চর্যার রচনাকাল

চর্যার রচনাকাল


চর্যার রচনাকাল বিচারে তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় : (ক) ভাষাতাত্ত্বিক, (খ) অনুবাদ-নির্ভর, (গ) কবি-নির্ভর।


ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী ড. সুনীতিকুমার চর্যার রচনাকাল ৯৫০-১২০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে স্থির করেছেন। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নেপালী এবং তিব্বতী অনুবাদের প্রমাণ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত করেছেন চর্যার প্রাচীনতম কবি ৭ম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় কবি-নির্ভর এক নতুন ভাবনা প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে তার ভাবনার উৎস, তিব্বতী অনুবাদ ও টীকা। ঐতিহাসিক Dr. R.C. Majumdar History of Ancient Bengal' গ্রন্থে সুখময়বাবুর একটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধ উল্লেখ করেছেন : 'The age of the language is not necessarily the age of the poets also. That Popular songs recited from mouth to mouth and copied from one manuscript to another gradually undergo material linguistic changes is proved by several instances." (Ibid, P. 342). এই দিক থেকে তার সিদ্ধান্তটি ভাবনার এক নতুন দিক নির্দেশ করে। চর্যাগীতির ভাষার বয়স আর কবিদের বয়স একই পর্যায়ভুক্ত না-ও হতে পারে। কারণ অনুমান করা যেতে পারে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বাহিত চর্যাগীতি বা কবিতাগুলি ছিল প্রথমে মুখে মুখে উচ্চারিত বা স্মৃতি বাহিত। তা পরে পুঁথিতে অনুলিখিত হয়। পুঁথিতে ভাষাগত বিবর্তনের রূপটিও এইভাবে প্রকাশ পায়।


ড. সুনীতিকুমারের ও ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যাগুলি খ্রীঃ ১০ম-১২শ শতকের মধ্যে রচিত। ড. শহীদুল্লাহ এবং পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, দোহা ও চর্যার রচনাকালকে আরো দু’শ বছর পিছিয়ে দিয়ে ৮ম-১২শ শতকের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।


রাহুলজী ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী' গ্রন্থে 'Journal Asiatique' নামক পত্রিকায় দেখাতে চেয়েছেন লুইপাদ এবং সরহপাদ দুজন প্রাচীন সিদ্ধাচার্য ধর্মপালের সমসাময়িক (৭৬৯–৮০৯ খ্রীস্টাব্দ); ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র আলোচনায় ভুসুকু ও কাহ্নপাদকে ৮ম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন।


চর্যাপদগুলির সঙ্কলনের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন যে, লুইপাদের 'অভিসময় বিভঙ্গ' গ্রন্থ রচনার সময় প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সাহায্য করেছিলেন। কথিত আছে, ৫৮ বছর বয়সে শ্রীজ্ঞান তিব্বতে যান (অর্থাৎ ১০৩৮ খ্রীস্টাব্দ)। সেক্ষেত্রে লুইপাদের ১০ম শতাব্দীর নিকটবর্তী সময়ে আবির্ভূত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তিব্বতী কিংবদন্তী অনুসারে, লুইপাদ সিদ্ধাচার্যদের আদি গুরু। সুতরাং এই সূত্র অনুসারে চর্যা রচনার প্রাচীনতম সীমা ১০ম শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত মনে করা যেতে পারে। তবে চর্যার রচনাকালের ঊর্দ্ধতন কালসীমা সম্বন্ধে অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন : দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যে ৫৮ বছর বয়সে তিব্বতে গিয়েছিলেন এ তথ্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কোথায় পেয়েছেন, সেক্ষেত্রে চর্যাপদ রচনার সূচনা ১০ম শতাব্দী ভাবা যেতে পারে কি?


ড. সুনীতিকুমার তাঁর 'The Origin and Development of Bengali Lan guage' নামক গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড) এবং ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী তার 'Dohakosa' গ্রন্থে চর্যার রচনা সময় ১০ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যে মনে করেন। কাহ্নপাদ-গোরক্ষনাথের আনুমানিক আবির্ভাবকাল ধরে ড. সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত, চর্যাগুলি ঐ ৯৫০ হতে ১২০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে রচিত। তার মতে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র ভাষা মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার প্রথম স্তরের অন্তর্ভুক্ত; এর রচনাসীমা আনুমানিক ১৪শ শতকের শেষভাগ। চর্যার ভাষা এর অপেক্ষা দেড়শ বছর আগের; অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের বিচারেও এর অনেক পদ ১২শ শতাব্দীর রচিত বলে মনে হয়।


১. কাহ্নপাদ ও গোরক্ষনাথের আবির্ভাবের আনুমানিক কাল ধরে চর্যার রচনাকালের সীমা নির্ধারণ করা অসম্ভব নয়। কেননা পণ্ডিতাচার্য শ্রীকৃষ্ণ পাদ রচিত ‘হেবজ্রপঞ্জিকা যোগরত্নমালা’ (কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত) নামক একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ পালবংশের মতে, তিব্বতে একাধিক কাহ্নপাদের উল্লেখ সত্ত্বেও চর্যার কাহ্নপাদ এবং এই বৌদ্ধতন্ত্র গ্রন্থের পণ্ডিতাচার্য শ্রীকৃষ্ণপাদ অভিন্ন ব্যক্তি; কারণ চর্যার একস্থলে কাহ্নপাদ 'পণ্ডিতআচায়ে' অর্থাৎ পণ্ডিতাচার্য বলে উল্লিখিত হয়েছেন। কাহ্নপাদের কোন কোন টীকায় 'কৃষ্ণাচার্য' নামও পাওয়া যায়।


২. নাথ সাহিত্যে বা ধর্মের সাক্ষ্য অনুযায়ী গোরক্ষনাথের শিষ্য হলেন জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা এবং তারই শিষ্য কানুপা বা কাহ্নপাদ।


৩. মারাঠী গ্রন্থ 'জ্ঞানেশ্বরী' (আনুমানিক ১২৯০ খ্রীস্টাব্দ) হতে মনে হয়, উক্ত গ্রন্থের লেখক জ্ঞানদেব তাঁর অগ্রজ নিবৃত্তিনাথের কাছে দীক্ষালাভ করেন ১২৭৩ খ্রীস্টাব্দে। নিবৃত্তিনাথের গুরু গেইনীনাথ বা গোয়নীনাথ (মতান্তরে জ্ঞানীনাথ)। এই গেইনীনাথের দীক্ষা গুরু গোরক্ষনাথ। তাঁর অপর শিষ্য জালন্ধরিপাদ, তাঁরই শিষ্য কৃষ্ণপাদ বা কাহ্নপাদ। অতএব অনুমান হয় যে, কৃষ্ণপাদের বা কৃষ্ণাচার্যের আবির্ভাবকাল সম্ভবতঃ ১২শ শতাব্দী।


এইসব প্রমাণের ফলে চর্যাপদের রচনাকালকে স্থূলতঃ ১০ম–১২শ শতাব্দীর মধ্যে স্থাপন করা যেতে পারে বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন।