শাক্ত পদাবলী ও বৈষ্ণব পদাবলীর পারস্পরিক সাদৃশ্য ও বৈসদৃশ্য আলোচনা করো।

শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলী : পারস্পরিক প্রভাব ও পার্থক্য


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি শাক্তপদাবলী। চৈতন্যদেবের মহান্ প্রভাব অস্তমিত প্রায়, মঙ্গলকাব্যের দেবীগণের মাহাত্ম্যও নিঃশেষিত প্রায় সমগ্র গৌড়বঙ্গের রাজনৈতিক আকাশ ঘনমেঘে সমাচ্ছন্ন, এমন সময় একটা নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুকতারার মতো আত্মপ্রকাশ করলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। তিনি যে শ্যামাসঙ্গীত রচনা দ্বারা সেই ক্রান্তিকালের উদ্বোধন করলেন, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক থেকে তা ছিল অভিনব। রামপ্রসাদের সৃষ্টি এই নতুন ধারাটি শতাব্দীকাল পরিবাহিত হ'য়ে আধুনিক যুগেও এসে পৌঁচেছে। মধ্যযুগের অপর কোনো শাখাই এই সৌভাগ্য লাভ করতে পারেনি।


শাক্ত পদাবলীর উদ্ভবের পিছনে তান্ত্রিক ধর্মমত অতিশয় সক্রিয় থাকলেও সাধক কবি রামপ্রসাদ একে এমন একটি লোকায়ত রূপ দান করেছেন, যাতে একে কোনো ধর্মীয় সঙ্গীত, বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। বরং এর সাধম খুঁজে পাওয়া যাবে ধর্মীয় বোধে সৃষ্ট অথচ অতিশয় জনপ্রিয় ধারা বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে। ভক্ত বৈষ্ণব যেমন বৈষ্ণবপদ গানের মধ্য দিয়েই তার আরাধ্যের উপাসনা করেন, অথচ সাধারণ পাঠকও তার মধ্যে আপন প্রাণের আবেদন অনুভব করেন, শাক্তপদগুলিও তেমনি শাক্ত সাধকের উপাসনার অঙ্গ-রূপে রচিত হ'লেও যে কোনো বাঙালী পাঠকই পদগুলি সম্বন্ধে সমানই আগ্রহ বোধ করেন।


চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বেই বৈষ্ণব পদাবলীর সৃষ্টি হ'লেও তার প্রভাবেই পরবর্তী কালে বৈষ্ণব পদাবলীর জোয়ার দেখা দের পরিমাণগত এবং গুণগতহিসেবে সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদগুলির স্থান একক ও অনন্য। চৈতন্য তিরোভাবের পরও শতাব্দীর অধিক কাল বৈষ্ণব কবিতার ছিল সমৃদ্ধির যুগ, তারপর সহজ সাধনার বিষয়ীভূত হলে বৈষ্ণব পদে অবক্ষয়ের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। বৈষ্ণব পদের ধারা যখন অস্তর্হিত প্রায়, তখনই আবির্ভাব ঘটে শাক্ত পদের। এই শাক্ত পদের উদ্ভবের পশ্চাতে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।


সুধী সমালোচক অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন : “বৈষ্ণর সাধনার অন্তরঙ্গ সুর ও বিগলিত ভাবাবেশ মাধুর্য শাক্ত কাব্যেও সংক্রামিত হইল——দেবীর স্তব-স্তুতির মধ্যে ভক্তের আত্মসমর্পণ ও একান্ত নির্ভয়ের ভাবটি বৈষ্ণব কবিতার প্রভাবের ফলস্বরূপ ফুটিয়া উঠিল।” কোনো কোনো সমালোচক শাক্ত কবিতায় বৈষ্ণব প্রভাবের কথা অস্বীকার করলেও উভয়ের তুলনামূলক আলোচনায় এই প্রভাবের স্বরূপটি স্বতাই উদ্‌ঘাটিত হ'য়ে আসে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে, শাক্ত কবিতার সঙ্গে বৈষ্ণব কবিতার প্রভাবজাত সাদৃশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি শাক্ত পদাবলীর নিজস্বতাহেতু উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও প্রকট।


