“কাব্যধর্ম, নাটকীয়তা, ভক্তিপ্রাল্য ও সমাজচিত্রের বিচারে 'আগমনী’ ও ‘বিজয়া’ শ্রেণীর পদগুলির অন্য কোনো শ্রেণীর পদের তুলনা হয় না।"—মন্তব্যটির সমর্থনে বা বিপক্ষে যুক্তিসহ আলোচনা করো।

শাক্ত পদাবলীর 'আগমনী' ও 'বিজয়া' পর্যায়ের অন্তর্গত পদসমুহের কাব্যমূল্য নিরূপণ করো।


আগমনী-বিজয়ার কাব্যমূল্য

অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভকাল। মুগল সম্রাট ঔরংজীবের দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীতে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ দেখা দেয়, অনতিবিলম্বেই সুদূর গৌড়বঙ্গেও তার ছায়া পড়েছিল। সেই ছায়ায় আলোর দিকটা প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, যেমন অমাবস্যার অন্ধকার দেশটাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। তিন শতাব্দী পূর্বে দেশের অনুরূপ অবস্থায় যুগাবতার চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব দেশকে সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু এ কালে তেমন কোনো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব না ঘটায় বাঙালী জীবনের যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, তা থেকে উদ্ধারের কোনো পথ জানা ছিল না। এ সময় অদ্ভুত একজন কবি এই অন্ধকারের মধ্যেও বিদ্যুৎচমকের মতো আলোর স্ফুরণ লক্ষ্য করেছিলেন। সামগ্রিক অব্যবস্থার মধ্যে জগজ্জননীর নিকট শরণ গ্রহণকেই তিনি আত্মরক্ষার উপায় বলে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি নতুনভাবে দেবীর সাধনায় অগ্রসর হয়েছিলেন—কবি দেবীর নিকট সুখ-দুঃখ-সমন্বিত জীবন নিয়ে একেবারেই আত্মসমর্পণ করে বসলেন—এই কবিই সাধকপ্রবর রামপ্রসাদ রামপ্রসাদ তার সাধনা তথা মাতৃ-বন্দনামূলক শাক্ত পদ রচনার মধ্য দিয়েই তার মনোভাব প্রকাশের সুযোগ গ্রহণ করেছেন।


শাক্ত পদাবলীর দু'টি ধারা— 'উমাসঙ্গীত' বা 'আগমনী-বিজয়া' এবং 'শ্যামাসঙ্গীত' বা ‘সাধনতত্ত্ব-বিষয়ক’ কবিতা। এই দুটি ধারারই প্রবর্তক রামপ্রসাদ সেন। তিনি স্বয়ং সাধক ছিলেন বলেই সম্ভবত সাধনতত্ত্ব সম্পর্কিত শ্যামাসঙ্গীতের ওপরই সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারার অন্তর্গত যাবতীয় পর্যায়েই বহু পদ রচনা করেন। পক্ষান্তরে 'আগমনী বিজয়া'-বিষয়ক পদ রামপ্রসাদ অতি অল্পই রচনা করেছিলেন। তবে তিনি এই যে ধারাটির প্রবর্তন করেছিলেন তা কিন্তু একাল পর্যন্ত সচল রয়ে গেছে, সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্যে এটি একটি বিস্ময়কর এবং উৎসাহজনক ব্যতিক্রম বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। ক্রান্তিকাল এবং আধুনিক কালেরও অনেক কবি এই আগমনী-বিজয়া বিষয়ক দুটি-একটি পদ রচনা করলেও আঠার শতকের শেষপাদ এবং উনিশ শতকের প্রথম পাদে বর্তমান কমলাকান্তই সম্ভবত এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি।


