বাংলা সাহিত্যে পুরাণ-প্রসঙ্গ | শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পুরাণ-প্রসঙ্গ

বাংলা সাহিত্যে পুরাণ-প্রসঙ্গ


বাংলা সাহিত্যে পথচলার শুরু চর্যা-গীতিকাকে দিয়ে। কিন্তু ধর্মতত্ত্বের সূচীভেদ্য রহস্যে ঘেরা রুদ্রাক্ষপ্রতিম ‘চর্যা’ কবিতাগুলি ছিল মূলত বিশেষ সাধকগোষ্ঠীরই উপলব্ধির বিষয়, সাধারণের উপভোগের নয়। তাই পরবর্তীকালে জন রুচির টানে কবিতায় দেখা দিয়েছিল আখ্যায়িকার আকার। তাকে জটিলতর ও সুন্দরতর করে তোলার জন্যে কথায় ও কুশীলবে, ঝঙ্কারে-অলঙ্কারে, সঙ্গীতে আর ভঙ্গীতে, সংঘর্ষে ও সমন্বয়ে যুক্ত হয়েছিল পৌরাণিক প্রকল্পনা৷ অবশ্য কবিতার আঙ্গিককে মেনে নিয়ে উদ্দীষ্ট তত্ত্বকে সর্ববোধ্য করে তোলার জন্য চর্যাকারের হয়ত পুরাণ-চেতনাকে স্পর্শ করার কথা ভেবেছিলেন (প্রসঙ্গত স্মরণীয় মণীন্দ্রমোহন বসু ৩৪ এবং ৪৯ সংখ্যক চর্যায় অবধৃতি এবং গৃহিণীকে চণ্ডালীরূপে চিন্তা করার মধ্যে যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের যথাক্রমে বশিষ্ঠ অরুন্ধতী আখ্যানের ‘জ্ঞপ্তি দেবী’ এবং ‘লবণ রাজা’র আখ্যানের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন)। তবু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র কাহিনী-কল্পনার মধ্যেই লক্ষণীয় তার স্পষ্ট পদক্ষেপ। পদসঞ্চার নয়, পদক্ষেপ। কেননা পৌরাণিক কথা-অংশের পাশাপাশি সমকালীন লোকাশ্রয়ী ভাবনাও হয়েছিল প্রতিফলিত কাব্যটির বিষয়-উৎস-ইতিহাস তাই অনচ্ছ। সাধারণভাবে দেখা যায় কাব্যটির মূল কাহিনী ভাগবত অনুসারী, বিষ্ণুপুরাণ ও পদ্মপুরাণের নানা প্রসঙ্গ তার সহায়িকা এবং গীতগোবিন্দের আঙ্গিক বা রূপবন্ধের সঙ্গে তা সম্বন্ধযুক্ত। এখানে পৌরাণিক লক্ষণ কতদূর লক্ষণীয় আপাতত সেটি বিচার্য।


‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে জন্মখণ্ডে পৃথিবীতে কংসের অত্যাচার, দেবতাদের কাছে বসুন্ধরার আবেদন এবং ব্রহ্মাকে স্মরণ এবং দেবতাদের মন্ত্রণাসভা আহ্বানের কল্পনা বিষ্ণুপুরাণ এবং পদ্মপুরাণ অনুসারী। কাব্যে বর্ণিত সংস্কৃত শ্লোকের “পৃথুভারব্যথাং পৃথ্বী কথায়ামাস নির্জ্জরান্” বা বাংলা “সব দেবেঁ মেলি সভা পাতিল আকাশে” ইত্যাদি বিবরণ বিষ্ণুপুরাণে আছে—

“এতস্মিন্নেব কালে তু ভূরিভারাবপীড়িতা। জগাম ধরণী মেরৌ সমাজে ত্রিদিবৌকসাম্ ৷৷” আছে পদ্মপুরাণেও “...কংসেন তাড়িতা নাথ ইতিতস্মৈ নিবেদিতুম্”, এমন কি ভাগবতেও “আক্রান্তা ভূরিভারেন ব্রহ্মানং শরণং যযৌ” ইত্যাদি।