শাক্ত পদাবলী বৈষ্ণব পদাবলীর পরবর্তী কালে সৃষ্ট, অতএব বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব এতে পড়তেই পারে, কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীর ওপর শাক্ত পদাবলীর প্রভাব পড়েছে বললে কালাতিক্রমণ দোষই কেবল ঘটে না, ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই পারস্পরিক প্রভাবের বিষয় আলোচনা করতে গেলে বৈষ্ণব পদাবলীর ওপর শাক্ত পদাবলীর নয়, বরং শক্তি-সাধনার প্রভাবও কিছুটা বর্তমান, এ কথাই বলা চলে। এবং প্রস্তাবটি যে অবাস্তব নয়— বিভিন্ন দৃষ্টাস্তের সাহায্যে তা সহজেই প্রমাণ করা চলে।


শাক্ত-বৈষ্ণবের একটা রেষারেষি চলছে দীর্ঘকাল ধরেই, যদিও এটি চিরকালীন ব্যাপার নয়। রামপ্রসাদ এবং আলু গোঁসাই (অযোধ্যা গোস্বামী) সম্পর্কিত কহিনীতে এই রেষারেষির পরিচয় বর্তমান। আরও পূর্ববর্তী কালে অর্থাৎ মধ্যযুগে চৈতনা-জীবনীগ্রন্থগুলিতে চৈতন্যভক্তদের মধ্যে শাক্ত-সম্পর্কিত অসহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। 'নিশি-জাগরণে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা' কিংবা 'মদ্য মাংস'-সহ শক্তি-আরাধনাকে চৈতন্য জীবনীকার নিন্দা করেছেন। কিন্তু প্রাচীনকালে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে এরূপ কোন অসহিষ্ণুতার মনোভাব ছিল না বলেই মনে হয়। মহাভারতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গাস্তোত্র পাঠ করতে বলছেন, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণেও শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের কাত্যায়নী পূজা করতে বলছেন। আবার ভগবতীকেও শাস্ত্রে বলা হয়েছে 'পরমাবৈষ্ণবী' এবং তিনি 'নারায়ণী'। শ্যাম ও শ্যামার এই অভিন্নতা বিষয়ে অবশ্য কয়েকজন শাক্তপদকর্তাও অবহিত ছিলেন। রামপ্রসাদ গেয়েছেন

'যেমন করে রাসমণ্ডলে নেচেছিলি, 

হাদি বৃন্দাবন-মাঝে, ললিত ত্রিভঙ্গ-ঠামে,

চরণে চরণ দিয়ে গোপীর মন ভুলানো বেশে 

তেমনি তেমনি তেমনি করে।'


নবাই ময়রার গানে আছে—

‘হৃদয় রাস মন্দিরে দাঁড়াও মা ত্রিভঙ্গ হয়ে।

একবার হয়ে বাঁকা, দে মা দেখা,

শ্রীরাধারে বামে লয়ে।'


কমলাকান্ত গেয়েছেন

'জান না রে মন, পরম কারণ, কালী কেবল মেয়ে নয়।

মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ, কখন কখন পুরুষ হয়।।'


আরও অনেক শাক্ত পদকর্তার রচনাতেই সমন্বয়ের ভাবটি পরিস্ফুট হয়। বস্তুত বৈষ্ণব পদে। শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরূপেই তো শ্রীরাধার কল্পনা। বৈষ্ণব পদাবলী বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেই অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, “রাধাবাদের বীজ রহিয়াছে ভারতীয় সাধারণ শক্তিবাদে সেই সাধারণ শক্তিবাদই বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের সহিত বিভিন্নভাবে যুক্ত হইয়া বিভিন্ন যুগে এবং বিভিন্ন দেশে বিচিত্র পরিণতি লাভ করিয়াছে; সেই ক্রমপরিণতির একটি বিশেষ অভিব্যক্তিই রাধাবাদ।" গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের আকর গ্রন্থ শ্রীরূপ গোস্বামী রচিত 'উজ্জ্বলনীলমণি'-তেও শ্রীমতী রাধাকে 'মহাশভি' বলে অভিহিত করা হয়েছে হ্লাদিনী যা মহাশক্তিঃ সর্বশক্তিঃ সর্বশক্তি-বরীয়সী। অতএব বৈষ্ণব ভাবধারায়ও যে কোন না কোন প্রকারে শক্তিসাধনার প্রভাব বর্তমান ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না।


শাক্ত পদাবলীর দুটি প্রধান ধারা— একটি 'উমাসঙ্গীত আগমনী ও বিজয়ার গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়, –অপরটি 'শ্যামাসঙ্গীত'— জগজ্জননীর রূপ, ভক্তের আকৃতি প্রভৃতি বহু পর্যায়ে বিভক্ত গানগুলিতে এর পরিচয় পাওয়া যায়। 'শ্যামাসঙ্গীত'– শাক্তসাধনা সম্পর্কিত সঙ্গীত নিয়ে পর্যায়টি রচিত বলেই এতে বৈষ্ণব প্রভাবের প্রশ্নটি প্রায় অবাস্তর হাঁয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত আগমনী গানে যে বাৎসল্য রসের প্রবাহ বয়ে চলেছে, এটির উৎসমূলে বৈষ্ণব পদের প্রভাব থাকার সম্ভাব্যতা নিয়েই মূল প্রশ্নটি বিবেচিত হয়ে থাকে।