আগমনী-বিজয়ায় তথা উমাসঙ্গীতে আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি ভগবতীকে কন্যারূপে ভজনা করা হয়েছে। দক্ষকন্যা সতী পতিনিন্দা শ্রবণে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করে হিমালয় দুহিতা উমারূপে জন্মগ্রহণ করেন। কাহিনীটি পৌরাণিক হ'লেও শাক্তপদ যেভাবে এটিকে বর্ণনা করেছেন, তা একেবারেই বাঙালী ঘরের কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালী জীবনের এমন অন্তরঙ্গ পরিচয় কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাঙ্গালার জলবায়ুতে মধুর রস বিরাজ করে, তাই বাঙ্গালাদেশে অত্যুগ্র চণ্ডী ক্রমশ মাতা অন্নপূর্ণারূপে, ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদ-বিধুর কন্যারূপে—মাতা, পত্নী ও কন্যা, রমণীর এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দররূপে দরিদ্র বাঙ্গালীর ঘরে মধুর রস সঞ্চার করিয়াছেন।” আগমনী-বিজয়ায় যে বাৎসল্যরসের পরিচয় পাওয়া যায়, তা বৈষ্ণব কবিতার অনুসরণে রচিত হলেও মানবিক আবেদনের দিক থেকে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্টতর। 'বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়া'—উমাসঙ্গীতের এই তিনটি খণ্ডেই বাৎসল্যরসের অনুপম প্রকাশ ঘটেছে। কন্যারূপিণী ভগবতী দুর্গা যেন পতিগৃহ থেকে তিন দিনের জন্য পিতৃগৃহে আসেন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পিতৃগৃহে অবস্থান করে বিজয়া দশমীতে আবার বিদায় গ্রহণ করেন। কন্যাকে ঘিরে মাতৃহৃদয়ের আনন্দ ও ব্যাকুলতা এই আগমনী-বিজয়ার গানগুলিতে অপূর্ব সুন্দরভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের বেদনার মধ্যে কন্যাবিদায়ের বেদনাই নিহিত। ইংরেজ কবি যে লিখেছেন—“Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts – তা' যে কতদূর সত্য, তা এই পদগুলি পাঠ করলেই বোঝা যায়। পারিবারিক জীবনের বিচিত্র অনুভূতির এমন সংযত, সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ বিশ্বসাহিত্যের অন্যত্র দুর্লভ।


সাধারণভাবে শাক্তপদাবলীকে গীতিকবিতা বলে অভিহিত করা হলেও আধুনিক কালের গীতিকবিতার মতো এগুলি তেমন সুখপাঠ্য নয়। এই পদগুলির সঙ্গে সুর এমন অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত যে শুধুমাত্র পাঠ বা আবৃত্তির সাহায্যে এর রস পরিপূর্ণভাবে আহরণ করা যায় না। এদিক থেকে বৈষ্ণব কবিতার স্থান শাক্তপদের ঊর্ধ্বে। কিন্তু শাক্ত পদাবলীর আগমনী বিজয়াসঙ্গীতে কবিহৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস ঘটায় এগুলিকে গীতিকবিতাই বলতে হয়।


শাক্ত কবিতার কাব্যোৎকর্ষ সাধারণভাবে বৈষ্ণব কবিতার তুল্য না হলেও বাৎসল্য রসের বিচারে যে আগমনী-বিজয়ার গানগুলি বৈষ্ণব পদ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট এ কথা সুধীজন একবাক্যে স্বীকার করে থাকেন। সুধী সমালোচক ডঃ সুধীরকুমার দাশগুপ্ত বলেন, "শাক্ত পদের বাৎসল্যভাব কেবল ভাবজগতে নয়, বাস্তব জগতেও ব্যাকুলতা, গভীরতা ও নিবিড়তায় অপূর্ব, তুলনায় অনেক সময় কানাইয়ের গোচারণ অবলম্বনে রচিত বৈষ্ণব বাৎসল্যভাব পোষাকী বলিয়া মনে হয়।"


