মহাভারতে অনুবাদে কাশীরাম দাস

মহাভারতে অনুবাদে কাশীরাম দাস


মহাভারতের চিরায়ত আখ্যান যাঁর লেখনীতে ঘটনা-বিরল বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনের অপরাহ্লে সুরেলা আবৃত্তির মধ্যে বিশেষ এক অর্থময়তা পেয়েছে, তিনি এই মহাকাব্যধারার শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কাশীরাম দাস। সপ্তদশ শতকে কবির আবির্ভাব। কিন্তু কবির জন্মস্থান, রচনাকাল, এমন কি তাঁর কাব্যের সম্পূর্ণ অনুবাদের ইতিহাস রহস্যাচ্ছন্ন। ১৮৩৬ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ‘কাশীদাসী মহাভারত' মুদ্রিত হয়। তবে এর ভাষার সঙ্গে ঊনিশ শতকের বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে।

কাশীরাম দাসের পৈতৃক উপাধি ‘দেব’। তিনি আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছেন

“ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।

দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী ৷৷ 

কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গিগ্রাম।

প্রিয়ঙ্কর দাসপুত্র সুধাকর নাম ॥”


অর্থাৎ বর্ধমানের ইন্দ্রানী পরগনার সিঙ্গিগ্রামে (মতান্তরে সিদ্ধি গ্রামে) কায়স্থ কুলে কাশীরামের জন্ম হয়। পিতার নাম কমলাকান্ত, কবিরা তিন ভাই, যথাক্রমে কৃষ্ণদাস, কাশীরাম, গদাধর। ঠাকুরদা—সুধাকরের পিতা প্রিয়ঙ্কর ইত্যাদি। কবি-বংশ ছিল বৈষ্ণবভাবাপন্ন, তাই বৈষ্ণবোচিত বিনয়ে ‘দেব’ না লিখে ‘দাস’ লিখেছিলেন। কাশীরাম তার গুরু অভিরাম মুখুটির আশীর্বাদে মহাভারত অনুবাদ করেন। শোনা যায়, মেদিনীপুর জেলায় আওসগড়ের (মতান্তরে আলিগড়) জমিদার বাড়িতে শিক্ষকতা করার সময় বহু কথক ও পণ্ডিতের মুখে মহাভারত-আখ্যান শুনে তাঁর অনুবাদকর্মের বাসনা জাগে।


প্রাপ্ত পুঁথি-অনুযায়ী কাশীরামের কাব্যের রচনাকাল যথাক্রমে : ১৫৯৫ খ্রীস্টাব্দ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথি), ১৬০৪ ও ১৬০২ খ্রীস্টাব্দ (যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি নির্দেশিত), ১৬১৩ খ্রীস্টাব্দ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথি)। এর মাধ্যমে অনুমান, কবি সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ভারত পাঞ্চালী' রচনা শুরু করেন।


এই শুরুর ইতিহাস যেমন অজ্ঞাত, তেমনি শেষের পরিচয়ও অজানা। কারণ কোন কোন পুঁথিতে পাওয়া গেছে এই সব শ্লোক

“আদি সভা বন বিরাটের কত দূর। 

ইহা লিখি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর ॥”


অথবা মুদ্রিত কাশীদাসী মহাভারতের বনপর্বে পাওয়া যায়

“ধন্য হল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস। 

তিন পর্ব ভারত সে করিল প্রকাশ।।”


প্রাপ্ত তথ্যের সূত্রে মনে হয়, কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম, পুত্র ঘনশ্যাম ও জামাতা জিৎ নামক জনৈক কবি নানা প্রসঙ্গ যোগ করে কাশীরামের এই অষ্টাদশ পর্বের মহাভারত সম্পূর্ণ করেন।


কাশীরামের সংস্কৃতজ্ঞান সম্পর্কে এক সময় পণ্ডিতদের মনে মেঘ ঘনিয়ে উঠেছিল। কিন্তু রচনারীতির প্রসন্ন আলোকপাতে সে মেঘ কেটে গিয়েছিল অচিরেই ; যেমন ভীষ্মপর্বে ঘোর সংগ্রামের বর্ণনা

