাতি এবং বিভাষী বহু কবি (যেমন, বিদ্যাপতি, বিঠঠল দাস ইত্যাদি) সেযুগে এবং পরবর্তীকালে ইচ্ছামত সম্পদ তুলে নিয়েছেন। সেই বড়ু চণ্ডীদাসও নির্বিচারে আবহমান কাব্যধন থেকে লুঠ করেছেন বহু পক্তি, সাহিত্য জগতে যা আদৌ দোষের নয়। আমরা জানি বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের চারপাশের জগৎ এবং তার মনোজগৎ জয়দেবের মতো সমৃদ্ধ সুষম অথবা সংস্কৃত ছিল না, ছিল না গৌড়ীয় রাজসভার দরবারী জৌলুষ অথবা কল্পনার রংমহল। তবু শোভা না থাক সভা ছিল সাধারণের, কাহিনী ছিল আগ্রহও ছিল তাকে রূপায়ণের। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র মধ্যে ‘গীতগোবিন্দে’র প্রভাব কতটুকু লক্ষণীয় আপাততঃ সেটি বিচার্য।


গঠনগত দিক: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির কাহিনী কতকগুলি খণ্ডে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি বিশেষ নাম-চিহ্নিত ; যেমন প্রথম খণ্ড 'জন্ম', দ্বিতীয় 'তাম্বুল’, তৃতীয় ‘দান’ ইত্যাদি এবং শেষে সমাপ্তি বাক্য—“ইতি জন্মখণ্ডং সমাপ্তং”, “ইতি তাম্বুল খণ্ডং সমাপ্তং” প্রভৃতি। দীর্ঘায়ত কাহিনীকে নির্দিষ্ট পর্যায়ে পালাগানে পরিবেশন করার জন্যে এইভাবে পার্থক্য নির্দেশ অবশ্য স্বাভাবিক। পণ্ডিত কবি পুরাণের সর্গ-বিভাগ রীতি স্মৃতিধার্য করতে পারেননি হয়ত এ ব্যাপারে। তবু অনতি-পূর্ববর্তী ‘গীতগোবিন্দ' কাব্যের আখ্যান-বিন্যাসেও লক্ষ্য করা যায় সর্গ-বিভাগ, নাম-নির্দেশ এবং সমাপ্তিবাক্য উচ্চারণ প্রবণতা; যেমন 'সামোদদামোদরঃ’, ‘অক্লেশকেশবঃ’, ‘মুগ্ধ মধুসূদনঃ' ইত্যাদি নাম এবং সর্গের শেষে “ইতি শ্রীগীতগোবিন্দ মহাকাব্যে সামোদদামোদরাঃ নাম প্রথমঃ সর্গঃ” প্রভৃতি।


গীতগোবিন্দের বিভিন্ন রাগরাগিণী ও তাল-লয়ের উল্লেখ রীতি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যেও আছে। গীত-রাগিণীর ক্রমান্বয় উল্লেখের ভেতর দিয়ে সাঙ্গীতিক ভাবানুসঙ্গ এবং মঙ্গলগীতের প্রবণতা বড়ুর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। (স্মরণীয়, ‘মঙ্গলম্ উজ্জ্বল গীতি, গীতগোবিন্দ ১/২৫) এই মঙ্গলগীত বাঙালীর নিজস্ব এবং বিশিষ্ট শিল্পসৃষ্টি, সংস্কৃত বা অন্যান্য প্রাদেশিক সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত দুর্লভ।


