'হরগৌরীর কলহারম্ভ ও গৌরীর খেদ’, ‘গুজরাট নগরনির্মাণ' এবং 'ভাড়ুদত্তের মস্তকমুণ্ডন'—অংশগুলির যে কোনো দুইটি অংশের রচনানৈপুণ্য আলোচনা করো।

হরগৌরীর কলহ ও গৌরীর খেদ


গৌরীকে বিবাহ ক'রে শিব ঘর জামাই হ'য়ে হিমালয় গৃহে বাস করতেন। তারপর একদিন মা মেনকার সঙ্গে কোন্দল ক'রে গৌরী স্বামীপুত্র নিয়ে কৈলাসে চলে আসেন। এখানে জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায় না থাকায় মহাদেব হ'লেন ভিক্ষাজীবী। একদিন ভিক্ষা করে এসে পরদিন আর ভিক্ষায় যেতে চায় না মহাদেব, বরং এক বিরাট খাদ্য তালিকা ধরিয়ে দেন দেবীর হাতে– ইচ্ছা, খুব আয়েস ক'রে খেয়ে সে দিনটা তিনি বিশ্রাম করবেন। কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হবার নয়। কারণ আগের দিনের ভিক্ষার চাউল কিছুটা ধার শোধ করতে ব্যয় হয়েছে, অবশিষ্ট যা' ছিল, সেটা ও দিনই রান্না হয়ে গেছে। অতত্রব গৌরী বলেন—

‘রন্ধন করিতে ভাল বলিলে গোঁসাই।

প্রথমে যে দিব পাতে তাই ঘরে নাই।'


অন্নপূর্ণার ভাড়ে মা ভবানী। তবে উপায়? উপায় একটি আছে, সেটাই বললেন দেবী—

'আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল। 

তবেও আনিতে পারি প্রভু হে তণ্ডুল।।'


মহাদেবের ত্রিশূল বাঁধা রেখে চাউল ধার করা? এতে ভীষণ অপমানিত এবং ক্রুদ্ধ হ'য়ে মহাদেব গৃহত্যাগের সঙ্কল্প ঘোষণা করেন। এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে কলহ আরম্ভ হ'ল। মহাদেব বলেন

‘আমি ছাড়ি ঘর    যাব দেশাত্তর।

কি মোর ঘর-করণে।'


কার্ত্তিক-গণেশকে নিয়ে গৌরী স্বতন্ত্রভাবে সুখে ঘর-সংসার করুন—শিবের গৃহসুখে কাজ নেই, তিনি দেশাত্তরে চলে যাবেন। তিনি বলেন যে এত তিনি ঘরে নিয়ে আসেন কিন্তু কখনো কিছু বাড়তি থাকে না। গণেশের ইঁদুর রয়েছে ঘরে, সে অনবরত খুট খুট ক'রে খাচ্ছে, তাড়িয়ে দিলেও ফিরে ফিরে আসছে। ওদিকে গৃহিণীর বাহন রয়েছে বাঘ— তার চাউনি দেখলেই মহাদেবের বাহন দুর্বল বলদের শরীর টলমল ক'রে কাঁপে, সে আর দানা পানি মুখে তোলে না। মহাদেবের অঙ্গের ভূষণ সাপগুলি পর্যন্ত সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে—কারণ কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর সুযোগ পেলেই ধরে ধরে সাপ খায়। এই সমস্ত দেখে শুনে নানা ভাবনাচিন্তা ক'রে মহাদেবের আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা হয় না। সারাদিন নানা দেশে ঘুরে ফিরে কত ভিক্ষা করে তিনি ঘরে আসেন, কিন্তু তার অন্ন জোটে না। তাই তাঁর মনে হয়

‘গৃহিণী দুৰ্জন    ঘর হৈলা বন

বাস করি তরু তলে।'


এই কারণেই মহাদেব নন্দীকে ডেকে বললেন যে তিনি আর ঘরে থাকবেন না, নন্দী যেন তার বাঘছাল, শিঙ্গা, হাড়ের মালা, ডম্বরু আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এখনি তার সঙ্গী হয়। এই বলে মহাদেব বলদের পিঠে চড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।


সমস্ত ব্যাপার দেখে শুনে পার্বতী তো একেবারে থ'। তাঁর কোনো অপরাধ নেই, তা সত্ত্বেও মহাদেব এমনভাবে রাগ করে গৃহত্যাগ করায় তিনি অতিশয় ক্ষুব্ধ হ'য়ে খেদ প্রকাশ করতে লাগলেন। তিনি আপন দুর্ভাগ্যের কথা বলতে গিয়ে বললেন

'কি জানি তপের ফলে বর মিলেছে হর। 

পাট পড়শী নাহি আসে দেখি দিগম্বর।।'