“...দেখি মহাকোপে ভীষ্ম অন্য ধনু লয়।

গগন ছাইয়া বীর বাণ বরিষয় ৷৷ 

নাহি দেখি দিবাকরে রজনী প্রকাশ। 

শূন্যপথ রুদ্ধ হৈল না চলে বাতাস ॥”


আবার পিতামহের অস্তগমনের সংবাদ উপমার সুপ্রয়োগে পাঠককে বিস্মিত করে

“শিয়র করিয়া পূর্ব্বে পড়িল সে ধীর। 

আকাশ হইতে যেন খসিল মিহির ৷”


এখানে বিরুদ্ধ পক্ষের জয়ের উল্লাস ছাপিয়ে কৌরব শিবিরে সূর্যাস্তের বিষণ্ণ কালো ছায়া কিভাবে নেমে আসছে, সেই ভাবটি যেন ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে। এছাড়াও দেখা যায়, লক্ষ্যভেদী অর্জুনের বীরোচিত রূপের আলঙ্কারিক বর্ণনা

“মহাবীর্য যেন সূৰ্য্য জলদে আবৃত। 

অগ্নিঅংশু যেন পাংশু জালে আচ্ছাদিত ৷৷

মনে হয় এই জনে বিন্ধিবেক লক্ষ্য।”

এইভাবে অনুবাদ-কর্মে মহাভারতীয় রস ও ধ্বনিঝঙ্কার কাশীদাস যথাসাধ্য রক্ষা করেছিলেন। তাঁর রচনা অনেকাংশে মূলানুগ ও সংস্কৃত-নির্ভর, কিন্তু তা কোথাও দুর্বোধ্য ও নীরস হয়ে ওঠে নি। তাঁর বর্ণনার গতি তরল জলস্রোতের মতো অবাধ সরল, নিয়মিত ধ্বনিপর্বে ছন্দোময়

“পৰ্ব্বত নাড়িতে কোথা বায়ুর শকতি। 

না পারিল চলিবারে ভীম মহামতি ॥”


বলা বাহুল্য, একাব্য সহজবোধ্য বলেই সর্বজনধন্য। আবার সেই সঙ্গে ধ্রুপদী কাব্যের ওজঃ কান্তি বজায় রেখে তৎসম শব্দ ও অলঙ্কারের জড়োয়া কারুকার্যও দেখা যায় এইসব পংক্তিতে : “অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল শোভা”, “শ্রীবৎস কৌস্তুভমণি শোভিত হৃদয়”, “ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস” ইত্যাদি।


কাশীদাসী মহাভারতের প্রথম চার পর্বে আছে মূল কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ, কোন কোন স্থলে মূল-বহির্ভূত আখ্যান স্থান পেয়েছে। যেমন ‘শ্রীবৎস-চিন্তা’র কাহিনী। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন এর সঙ্গে ‘তিলক বসন্ত’ পালার সাদৃশ্য সন্ধান করেছেন। পূর্ববর্তী মহাকাব্য জৈমিনী মহাভারত থেকেও কোন কোন ঘটনাংশ গ্রহণ করা হয়েছে। আবার অষ্টাদশ পর্বের মহাভারতের মধ্যে কাশীরামের অনুগামী কবিরাও অনেক অংশ যোগ করেছেন। কাহিনী বর্ণনায় কিছু কিছু স্বাধীনতা গ্রহণ করলেও তত্ত্ব ও নীতিকথার অনুবাদে আক্ষরিক অনুবাদের রীতি গৃহীত হয়েছে। মহাভারতের পৌরাণিক পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে কাশীরাম দাস সফল হয়েছেন। তবে মহাভারতের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দার্শনিক তত্ত্ব সর্বজনবোধ্য হবে না বলেই সম্ভবত সুকৌশলে তা অনুক্ত রেখেছেন।