আগমনী-বিজয়া সঙ্গীতের অন্তরঙ্গ-বিচারে এতে আত্মজনদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কের যে আন্তরিক, বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবচিত্র রচিত হয়েছে তাকে এক কথায় তুলনাবিহীন বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে ভাব তথা বিষয়বস্তুর পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। খুব সুস্পষ্ট না হলেও সনিষ্ঠ অধ্যয়নে এই পদগুলির আধ্যাত্মিক মূল্যও পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।


ডঃ শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, “ বিশ্বজননীকে কন্যারূপে কল্পনা ও আরাধনা ভারতীয় আত্মসাধনার অন্যতম আশ্রয় এবং এই সাধনাকে আশ্রয় করিয়াই মাতৃহহৃদয়ের বাৎসল্য অপূর্ব অধ্যাত্মরূপ লাভ করিয়াছে। অধ্যাত্মসাধনার গূঢরসকে দৈনন্দিন জীবনে এই ধরনের রূপান্তর বিরল।” এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে পদগুলির আধ্যাত্মিক মূল্য স্বীকৃত হলেও এখানে দেবী দুর্গার ঐশ্বর্যরূপ নয়, তার মানবী স্বরূপের মাধুর্যরসের ধারাই এখানে প্রকাশিত হয়েছে।


শাক্ত পদাবলীতে বাৎসল্যরসের মধ্যেও প্রকৃতপক্ষে ভক্তিরসই যে প্রকাশ পেয়েছে, তা' প্রায় স্বতঃসিদ্ধ রূপেই স্বীকার্য। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে শ্রীরূপ গোস্বামী যাবতীয় পঞ্চরসকে ‘ভক্তিরস নামে আখ্যায়িত করেছেন। কন্যার প্রতি মায়ের স্নেহপ্রবণতার মধ্যেই তার প্রকাশ ঘটেছে— বস্তুত এটিই শাক্তসাধকদের সাধনার পদ্ধতিবিশেষ। এ ছাড়াও 'আগমনী-বিজয়া' পর্বে খনে খনে কবিদের মনে আধ্যাত্মিক ভাবের জাগরণ ঘটে গেলে অনেক সময় তাতে ঐশ্বর্যরসের উদ্বোধন ঘটে এবং তার মধ্য দিয়ে উমাতেই জগজ্জননীর রূপ আরোপিত হয়, ভক্তিরসের তখন ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস।


ভক্তির প্রবলতা এবং কাব্যধর্ম ছাড়াও শাক্তপদাবলীতে 'আগমনী-বিজয়া' পর্বে অপর যে দু’টি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তার একটি এর সমাজচিত্র, অপরটি এর নাটকীয়তা। শাক্তপদাবলীর ‘আগমনী' ও 'বিজয়া'র পদগুলিতে প্রধানত পারিবারিক চিত্রই প্রাধান্য পেলেও সমাজচিত্রও মোটেই উপেক্ষিত হয়নি, বরং ঐতিহাসিক দিক্‌ থেকে এর মূল্যই অধিকতর বলে স্বীকৃত হয়ে থাকে। এতে পাচ্ছি আমরা গৌরীদান-রূপে অপরিণতা বালিকা বিবাহের দৃষ্টাস্ত, বহুবিবাহ প্রথা (উমার সতীন গঙ্গা), বৃদ্ধ ও সাংসারিক বিষয়ে উদাসীন স্বামীর ঘরে স্ত্রীর দুর্গতি (শিব-সম্বন্ধে অভিযোগগুলিতে), কন্যার পিতৃগৃহে আগমন-বিষয়ে স্বীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে কন্যার অপারগতা ও স্বামীর সম্মতির অপেক্ষা, কন্যার জন্য জননীর দুশ্চিন্তা, প্রতিবেশিদের পরস্পর সম্বন্ধে আগ্রহ, পিতৃগৃহে বিবাহিতা কন্যার স্বল্পকালীন অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এই চিত্রগুলি একান্ত বাস্তব এবং সমকালীন যুগের মধ্যবিত্ত বাঙালী-জীবনের এক নির্ভরযোগ্য দলিলরূপে বিবেচিত হতে পারে।