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পঞ্চরসের স্বীকৃতি রয়েছে শাস্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এদের মধ্যে বৈষ্ণবপদাবলীতে বাস্তবে শাস্ত্র ও দাস্যরস কার্যত প্রায় অব্যবহৃত, সখ্যরসের সামান্য ব্যবহার রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও গোষ্ঠলীলা পদে, বাৎসল্য রসের কিছু সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় এবং প্রায় সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী জুড়েই মধুর তথা শৃঙ্গার রসের প্রবাহ। পক্ষান্তরে শাক্ত পদাবলীর আগমনী ও বিজয়ার পদে আছে শুধুই বাৎসল্য রস এবং শ্যামাসঙ্গীতে যে ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তাকে বড় জোর 'ভক্তিরস' নামে অভিহিত করা চলে। কোনো কোনো সমালোচক অবশ্য এই ভক্তিরসকে প্রতি বাৎসলা রস' নামে অভিহিত ক'রে থাকেন। বৈষ্ণব রসশাস্ত্র প্রণেতা শ্রীরূপ গোস্বামী অবশ্য যাবতীয় রস অর্থাৎ পঞ্চরসকেই 'ভক্তিরস রূপে স্বীকার করেছেন। অতএব বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্ত পদাবলীর সাদৃশ্য বিচারে আমরা শুধু বাৎসলা রস’-বেই উভয়ের মধ্যে দেখতে পাই রসের দিক থেকে অপর কোনো পদই সদৃশ নয়। বৈষ্ণব পদে প্রতিবাৎসল্য নেই, পক্ষান্তরে শাক্ত পদে শাস্ত, দাস্য, সখ্য এবং মধুর (শৃঙ্গার) রসের অভাব। অতএব এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য-বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বাৎসল্য রসের পদগুলিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়।


বৈষ্ণব পদ মধুররসে ভরপুর। অনেকেই শাক্ত পদাবলীতেও যে মধুর রসের কথা উল্লেখ করে থাকেন, তা' কিন্তু বৈষ্ণব পদের মধুর রস থেকে পৃথক বৈষ্ণব পদের মধুর রস একান্তভাবেই কাত্তাপ্রেমাশ্রিত, কিন্তু শাক্ত পদাবলীতে কাস্তা প্রেম একেবারেই অনুপস্থিত। এখানে ঐশ্বর্যরসের বিপরীত রসকেই মধুর রস বলা হয়েছে বৈষ্ণব পদে ঐশ্বর্যরস অনুপস্থিত, পক্ষান্তরে শাক্ত পদে যুগপৎ ঐশ্বর্যরস ও মধুররসের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।


বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণ তথা শ্যামের এবং শাক্তগণ কালী তথা শ্যামার উপাসক। উভয় জাতীয় উপাসকগণই নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত থেকে ইষ্ট-আরাধনা করলেও কখনো কখনো কোনো কবির মনে সমন্বয়ের বোধ জাগরিত হয়। তাই একদিকে যেমন কৃষ্ণ কালী রূপ ধারণ করেন, অন্যদিকে তেমনি কোনো ভক্ত শ্যামাকেও শ্যামরূপে দর্শন করে থাকেন।

বাহ্য উপাসনার দিক থেকে বৈষ্ণব ও শাক্তদের মধ্যে অনেকাংশে সাদৃশ্য আছে— উভয় সম্প্রদায়ই ইষ্টনাম-কীর্তনে তৎপর। কিন্তু বৈষ্ণবপদকর্তাগণ লীলাশুকের মত দূর থেকে রাধাকৃষ্ণের লীলাদর্শনে পুলকিত হন, প্রত্যক্ষভাবে সেই লীলায় অংশগ্রহণ করেন না। কিন্তু শাক্ত ভক্ত তাঁর ইষ্টদেবতা শ্যামা মাকে একেবারে আপনভাবেই গ্রহণ করে থাকেন। মাতা এবং সস্তানে যে পার্থক্য, শাক্তপদে উপাস্যা ও উপাসকে ততখানিই পার্থক্য কিন্তু বৈষ্ণব পদে ভক্ত বা উপাসকের স্থান অবশ্যই অপেক্ষাকৃত দূরতর, তারা প্রত্যক্ষভাবে এই লীলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না।