পারিবারিক আদর্শের রূপায়ণে কৃত্তিবাসের সঙ্গে কাশীরামের যেমন ঐক্য আছে, তেমনি পার্থক্যও কম নয়। কৃত্তিবাসের কাব্য যেখানে করুণরসের সাগর পেরিয়ে বাঙালীর সমাজ-সংসারের সঙ্গে দেবসমাজের সেতুবন্ধ রচনা করে, সেখানে কাশীরাম দাসের কাব্য‌ যেন মহাভারতের অমৃতবাণী বহন করে বাঙালীর চিত্তের নীতি-আদর্শ-বিশ্বাসের রাজপথ ধরে অমৃতলোকে যাত্রা করে। কৃত্তিবাসে রাম-নাম হয়ে উঠেছে ভক্ত পাঠক তো বটেই, এমন কি শত্রুপক্ষ রাবণের কাছেও সঞ্জীবন মন্ত্র। তুলনায় কাশীরাম দাস হরিনামের‌ গুণগানে ভক্তিভাবের প্রকাশে শৈল্পিক মাত্রা রক্ষা করে পাঠককে উপদেশ দিয়েছেন “হরিনাম লইতে ভাই না করিও হেলা।”


গঙ্গার পবিত্র বারিধারার মতো মহাভারতের রসধারা বাঙালী জীবন সংসারে কাশীরাম দাসের কাব্যের সরণি ধরেই প্রবেশ করেছে। তাই মাইকেল মধুসূদন “কাশীরাম দাস” কবিতায় লিখেছিলেন

“সেইরূপে ভাষাপথ খননি স্ববলে, 

ভারতরসের স্রোত আনিয়াছ তুমি

জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে। 

নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।”


কাশীরাম দাস মহাভারতের রচনাকাল নির্ণয়:

(১) কাশীরাম দাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধরের 'জগন্নাথমঙ্গল' কাব্যে কাশীদাসের মহাভারত রচনার উল্লেখ আছে

“...দ্বিতীয় শ্রীকাশীদাস ভক্ত ভগবান।

রচিল পাঁচালী ছন্দে ভারত-পুরাণ॥”


কাব্যটি ১৬৪২ খ্রীস্টাব্দে রচিত। সুতরাং কাশীদাসের মহাভারত নিশ্চয়ই তার আগে লেখা হয়। ১২৩৬ বঙ্গাব্দে লেখা কাশীদাসের একটি বিরাটপর্বের পুঁথিতে পাওয়া যায় এই শ্লোকটি

“চন্দ্র বান পক্ষ ঋতু শক সুনিশ্চয়।

বিরাট হইল সাঙ্গ কাশীদাস কয়॥”

এর থেকে দক্ষিণাগতিতে ১৫২৬ শকাব্দ বা ১৬০৪-০৫ খ্রীস্টাব্দে পাওয়া যায়।


(২) তাঁর আদিপর্বের আর একটি পুঁথিতে পাওয়া যায় এই হেঁয়ালী শ্লোক

“শকাব্দ বিধুমুখ রহিলা তিনগুণে। 

রুক্মিণীনন্দন অঙ্কে জলনিধি সনে॥”


আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এর ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে, “পঞ্চাননের পাঁচ মুখেই বিধু। অতএব বিধুমুখ = ৫। ইহার তিনগুণ = ১৫। রুক্মিণীনন্দন কাম, কামের পঞ্চশর। ‘অঙ্ক’ শব্দ দ্ব্যর্থ; ১৫, এই অঙ্কের ৫ অঙ্ক; এবং অঙ্ক কোলে, দুই বাহুতে। অর্থাৎ ৫ এর পর ২। জলনিধি, সাগর = ৪। সমুদয় অঙ্ক ১৫২৪ শক।”


কিন্তু অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় ‘রূক্মিণীনন্দন অঙ্কে’ পদের ব্যাখ্যাকে ‘কষ্টকল্পনাপ্রসূত’ বলেছেন। তাঁর যুক্তি (ক) মদনের পাঁচ শর বলে ‘রুক্মিণীনন্দন’ বা মদন = ৫ বোঝাবে কেন? ‘মদন’ শব্দ ১৩ অর্থে ব্যবহৃত হয়। (খ) ‘সাগর’ (বা তার সমার্থবাচক শব্দগুলি) সংস্কৃত সাহিত্যেই কেবল ৪ অর্থে ব্যবহৃত। বাংলায় তা ৭ অর্থে ব্যবহৃত (অর্থাৎ ‘সাতে সমুদ্র' ইত্যাদি) হয়। সেদিক দিয়ে তার সিদ্ধান্ত, বিধুমুখ তিনগুণ = ১৫, রুক্মিণীনন্দন অঙ্কে জলনিধি সনে ১৩+৭=২০। অতএব এই আদিপর্বের রচনাসমাপ্তি কাল ১৫২০ শকাব্দ বা ১৫৯৮-৯৯ খ্রীস্টাব্দ হওয়াই সম্ভব।