গৃহে যে পার্বতীও খুব সুখে আছেন, তা নয়। মহাদেবের সাপ আর পুত্র কার্ত্তিকের ময়ূরে তো সারাক্ষণই লড়াই চলছে, ওদিকে গণেশের ইঁদুর মহাদেবের ঝোলা কেটে দেয় বলে গালি খান দেবী। বাঘে আর মহিষেও সারাক্ষণ ঝগড়ায় মত্ত থাকে এও দেবী নিজের দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন। ময়ূর আর ইঁদুরের ঝগড়ার জন্যও পার্বতীকেই গালমন্দ শুনতে হয়। এই সমস্ত কারণে বড় দুঃখেই দেবী বলেন—

'দারুণ দৈবের ফলে হইনু দুঃখিনী।

ভিক্ষার ভাতে দারুণ বিধি করিল গৃহিণী।।'


ভিক্ষার ভাতে জীবনযাপনের মধ্যে যে গ্লানি রয়েছে, তার জন্যই দেবী লজ্জাবোধ করেন। শুধু সংসারের অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যই যে গৌরীর মনঃকষ্টের কারণ, তা নয়—শিবের আচার-আচরণও পার্বতীর জীবনে বহু অশাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাগলা ভোলা উলঙ্গ হয়ে থাকেন, গায়ে মাখেন চিতাধূলি, দাঁড়ালে তার জটা ভূমি স্পর্শ করে– মহাদেবের নিত্য ভূষণ সাপ—মহাদেবের গায়ের গন্ধ আর সাপের নিশ্বাস—সব মিলিয়ে গৌরীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় এবং এসবের চেয়েও অসহ্য মনে হয় মহাদেবের পরিধেয় বাঘের চামড়ার গন্ধ। তাই বড় দুঃখেই গৌরী বলেন—

'তার অধিক প্রাণ পোড়ে বাঘছালের বাসে।'


সংসারে নিত্য অভাব এবং এর ফলে কোন্দল বাড়ে, এটা এড়ানোর জন্য দেবী পরের দরজায় ধার মাগেন চারদিকে সর্বত্র ধার, এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে ধার পাবারও আর জায়গা নেই। এই হ’ল মহাদেবের সংসারের প্রকৃত অবস্থা, এখন এই কথা বলতে গিয়েই দেবী সকলের শত্রু হ'য়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন—

‘উচিত কহিতে আমি সবাকার অরি। 

দুঃখ যৌতুক দিয়া বাপে বিভা দিল গৌরী।।'


দেবীর এই উক্তিতে গাঢ় জমাট বাঁধা দুঃখেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আরও কত দুঃখ তার— মহাদেবের বুকে শোভে সাপ, কপালে রয়েছে তৃতীয় নয়নের আগুন আর জটায় জাহ্নবীর জলধারা—সবই অদ্ভুত। এ সব মানিয়ে নিয়ে তবেই গৌরীকে ঘর-সংসার করতে হয়। নারী জন্মের কোনো সাধই তার মিটলো না, তাই তিনি বলেন—

'মিথ্যা নারী করি মোরে সৃজিলা বিধাতা।'


হর-গৌরীর সংসার জীবনের এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেবী দেখালেন যে এখানে তার কোন ভুল-ত্রুটি নেই, অথচ পাপের ফল সবটাই ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। তাই তার জিজ্ঞাসা -

‘দোযঘাটি নাহি কিছু পাপ-পরমাদ।

কি কারণে পদ্মা এত পাই অবসাদ।।'


কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও যখন শিব তাকে এমন নিন্দাময় কটুকাটা করেন, তখন গৃহবাসে তিনি আর থাকতে চান না বলে তিনি বলেন

'একা বসি থাক শিব আমি যাব ঘর।'


স্বামী স্ত্রীর এই ঝগড়ার অবশ্য সমাধান করে দেবীর সখী পদ্মাবতী। সে-ই দেবীকে বোঝালেন যে এইভাবে নিজের ঘর ছেড়ে গিয়ে কোথাও আশ্রয় পাওয়া যাবে না। বরং এখন দেবীর চেষ্টা করা উচিত, যাতে মর্ত্যলোকে তার পূজা করা যায় এবং মহাদেবের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত মর্ত্যালোকে দেবীর পূজা প্রচারিত হ'ল।


হরগৌরীর সংসার যাত্রা এবং পরস্পরের প্রতি দোষারোপের ফলে তৎকালীন সমাজজীবনে একটি অভাবগ্রস্ত এবং সংসার-উদাসীন গৃহস্বামীর পরিচালনায় মধ্যবিত্ত সংসারে কীভাবে অশাস্তির সৃষ্টি হয়, তার বাস্তব আলেখ্য এখানে পাওয়া গেল।