শাক্তপদগুলির নাটকীয়গুণ অসাধারণ। প্রায় প্রতিটি পদই উক্তি-মূলক, বর্ণনা প্রায় নেই বল্লেই চলে। অধিকাংশ পদই মেনকার উক্তি, কাউকে না কাউকে উদ্দেশ্য ক'রে বলছেন। অল্প কয়টি পদ গিরিরাজ এবং পদাংশ উমা ও শিবের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। ফলে অধিকাংশ পদকে আমরা, একালের পরিভাষায় নাটকীয় একেশক্তি' (dramatic monologue) নামে অভিহিত করতে পারি। আবার কোনো কোনো পদ উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলকও বটে। রামপ্রসাদ রচিত ‘ওগো রাণি’ নগরে কোলাহল' (৪৯ নং পদ) পদটিতে মা মেনকা, জয়া এবং উমার কথোপকথন রয়েছে।


Flash back সহ পুরাদস্তুর একটি নাটকের দৃশ্য। শাক্তপদকর্তারা একটি পদ রচনা করেছেন বলে সাধারণভাবে একটি পদে একজনের উক্তিই ব্যবহৃত হয়েছে তার উত্তরটি পরবর্তী কোনো এক পদে ব্যক্ত হয়েছে। কোনো নিপুণ সম্পাদক যথোপযুক্তভাবে পদগুলি সম্পাদনা করতে পারলে শাক্তপদাবলীকে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক-রূপে উপস্থাপিত করতে পারেন। শাক্তপদাবলীর নাটকীয়ত্বের এর চেয়ে বড় প্রমাণের কী প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই যে, শাক্ত পদাবলীর অধিকাংশ পদেই এই স্বরবৃত্ত তথা লৌকিক ছন্দের নির্বোধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কথ্যভাষার ভিত্তিতে রচিত বলেই ছন্দ ব্যবহারই একান্ত স্বাভাবিক উপায়।


(১) ভাষা : আগমনী-বিজয়ার পদগুলির বহিরঙ্গ বিচারে এর ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারাদির ব্যবহার প্রসঙ্গ অবশ্যই বিচার্য। এই পদগুলির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এর ভাষা। বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এর ভাষা সরল, সহজ, প্রাণবস্তু এবং আন্তরিকতাপূর্ণ। একটি মাত্র দৃষ্টান্তের উল্লেখ থেকেই বক্তব্যের সার্থকতা প্রমাণিত হবে।

“গিরি এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না। 

বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।।

যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয়

এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানবো না।”  (রামপ্রসাদ)

“এই জাতীয় গানের ভাষার সকরুণ ইঙ্গিত, ইহার অনাবিল আবেগ এবং ইহাদের একান্ত ঘরোয়া সুরের মধ্যে করুণ মাধুর্যের ব্যাপ্তি বাঙালীর ভাবমুগ্ধ চিত্তকে এক মুহূর্তে জীবনের গভীরতার মধ্যে টানিয়া লয়।"


সহজ সরল অনলঙ্কৃত ভাষায় প্রাণের কথা নিবেদনের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও অকৃত্রিমতা বিদ্যমান, তারই পরিচয় আমরা পাই আগমনী বিজয়ার পদে। কবিতায় মৌখিক ভাষার প্রয়োগ— যা আধুনিক যুগেও দীর্ঘকাল ছিল অনতিলক্ষ্য, আগমনী-বিজয়ার গানে কিন্তু তারও পরিচয় পাওয়া যায়। রামপ্রসাদের রচনায় কথ্যভাষার প্রয়োগ পূর্বোক্ত দৃষ্টান্তটিতে সহজলভ্য;


কমলাকান্তের রচনায়ও অনুরূপ দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়

'ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে। 

মনোনুঃখে নারদে কত না কয়েছে।

দেব দিগম্বরে সঁপিয়ে আমারে

মা বুঝি নিতান্ত পাসরেছে।।'