‘গীতগোবিন্দ’ নানা চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তি-সমন্বিত নাট্যলক্ষণযুক্ত কাব্যগ্রস্থ। কবির বিবরণ ছাড়াও আছে রাধা-কৃষ্ণ, রাধা-সখী এবং কৃষ্ণ-সখীর মধ্যে কথোপকথন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও আছে অনুরূপ উপস্থাপনা। পার্থক্য কেবল পূর্ববর্তী কাব্যের প্রধান তিন চরিত্র রাধা কৃষ্ণ ও সখী এখানে হয়েছে রাধা কৃষ্ণ এবং বড়াই। সাধারণভাবে আমরা জানি, আলোচ্য গ্রন্থ লোক-প্রচলিত ‘কৃষ্ণ-ধামালী' নামাঙ্কিত আদিযাত্রা বা নাটগীতের রূপভেদ। এ প্রসঙ্গে কবির সূক্ষ্ম একান্ত দেশজ ঐতিহ্যবোধের কারণ নির্ণয়ে ঈষৎ পিছনে তাকানো যেতে পারে। বংশীখণ্ডে বর্ণিত হয়েছে— “বড়াই লইঞা রাহী গেল সেই থানে। সখি সবে বুলে রাধা লড়িউ সিনানে।।/ষোল শত গোপী গেল যমুনার ঘাটে।/তা দেখিয়া কাহ্নাঞিয়া পাতিল নাটে৷৷' আয়োজিত এই ‘নাট' কৃষ্ণকীর্তনের রূপকল্পে বর্তমান তবু উল্লেখযোগ্য, অসমীয়া নাটকের প্রচলিত নামও ‘নাট’; সংস্কৃত নাটক অথবা নাটিকা কোন নিয়মই তা অনুসরণ করে না। অবশ্য একথাও ঠিক, রামসরস্বতী-কৃত ‘গীতগোবিন্দে’র অসমীয়া ভাষান্তর যেখানে স্থানীয় বর্ণালী সত্ত্বেও সংস্কৃতানুগ ও ধর্ম-নির্ভর, সেখানে বড় চণ্ডীদাসের কৃষ্ণকীর্তনের ধর্মাশ্রয়িতা নিতান্তই গৌণ ব্যাপার। আসলে গীতগোবিন্দে বাঙালি লোক-স্বভাবের যে সব রূপ-বিভঙ্গ মূর্ত হয়েছিল, বিশেষতঃ নাটগীতের বর্ণনা গীতি-সংলাপ প্রভৃতি গঠনশিল্পে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে অব্যবহিতরূপে তারই প্রাণাবেগ স্পন্দিত পূর্ণায়ত শিল্পরূপ ধারণ। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন বাংলা কাব্যের আদি ভূসংস্থানে বড়ু চণ্ডীদাসই পিতৃকল্প জয়দেবের প্রথম উত্তরসূরী, যদিও ঠিক সর্বশ্রেষ্ঠ নন।


শিল্পগত বিচারে শব্দচয়নে, উপমা-সন্নিবেশে, চিত্রকল্প-সংস্থানে বড়ু চণ্ডীদাস জয়দেবের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। গীতগোবিন্দের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও দশম সর্গের অন্তর্গত কোনো কোনো পদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বহু পঙক্তির সাদৃশ্য আছে, আছে কিছু আক্ষরিক অনুবাদ, কিছু ভাবানুবাদ।


প্রেম এবং বিরহ উপলক্ষে চন্দ্র, চন্দন, মলয়পবন, কিশলয়, শয়ন, মদনবাণ ইত্যাদি কবিপ্রসিদ্ধি জয়দেব থেকে চণ্ডীদাসের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। জয়দেব বলেন— “নিন্দতি চন্দনমিন্দুকিরণসনুবিন্দতি খেদমধীরস্। (৪র্থ সর্গ) কাল নিলয়মিলনেন গরলমির কলয়তি মলয়সমীরম্” অর্থাৎ কৃষ্ণবিরহে খেদে শ্রীরাধা চন্দন ও চন্দ্রকিরণের নিন্দা করছেন, মলয় পবন তাঁর কাছে বিষের মতো লাগছে।


বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যেও শুনি,

‘নিন্দএ চান্দ চন্দন রাধা সব খনে। 

গরল সমান মানে মলয় পবনে ।।


আলোচ্য উদাহরণটিকে ‘এক পরিকার্য’ও বলা যায়। রাজশেখর তার ‘কাব্যমীমাংসা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, কোনো লেখক যখন পূর্বসূরীর কাছ থেকে বর্ণনাভঙ্গী গ্রহণ করে তাকে সম্পূর্ণ অন্য ভঙ্গীতে ব্যবহার করেন তখন তাকে ‘এক পরিকার্য’ রীতি বলা যায়।


উপমা-সন্নিবেশেও একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়—“স্বহৃদয়মমণি বর্ম করোতি সজলনলিনী দলজালম্” ইত্যাদি (৪র্থ সর্গ) অংশের সঙ্গে “হৃদয়ে নলিনীদল সংনাহা করে” প্রভৃতি পক্তির ('রাধাবিরহ)। রাধার রূপ বর্ণনায় এই একানুভূতি বিশেষভাবে স্পষ্ট ; যেমন জয়দেবের “নীল-নলিনাভমপি তন্বি তব লোচনম্ ধারয়তি কোকনদরূপম্” ইত্যাদি দৃষ্টাস্তে নির্মিত বড়ুর “তোমার নয়ন মলিন নয়ন ধরে কোকনদ রূপে” প্রভৃতি পক্তি।


“বনের হরিণী কেন তরাসিল মনে” বড়ুর কাব্যে প্রতিফলিত রাধা-চিত্তের এই চিত্রকল্প মনে পড়িয়ে দেয় জয়দেবের “সাচি ত্বদ্বিরহেণ হস্ত হরিণী রূপায়ণের” ইত্যাদি শ্লোকের।

জয়দেবের পদের সহজ ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ দেখা যায় বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে :

“রতি সুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহর বেশম্।

ন কুরু নিতম্বিনী গমন বিলম্বনমনুগর ত্বং হৃদয়েশম্॥


চণ্ডীদাসে আছে :

“তোর রতি আশোআর্শে গেলা অভিসারে।

সকল শরীর বেশ করী মনোহরে ৷৷

না কর বিলম্ব রাধা না করহ গমনে।

তোহ্মার সঙ্কেত বেণু বাজএ যতনে ॥”


এখানে অগোচরে মুগ্ধ কবি-মন যেন রাধা চিত্তে অতিরিক্ত বেণুর সুর বাজিয়ে তুলতে চেয়েছে। বিপরীত দৃষ্টাত্তও আছে, যেমনজয়দেবের পদে আছেঃ

“স্তনবিনিতমপি হারমুদারম্।

সা মজুতে কৃষ্ণনুরিব কারম্ ॥”


চণ্ডীদাসের কবিতায় আছে -

“তনের উপর হারে আল মানএ যেহেন ভারে।

অতি হৃদয়ে খিনী রাধা চলিতে না পারে ।”


ভাগবতে এক জায়গায় বলা হয়েছে, 'ভগবান্ প্রাকৃত যথা”। সম্ভবতঃ সেই সমর্থনে চিরায়ত ও দুরারোহ কৃষ্ণ কথাকে রোমান্টিক এবং মানবিক পরিমণ্ডলে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন জয়দেব। আবার ‘হরিস্মরণ' ও 'বিলাসকলার' সমন্বয় চেষ্টায় তাঁর গীতগোবিন্দ “religious erotic poem” বলে মনে হয়েছে কোনো কোনো সুধীজনের কাছে (যেমন Winternitz, বঙ্কিমচন্দ্র ইত্যাদি)। তথ্যগত সাক্ষ্যে আমরা জানি, বড় চণ্ডীদাস কোনো পূর্বধার্য দার্শনিক অথবা আত্মলীন ভক্তি-প্রকল্পনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই কাব্য লেখেন নি। তবু মনে হয়, কাব্যদেহে রতিচেতনাকে জাগিয়ে তোলার মূলে তৎকালীন লোক-রুচির পৃষ্ঠপোষণা ছাড়াও ছিল জয়দেবের শৈল্পিক সমর্থন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অজস্র জয়দেবীয় পক্তি উদ্ধার হয়ত সেই কারণেই।