এর পরে কংসকে বধ করার জন্যে ক্ষীরোদ সাগরের তীরে অবস্থিত হরির “ধল কাল দুই কেশ থেকে” হলী বনমালী (অর্থাৎ বলরাম ও কৃষ্ণ) জন্ম-ঘটনা বর্ণনা পুরাণ সমর্থিত। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডের কাহিনীই বিশেষভাবে অনুসৃত৷ আবার কৃষ্ণের জন্মের পর বসুল বা বসুদেবের নবজাতক নিয়ে গোকুল গমন, যশোদার কন্যাকে নিয়ে আসা, কংসের কন্যাকে শিলাপটে আছাড় মারা এবং দৈববাণী, কংসের কৃষ্ণবধের জন্য পর্যায়ক্রমে পুতনা-যমল অর্জুন-কেশী দৈত্যকে প্রেরণ ও তাদের কৃষ্ণের হাতে নিধন-তথ্য পুরাণের অনুরূপ। সম্ভবতঃ সর্বজন পরিচিতির কথা ভেবে প্রসঙ্গগুলি অতি সংক্ষিপ্ত এবং সূত্রাকারে নির্দেশিত। অথবা কাহিনীকে যথাসম্ভব দ্রুত ও লোকবাস্তব করে তোলার আকাঙ্ক্ষা এই সংক্ষিপ্ততার কারণ হতে পারে। কেননা, লক্ষ্য করা যায় এর পর নারদের ও বড়াইর আগমন ও আচরণ বর্ণনা থেকে কবির স্বাভাবিক স্ফূর্তি ও মৌলিকতা প্রদর্শন-চেষ্টা দেখা গেছে এবং কাহিনীতে ক্রমে দেখা গেছে দান নৌকা-ভার যমুনা-হার-বংশী প্রভৃতি খণ্ড কল্পনায় অ-পৌরাণিক প্রবণতা। এই প্রবণতা হয়ত স্বেচ্ছাকৃত।


কৃষ্ণের জন্মবৃত্তাত্ত পুরাণ অনুসৃত, কিন্তু রাধার জন্মকাহিনী বর্ণনায় কবির স্বাধীনচারী মনোভাব স্পষ্টরেখ। তথ্যগত সাক্ষ্যে আমরা জানি, ভাগবত, হরিবংশ বা বিষ্ণুপুরাণে রাধা-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। কিন্তু পদ্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এই প্রসঙ্গ ছিল। পুরাণ‌ দুটিও কবির অপরিচিত নয়। তবু দেখা যায়, পদ্মপুরাণে রাধার মায়ের ‘কীর্তিদা’ বা ‘কীর্তিকা’ নাম এবং ব্রহ্মবৈবর্তে ‘কলাবতী’ এবং পিতা ‘বৃষভানু’ নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পরিবর্তিত হয়েছে। কবির দৃষ্টিতে, রাধার জন্ম “পদুমা উদরে উপজিলা সাগরের ঘরে।” এ পরিবর্তন আকস্মিক বিচ্যুতি নয়; কেননা কৃষ্ণের কাছে পরিচয় প্রসঙ্গে বড়াইও জানিয়েছে— “পদুমিনী আওপার নাতিনী রাধানাম (তাম্বুলখণ্ড)।” এখানে ‘পদ্মিনী’ বিশেষণটি রূপ-সৌন্দর্য বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত; আরো জানা যায় ‘রাধা’ এবং ‘চন্দ্রাবলী’ পুরাণের দুই ভিন্ন নারী এখানে একই দেহে অঙ্গীভূত। মনে প্রশ্ন জাগে, এক্ষেত্রে কবি কি তার “অদ্ভুত কনক পুতলী”-কে গড়ে তোলার জন্য সাগর-পদ্ম এবং চন্দ্রের সম্পর্ককে মনে রেখে রাধা-জন্মের ক্ষেত্রে পৌরাণিক তথ্য লঙ্ঘন করে কোনও বিশেষ ভাবকল্পনার কথা ভেবেছিলেন? রাধার জন্মের কারণ রূপে কবি জানিয়েছেন