কোনো অজ্ঞাত লেখকের রচনায়

'ঘর জামাতা করে রাখবো কৃত্তিবাস,

গিরিপুরে করবো দ্বিতীয় কৈলাস 

হরগৌরী চক্ষে হেরবো বারমাস,

বৎসরাস্তে আনুতে যেতে হবে না।।'


অধিকাংশ সমালোচকই এই সহজ স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত ভাষাকেই কবিতার পক্ষে ভাবের অনুগামী সার্থক ভাষা বলে প্রশংসা করে থাকেন। কাব্যের মূল বিচারে কথ্য ভাষার অভিব্যঞ্জনাকে কোনক্রমেই উপেক্ষা করা চলে না। তাই বলা চলে, শাক্ত সঙ্গীতের ভাষা চলমান জীবনের বেগবতী ভাষা—কোনক্রমেই এটি স্তর অনড় জীবনের ভাষা নয়।


(২) ছন্দ: কোনো কবিতার কাব্যমূল্য বিচারে ছন্দের ভূমিকাও বিচার্য আগমনী-বিজয়ার গান মূলত সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের কথায়- “বাংলাদেশে সঙ্গীতের প্রকৃতিগত বিশেষত্ব হচ্ছে গান, অর্থাৎ বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ।” আলোচ্য ক্ষেত্রে আমরা এর সার্থক রূপ দেখতে পাই। সাধারণভাবে এগুলি এক নাম 'মালসীগান' (মালবী) নামেই পরিচিত ছিল। এগুলি সুরসহযোগেই গেয়। তাই আধুনিক রীতির পাঠে মাত্রার হেরফের হওয়া সম্ভব— কিন্তু সুর সংযোগে গীত হ'লে আর মাত্রার ত্রুটি লক্ষিত হয় না।


সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে পয়ার জাতীয় অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত ছন্দই ছিল প্রায় একমেবোন্বিতীয়ম্। আগমনী বিজয়াতেও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে, একালের বিচারে তা সর্বত্র নির্দোষ নয়।

'কবে যাবে বল গিরি/ রাজ গৌরীরে আনিতে। ব্যাকুল হয়েছে প্রাণ/উমারে দেখিতে হে।। গৌরী দিয়ে দিগম্বরে / আনন্দে রয়েছো ঘরে। কি আছে তব অস্তরে/ না পারি বুঝিতে।।'


অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত, পূর্ণ পর্ব অষ্টমাত্রক কিন্তু কবিতাতেই আছে ব্যতিক্রম -

‘নারীর জনম কেবল/যন্ত্রণা সহিতে।'

এখানে প্রথম পর্বে মাত্ৰাবৃদ্ধি ঘটেছে।


আগমনী-বিজয়ার কোনো কোনো পদে একালের মাত্রাবৃত্তের লক্ষণও ধরা পড়ে। সংযুক্তাদা বর্ণের তথা পদমধ্যস্থ রুদ্ধদলের দ্বিমাত্রকতা বিষয়ে শাক্ত পদকর্তার সচেতনতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।


শাক্ত পদাবলীতে ছড়ার ছন্দ তথা স্বরবৃত্তের ছন্দের অকুন্ঠ ব্যবহার মধ্যযুগের পক্ষে এক বিস্ময়কর ঘটনা। এই ছন্দের এমন সার্থক ও সচ্ছন্দ ব্যবহার ইতঃপূর্বে আর লক্ষ্য করা যায় না।


(৩) অলঙ্কার: শাক্ত পদাবলীর ‘শ্যামাসঙ্গীত' অংশে অলঙ্কারের বহুল ব্যবহার লক্ষিত হলেও উমাসঙ্গীত অনলঙ্কৃত। স্বাভাবিকভাবে আগত কিছু কিছু অলঙ্কার অবশ্যই এর কাব্যমূল্য বৃদ্ধি করেছে।