(৩) শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার কয়াল ১৭২১ শকাব্দের একটি খণ্ডিত বনপর্বের পুঁথিতে (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, বর্ষ ৬৬, সংখ্যা ৫, পৃ. ৯৪-৯৭-এ উদ্ধৃত) ‘জিত’ নামক জনৈক কবির কিছু ছত্র উদ্ধৃত করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, এই ‘জিত’ কাশীরামদাসের অসম্পূর্ণ বনপর্বের অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ অগস্ত্য উপাখ্যানের পরবর্তী অংশ লিখে সম্পূর্ণ করেন ১৬০৫ শকাব্দ বা ১৬৮৩-৮৪ খ্রীস্টাব্দে। এই কবি তাঁর উপাখ্যানের শেষে উদ্ধৃত করেছেন

“পঞ্চপুষ্প রস শশি পরিমাণ বাক। 

পাঁচালি প্রবন্ধেতে শেষ আরণ্যক ॥”


অক্ষয়কুমার লিখেছেন, “লিপিকর কি করিয়া ‘পুষ্প’কে শূন্য বলিয়া ধরিলেন জানি না।” কিন্তু খুব সম্ভবত লিপিকর নয়, স্বয়ং কবি ‘পুষ্প’ শব্দের ‘শূন্য’ অর্থ করে ‘১৬০৫’ লিখেছেন। কুবেরের আকাশ-রথের নাম ‘পুষ্পরথ’; এই জন্য কবি ‘পুষ্প’=আকাশ=০ ধরেছেন বলে ভাবা যেতে পারে। এদিক দিয়ে ১৬০৫-ই দাঁড়ায়। সুতরাং মোটের উপর কাশীরাম দাসের মহাভারত ১৬৪২ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে, বা ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে রচিত হয়েছিল বলে ভাবা যেতে পারে।


কাশীরামদাসের রচনা ও মৌলিকতা

কাশীরাম দাসের নামে প্রচলিত অষ্টাদশ পর্বের বিপুলায়তন মহাভারত কাহিনী সবটা তাঁর রচনা নয়, গবেষক-মহলে এবং সুধীসমাজে এ সত্য অনেকদিন ধরেই স্বীকৃত। পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র এবং জামাতা বা অন্যান্য অনুবাদকেরা তাকে সম্পূর্ণতা দান করেন। কিন্তু বিচার্য, কতটা তিনি লিখেছিলেন?


তথ্যগত সাক্ষ্যে দেখা যায় কোন কোন পুঁথিতে আছে

“ধন্য ধন্য কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস।

চারি পর্ব্ব ভারতের করিলা প্রকাশ৷” 

“আদি সভা বন বিরাট রচিয়া পাঁচালী। 

যাহা শুনি সৰ্ব্বলোক ধন্য ধন্য বলি৷”


আবার অন্য একটি পুঁথিতে আছে পাঠান্তর এবং তিন পর্ব রচনার তথ্য

“ধন্য ছিল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস।

তিন পর্ব্ব ভারতের করিল প্রকাশ ॥”


কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর সম্পাদিত গদ্যানুবাদের উপসংহারে উদ্ধৃত করেছিলেন

“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর। 

ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর॥ ”


বস্তুত এর ফলে বিষয়টি হয়ে উঠেছিল খুবই জটিল। (১) সম্প্রতি শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার কয়াল এ সম্বন্ধে গবেষণা ক'রে নতুন তথ্যের হদিস দিয়েছেন 'সাহিত্য পরিষৎ' পত্রিকায়। তাঁর গবেষণা থেকে বোঝা যায় যে কাশীরাম দাস আদি, সভা ও বিরাট এই তিনটি পর্বের রচনা সম্পূর্ণ করেন; বনপর্ব বিরাটপর্বের পূর্ববর্তী হলেও কাশীরাম বিরাটপর্ব রচনা শেষ করার পরে বনপর্ব শুরু করেন এবং এই পর্ব অসম্পূর্ণ রেখে মারা যান। পরবর্তী পর্বকে পূর্বে লেখা আপাতদৃষ্টিতে একটু আশ্চর্য মনে হয়। তবু আমরা দেখতে পাই মহাভারত রচয়িতা অনিরুদ্ধ উদ্যোগপর্ব ও ভীষ্মপর্বের পর বনপর্ব লিখেছিলেন। সনাতন ঘোষাল বিদ্যাবাগীশ ভাগবত অনুবাদে তৃতীয় স্কন্দ অনুবাদ করার পর দ্বিতীয় স্কন্দ অনুবাদ করেছিলেন। আবার অক্ষয়বাবু ১৭২১ শকাব্দের একটি খণ্ডিত বনপর্বের পুঁথিতে এই শ্লোকটি পেয়েছেন যা কালীপ্রসন্ন নির্দেশিত শ্লোকের অনেকটা অনুরূপ, যদিও ভিন্নতা আছে—