“কাহাঈর সম্ভোগ কারণে।

লক্ষ্মীক বুলিল দেবগণে ৷৷ 

আল রাধা পৃথিবীতে কর অবতার।

থির হউক সকল সংসার ।।”


প্রকৃত বিচারে এই কারণে-নির্দেশ ঠিক পুরাণ-সম্মত নয়, বরং-অ-সংস্কৃত কাহিনীকে রক্ষণশীল শ্রোতা-সাধারণের বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এটি এক কুশলী প্রচেষ্টা মাত্র। কবি নিশ্চয় জানতেন, গ্রামীণ বাঙালীর প্রাথমিক অমসৃণতার প্রতিনিধি যে ‘‘ঘোড়াচুলে কাহ্ন’’ ‘কালিনী নঈকুলে’ ‘মাউলানী রাহী’র সঙ্গে ‘ধামালী’-রত হবে, তাকে প্রথম উপস্থাপনায় পুরাণধার্য করে তোলার প্রয়োজন আছে। অথচ বিচিত্র মনে হলেও একথা সত্য, ভাগবতে এবং পুরাণে শ্রীদামা, সুদামা, অংশুভদ্র প্রভৃতি বালক কৃষ্ণের যে সব বহুপরিচিত সহচরের কথা আছে এখানে ‘বলভদ্র’ নামটুকু ছাড়া তাদের কোনো পরিচয় নেই ; রাধার ষোলশ সখীর প্রসঙ্গ আছে কিন্তু নেই ললিতা, হরিপ্রিয়া, ভদ্রা, চন্দ্রাবলী ইত্যাদি কোন ব্যক্তিনাম। হয়ত পালা আকারে পরিবেশনের পক্ষে অভিনয়ে অসুবিধে হবে ভেবে বড়ু চণ্ডীদাস নির্দ্বিধায় সেগুলি বাদ দিতে পেরেছেন। আবার পরিবর্তনও করেছেন কালীয়দমন খণ্ডে। এছাড়া দশাবতার স্তোত্রের মধ্যে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি সুপরিচিত ক্রমের মধ্যে 'কৃষ্ণে'র নামটি শেষে যোগ করে।


বড়ু চণ্ডীদাসের সর্বাধিক নৈপুণ্য অনুভব করা যায় পুরাণের অনুসরণে নয়, ব্যবহারে। বলা বাহুল্য, এই ব্যবহার প্রধানত কবির কাম-বাসনা তথা চরিত্রের রতিচেতনার অনুগামী। কৃষ্ণের পরস্ত্রীর প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে ধিক্কার দিয়ে রাধা তাকে নৈতিক ভয় দেখায়— “পুরাণ আগম বেদ করহ বিচার / দেখ যত পার হএ কৈলে পরদার ?” দৃষ্টান্তরূপে সে দেখায় (ক) গুরুপত্নী তারাকে শশধরের হরণ করার ফলে “অদ্যাপিহো অপযশ তার পরচরে”, দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যাকে হরণ করাতে “সহস্রেক যোনি ভৈল তার কলেবরে”; সুন্দ-উপসুন্দ “তিলোত্তমা হেতু দুঈ মরল এক ঠাই”, সুম্ভ-নিসুম্ভ “পার্বতীর কারণে দুঈ জন মৈলা” ইত্যাদি ঘটনা। বিপরীতভাবে, কৃষ্ণও মুখর হয়ে ওঠে—কুম্ভীর পঞ্চপুত্র লাভ করার মূলে “পঞ্চ পতী যার ভৈল সব লোকেঁ জাণী”; রম্ভা প্রভৃতি “হেন সব কণ্যা কেহ্নে সুরপুরে বসে”; শিবের জটা থেকে যার যাত্রা এবং পতিতপাবনী যার নাম কেন সেই “গঙ্গা রমিল শান্তনু নাম নরে” প্রভৃতি প্রসঙ্গ উত্থাপনে। পৌরাণিক প্রসঙ্গ এভাবে ব্যবহার করার ফলে দেখা যায়—