বৈষ্ণব পদাবলীতে উপাস্য শ্রীকৃষ্ণ প্রায় সর্বত্র প্রিয়তম এবং কচিৎ সখা বা পুত্ররূপে গৃহীত হ’য়েছেন। শাক্ত পদাবলীর আগমনী-বিজয়া পর্যায়ে দেবী সর্বত্র কন্যারূপে এবং অন্যত্র সর্বত্রই জননীরূপে গৃহীত হয়েছেন। ফলে, উপাস্যের সঙ্গে উপাসকের যে ব্যক্তি সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা শাক্ত পদাবলীতে দৃষ্ট হয়, বৈষ্ণব পদে ততটা দেখা যায় না।


অধ্যাপক ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রীর ভাষায়- “বলরাম প্রমুখ মহাজনগণ বাৎসল্যরসের কয়েকটি উৎকৃষ্ট পদ রচনা করিলেও সে পদ যেন মর্তভূমির মানবের অন্তরে করুণরসের তেমন আবেদন জাগায় নাই, কেন না, গোপালের জন্য মাতা যশোদার উৎকন্ঠা একটি আতিশয্য বা বিলাপ বলিয়া মনে হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আগমনী ও বিজয়ার গানে মাতা মেনকার অন্তর্গুঢ় বেদনার যে ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে, উহা সহজেই আমাদের মনকে স্পর্শ করে। বৈষ্ণব পদাবলী অপ্রাকৃত জগতের বস্তু, বৃন্দাবন ধামেই নিত্যকাল চলিয়াছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিবিধ লীলা, কিন্তু শাক্ত পদাবলীতে, বিশেষত আগমনী ও বিজয়ার গানে আমাদের পারিবারিক জীবনের সুখদুঃখ-আনন্দ, বেদনারই ছবি ফুটিয়াছে।”


বৈষ্ণব পদাবলীতে ভক্ত কখনও মুক্তি বাঞ্ছা করেন না—

'মোক্ষবাঞ্ছা কৈতবপ্রধান।

যাঁহা হতে কৃষ্ণভক্তি হয় অন্তর্ধান।।'


ব্রহ্মে লীন হবার আকাঙ্ক্ষা বৈষ্ণবীয় ভক্তিধর্মের বিরোধী। কিন্তু শাক্ত ভক্তের লক্ষ্য ব্রহ্মে লীন হওয়া, তথা সাযুজ্য বা মুক্তি লাভ করা

'এমন দিন কি হবে মা তারা,

যবে তারা তারা তারা বলে তারা বেয়ে পড়বে ধারা।'


অবশ্য রামপ্রসাদ কখনো কখনো এর বিপরীত কথাও বলেছেন যে, তিনি চিনি হতে চান না, চিনি খেতেই ভালবাসেন।


বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদাবলীতে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ একটি সর্বজনীন আবেদন আছে, তেমনি আছে শাক্ত পদাবলীতেও। তবে শাক্তপদকর্তারা বৈষ্ণব কবিদের মত সচেতন শিল্পী ছিলেন না বলে শাক্ত পদগুলি বৈষ্ণব পদের তুল্য কাব্যগুণসম্পন্ন নয়। শাক্ত পদগুলির সঙ্গে তার একটি নিজস্ব সুর এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে সুর-বর্জিত শাক্ত পদের পাঠ তত উপাদেয় মনে হয় না। রামপ্রসাদ-আদি প্রধান শাক্তপদকর্তাদের রচনায় ভাবগভীরতা যথেষ্টই রয়েছে, প্রকাশভঙ্গীও স্বতঃস্ফূর্ত এবং বাহুল্যবর্জিত কিন্তু মণ্ডনশিল্পের ব্যাপারে তাঁরা তত অবহিত ছিলেন না। তবে বিভিন্ন প্রকার ছন্দ ব্যবহারে তারা অবশ্যই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন; বিশেষত লৌকিক ছন্দের তথা স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত ছন্দের ব্যবহারে তাদের কৃতিত্ব বিশেষভাবে স্মরণীয়। পক্ষান্তরে বৈষ্ণব পদাবলীতে বাংলায় শুধুই অক্ষরবৃত্ত এবং ব্রজবুলিতে শুধুই প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। লোচনদাসের ধামালিতে স্বরবৃত্তের ব্যবহার ব্যতিক্রম-রূপেই বিবেচ্য।