“আদি সভা বিরাট বনের কতদূর।

ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর॥”


বনপর্বের কতটা কাশীরাম লিখে যেতে পেরেছিলেন তা-ও অক্ষয়কুমার জানিয়েছেন। তার সংগৃহীত বনপর্বে একটি পুঁথিতে “জিত” নামে একজন কবি জানিয়েছেন

“আগস্ত উপাক্ষণ (অগস্ত্য উপাখ্যান) করি হৈল কালপ্রাপ্ত।

বনের বিচিত্র কথা নহিল সমাপ্ত॥”


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭২৪ নং পুঁথিতেও পাঠান্তর সত্ত্বেও এই ছত্র দুটির সমর্থন সূচক প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষক অক্ষয়কুমার এবং পঞ্চানন মণ্ডল দুজনেই দেখিয়েছেন যে বনপর্বের পুঁথিতে অগস্ত্য উপাখ্যানের পর আর কাশীরাম দাসের ভণিতা পাওয়া যায় না। অন্য কবির ভণিতা দেখা যায়। যেমন কবি জিত ঘটক অগস্ত্য উপাখ্যানের পরবর্তী অংশ লিখে বনপর্ব সম্পূর্ণ করেছিলেন ১৬০৫ শকাব্দ বা ১৬৮৩ ৮৪ খ্রীস্টাব্দে। ‘মুষলপর্বও লিখেছিলেন তিনি (‘কাশীর নন্দন’ ভণিতাও মাঝে মাঝে পাওয়া যায়), শিবরাম ঘোষ লিখেছিলেন উদ্যোগ প্রভৃতি ছ'টি পর্ব, ‘কাশীর নন্দন’ ভণিতায় গদাপর্ব ও স্বর্গারোহণপর্ব এবং “আশ্চর্যপর্ব” নামে মহাভারত-বহির্ভূত এক পৌরাণিক রচনার পুঁথিও পাওয়া যায়।


কাশীরাম দাসের মহাভারতের সংযোজক অংশ রচনার ক্ষেত্রে অন্তত দুজনের নাম বিশেষভাবে চোখে পড়ে। একজন নন্দরাম দাস, যিনি কাশীদাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধরের পুত্র ব’লে কথিত, যিনি লিখেছিলেন

‘তার (অর্থাৎ কাশীরামের) আজ্ঞা নিয়ে ধরি ভাবি রাধাশ্যাম।

দ্রোণপর্ব্ব ভারত রচিল নন্দরাম।।”


কিন্তু নন্দরাম “ভ্রাতুষ্পুত্র হই আমি তিঁহো খুল্লতাত” ব’লে পরিচয় দিলেও ভণিতাতে জানিয়েছেন তাঁর পিতার নাম ছিল নারায়ণ—

“নারায়ণ নন্দন সেবিয়া রাধাশ্যাম।

পণ্ডিতবিজয় বিরচিল নন্দরাম।।”


বিপরীতভাবে, “জয়ন্ত রচিল কাশীদাসের নন্দন” বলে কবি জয়স্তিদেব বা জয়ন্তদেব পরিচয় দিয়ে স্বর্গারোহণপর্ব লিখলেও ‘দ্বৈপায়ন দাস’ ভণিতায় লেখা উক্ত পর্বের সঙ্গে কোনও মিল নেই। এমন কি কাশীরাম দাসের আদৌ কোনও পুত্র ছিল কিনা সে সম্বন্ধেও সংশয় আছে।