  • (ক) রাধা-কৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তি এবং তাদের দ্বন্দ্ব উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
  • (খ) কবি-চিত্ত নাট্যকারের মতো নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ পেয়েছে। 
  • (গ) পৌরাণিক মনে কাম কিভাবে স্মরণ্য নারী-পুরুষের মধ্যেও ছিল তা কবি দেখাতে পেরেছেন। সুতরাং কাহিনীর পক্ষে এই ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

জন্মখণ্ডে বর্ণিত 'তীনভুবনজনমোহিনী’ রাধাকে আক্ষরিকভাবে সত্য করে তোলার জন্য বাণখণ্ডে কবি রাধার কণ্ঠেই পৌরাণিক প্রসঙ্গকে স্থাপন করেছেন। এর ফলে একদিকে দেখা গেছে রূপ-কামনায় অভিনবত্ব এবং অন্যদিকে রাধা-চিত্তে আপন সৌন্দর্য সম্পর্কে রমণীয় স্পর্ধা

“তীন ভুবন বীর রাখএ যৌবন ধন। 

কী করিতে পারে জগন্নাথে ॥”


দৃষ্টান্তস্বরূপ, সে জানিয়েছে তার খোঁপায় মহাদেব, অলকাগুচ্ছে নীলগঙ্গা, সিঁথের সিঁদুরে সূর্য, ললাট-তিলকে চন্দ্র, নয়নে মদনদেব এবং দেহের অন্যান্য অংশে সুগ্রীব, গরুড়, পাণ্ডু, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি বিভিন্ন শক্তি অবস্থানের কথা। এছাড়া আছে নানাস্থানে মীনকন্যা, বেদব্যাস, অর্জুন, রাবণ, রাম, সীতা, রোহিণী প্রভৃতি নাম।


‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে ভাগবতের প্রভাব অনুসরণে প্রথমেই চোখে পড়ে, ভাগবতের কালীয়দমন-বস্ত্রহরণ ও রাস-লীলা বর্ণনার এই নির্দিষ্ট পর্যায় অনুসরণ করা হয়নি। এ কাব্যের কাহিনীতে আগে ‘রাস', তারপর ‘কালীয়দমন' এবং শেষে ‘বস্ত্রহরণ’ ঘটনা রূপায়িত। সাধারণভাবে রাসলীলা বর্ণনায় গোপীদের আত্মতুষ্টি, কৃষ্ণের বিলাস, রাধার কাছে কৃষ্ণের যাত্রায় গোপীদের বিলাপ ইত্যাদি ঘটনা ভাগবতের মতোই। তবু পার্থক্য দেখা যায়—প্রথমত, কৃষ্ণ রাধাবাক্যের আনুগত্যে রাসলীলায় উৎসাহী এক কল্পিত ব্যাখ্যাদান চেষ্টায়। দ্বিতীয়ত, ভাগবতের শারদ-রজনীর রাসলীলা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বসন্তকালে এবং পরে দিনের বেলায় অনুষ্ঠিত। প্রসাধন কলায় আছে গীতগোবিন্দের আনুগত্য। তৃতীয়ত, কালক্রমের দিক থেকে ভাগবতে (এবং গীতগোবিন্দেও) রাসলীলা যেখানে কংস-ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনা, এখানে পাই তার পূর্ববর্তী ঘটনা। এদিক দিয়ে তাই ভাগবত নয়, রাস-বর্ণনা গর্গসংহিতা বা ব্রহ্মবৈবর্তের অনুসারী।