“বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য”- আলোচনা করো।

বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য


‘বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাস্য' শুধু এটুকু বলাই বৈষ্ণব পদাবলীর - পক্ষে যথেষ্ট নয়, কারণ বাঙালি বৈষ্ণব সমাজে বৈষ্ণব পদাবলীর মূল্য এবং প্রভাব বহুব্যাপ্ত। শুধু বৈষ্ণব তত্ত্ব নয়, বৈষ্ণব ধর্ম এবং দর্শনের ক্ষেত্রেও বৈষ্ণব পদাবলীকে রসভাষ্যরূপে গ্রহণ করাই সঙ্গত। বৈষ্ণৱ ধৰ্ম, দর্শন বা তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলেই তার পশ্চাৎপট একটু বিচার করে দেখা প্রয়োজন।


অতি প্রাচীনকালেই ভারতে 'ভাগবত ধর্ম', 'সাত্বতধর্ম প্রভৃতি নামে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচলিত ছিল। মহামুনি পাণিনির কালেও 'বাসুদেব সম্প্রদায়' নামে কৃষ্ণ-উপাসক সম্প্রদায় বর্তমান ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তী কালে বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদকে খণ্ডন করে বৈষ্ণবাচার্যগণ সমগ্র ভারতে চারটি বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন–শ্রীসম্প্রদায়, রুদ্রসম্প্রদায়, ব্রহ্মসম্প্রদায় এবং চতুঃসন বা সনক সম্প্রদায়। এঁরা ভক্তবাদী বৈষ্ণব হলেও এঁদের প্রধান উপাস্য ছিলেন হরি, নারায়ণ, বিষ্ণু বা লক্ষ্মীজনার্দন; মহাপ্রভু গৌরাঙ্গদেবই রাধাকৃষ্ণ যুগলমূর্তির উপাসনার মধ্যে দিয়ে 'গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়' নামে পঞ্চম বৈষ্ণব সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্বোক্ত বৈষ্ণব ধর্ম, দর্শন বা তত্ত্ব বলতে মহাপ্রভু সৃষ্ট এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় -আচরিত ধর্ম-দর্শন-তত্ত্ব আদিই বুঝতে হবে এবং এরই সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত রয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী।


বৈষ্ণব ধর্ম মানেই তো প্রেমধর্ম, আর বৈষ্ণব পদাবলী মানেই রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিচিত্র রূপ-রূপান্তরের বর্ণনা। কাজেই বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে প্রায় ধারণাই করা যায় না।


গৌরঙ্গদেব কেশব ভারতীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করবার পরই তার মধ্যে যে সকল পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল তাতেই তার সমসাময়িক কবি ও পণ্ডিতগণ রাধাভাবের লক্ষণকে স্ফুরিত দেখতে পেয়েছিলেন। পরে চৈতন্যদেব ঈশ্বরপুরীর শুরু মাধবেন্দ্রপুরীর রাধাভাবের উপাসনা এবং রায় রামানন্দের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে রাধাতত্ত্ব বিষয়ে আরও অবহিত হয়ে রাধাভাবের উপাসনাকেই সাধ্যবস্তু বলে গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে তিনি স্বরূপ দামোদর, বৃন্দাবনের রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন ও তত্ত্ব-বিষয়ে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করেন। উক্ত গোস্বামীদ্বয় এবং তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র জীব গোস্বামীই বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন ও তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। ঐ সব গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। কবিরাজ গোস্বামী কৃষ্ণদাস তার 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে বৈষ্ণব দর্শন ও তত্ত্বকে বাংলা ভাষায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। চৈতন্যোত্তর বাঙালী কবিগণ রূপ গোস্বামী কৃত 'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু' এবং ‘উজ্জ্বলনীলমণি’, কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কৃত ‘গোবিন্দলীলামৃত’ ও ‘চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থ এবং জীব গোস্বামী রচিত ‘ষট্-সন্দর্ভ' নামক ছয়টি গ্রন্থকেই বৈষ্ণবধর্ম দর্শন ও তত্ত্বের মূল এবং প্রামাণিক বলে মান্য করে থাকেন। জীব গোস্বামী সমগ্র বৈষ্ণব ধর্ম-দর্শনের সার রূপ ‘অচিস্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব' প্রতিষ্ঠা করেন। চৈতন্যোত্তর সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যই এই তত্ত্বের আধারে পরিকল্পিত ও উপস্থাপিত হয়েছে।


অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বে ব্রহ্মা এবং জগৎ উভয়কেই সত্যরূপে স্বীকার করা হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জগতের নশ্বরত্বও স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই দুয়ের পৃথক্‌ সত্তা বা ভেদ যেমন স্বীকৃত, তেমনি স্বীকৃত হয়েছে তার অভেদও। অচিন্ত্য উপায়ে এই ভেদ ও অভেদ ঘটে থাকে বলেই এই তত্ত্বকে বলা হয় 'অচিস্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব'। এর ব্যাখ্যাম্বরূপ বলা যায়—“সত্য ব্রহ্মা স্ব-হৃদয়ের লীলা আস্বাদন করবার জন্য জীব সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এই দ্বৈতভাব চিরস্থায়ী নয় জীবের সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে নিয়ত বর্তমান। ফলত, অনুক্ষণ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে মিলনের সযত্ন বেদনা-ঘন প্রয়াস দেখা যায়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ব্রহ্মা আর‌ শ্রীমতী রাধিকা জীবনের স্বরূপ আবির্ভূত। শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা – যিনি নিয়ত জীবকে আকর্ষণ করেছেন,‌ শ্রীমতী রাধিকা জীবাত্মার অনুকল্প–যিনি আরাধিকা রূপে পরমাত্মার সঙ্গে সাযুজ্য লাভের নিমিত্ত সর্বক্ষণ রত।"


রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্যোর মধ্য দিয়ে অনুক্ষণ পরমাত্মা ও জীবাত্মার লীলাখেলা চলছে–এই আধ্যাত্মিক তত্ত্বটিকেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় বৈষ্ণব পদাবলীর মূল সুর বলে গ্রহণ করে থাকেন। এবং তাদের মনে এই বিশ্বাসও বদ্ধমূল যে পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধিকার ভাবযুক্ত হয়ে ('রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত') শচীনন্দন গৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন উদ্দেশ্য—রাধার কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ স্বদেহ দ্বারা আস্বাদন –

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীৰ্দৃশো বানয়ৈবাস্বাদ্যো

যেনাল্গুতমধুরিমা কীর্দৃশো বা মদীয়ঃ। 

সৌখ্যং ঞ্চাস্যা মঈনুভবত কীদৃশং বেতি লোভাৎ,

তত্ত্বাবাঢ্যঃ সমঞ্জনি শচীগৰ্ভসিদ্ধৌ হরীদুঃ।।


অর্থাৎ শ্রীরাধিকা যে প্রেম দ্বারা আমার অদ্ভুত মধুরিমা আস্বাদন করেন, সেই প্রেমের মহিমাই বা কীরূপ, সেই প্রেম দ্বারা শ্রীরাধা-কর্তৃক আস্বাদিত আমার অদ্ভুত মাধুর্য বা তার আস্বাদনই বা কীরূপ এবং আমাকে অনুভব করে শ্রীরাধার সুখই বা কীরূপ—এই লোভের বশীভূত হয়েই শ্রীকৃষ্ণ শচীগৰ্ভসিন্ধুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।


গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বৈষ্ণব কবিগণ বৈষ্ণব পদাবলীর সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আনন্দসত্তার উৎস থেকে উদ্ভূত হ্লাদিনী শক্তিই রাধা, অতএব রাধা কৃষ্ণ থেকে পৃথক্‌ নন। তাঁদের এই দ্বৈত ভূমিকা লীলা আস্বাদনের জন্যেই, উভয়ের মিলনে সমস্ত লীলার অবসান ঘটতে পারে। কিন্তু সেই অবসানের তো সুযোগ নেই, কারণ পরমাত্মা ও জীবাত্মার লীলা তো অনাদিকাল থেকেই চলছে এবং অনন্তকাল অবধি চলবে। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর সমাপ্তিও মাথুর পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমনের তথা 'বিরহ'-এর মধ্যেই। অনস্তকাল ধরে শুধু মিলনের আকুলতাই থেকে যাবে। অতএব বৈষ্ণব পদাবলী যে বৈষ্ণব তত্ত্বের রস রূপেই রচিত হয়েছিল তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।


এবার বৈষ্ণব পদাবলী বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে, এতে বৈষ্ণব তত্ত্ব কতটা অনুসৃত হয়েছে। ধর্মীয় ভাবে অনুপ্রাণিত হলেও বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের প্রাচীনতর সাহিত্যধারাকে অনুসরণ করেই রচিত হয়েছে। কাজেই সাহিত্যের তত্ত্ব দিয়েই বৈষ্ণব পদাবলীর বিচার সঙ্গত। বৈষ্ণব ধর্মাচার্যগণও এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তারা এদিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের অন্যতম ভিত্তি প্রতিষ্ঠাতা, বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীদের অগ্রগণ্য রূপ গোস্বামী বৈষ্ণব রসতত্ত্ব অবলম্বন করে রচনা করলেন তার মহামূল্য গ্রন্থ 'উজ্জ্বলনীলমণি'। 'উজ্জ্বলনীলমণি’তে তিনি বৈষ্ণবধর্মসম্মত 'পঞ্চরস'-এর কথাই স্বীকার করেছেন। এই পঞ্চরস শাস্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর বা উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার রস। এদের মধ্যেও ক্রমপর্যায়ানুযায়ী তিনি মধুর রসকেই ভক্তিরসো শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আবার বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে এ কথাও স্বীকৃত “বিভাবৈরনুভাকৈশ্চ... ভবেৎ।” অর্থাৎ শ্রবণ-কীর্তনাদি দ্বারা জাত স্থায়ী ভাব 'কৃষ্ণরতি' বিভাব-অনুভাব-সাত্ত্বিক ভাব ব্যভিচারী দ্বারা ভক্ত হৃদয়ে আস্বাদ্যতা আনীত হলে তা হয় 'ভক্তিরস'। অতএব যাবতীয় রসের মূলে আছে ‘কৃষ্ণরতি' এবং তাকে অবলম্বন করেই বৈষ্ণব তত্ত্বানুযায়ী 'ভক্তিরস' হবে বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। বাস্তবে আমরা সমগ্র পদাবলী জুড়ে এই ভক্তিরসেরই প্লাবন দেখতে পাই। বৈষ্ণব মহাজন পদকর্তারা ভক্তিতে আপ্লুত হয়েই সখী বা মঞ্জরীরূপে রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্য অন্তরে অনুভব করে তাকে কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।


রসের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যে পঞ্চরসের কথা 'উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষ্ণব কবিগণ তাদের সাধ্য অনুযায়ী সেই সকল রসেরই নিদর্শন তুলে ধরেছেন বিভিন্ন পদে। প্রথমেই আছে 'শাত্তরস' কৃষ্ণ নিষ্ঠা ও বিষয় তৃষ্ণা ত্যাগ শাস্তরসের প্রথম কথা। সর্বপ্রকার রসের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ এটিকে সর্বাধিক নিম্নস্তরের মনে করেন। কারণ শাস্তরসে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে যে দূরতর সম্পর্ক বর্তমান থাকে, তা বৈষ্ণবের কাম্য নয় এবং শাস্তরসে যে মুক্তির কামনা থাকে, তা-ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রার্থিত বা অনুমোদিত নয়। তবে এরূপ পদও প্রাক্-চৈতন্য যুগের বিদ্যাপতির রচনায় বর্তমান এবং চৈতন্যোত্তর যুগের কোনো কোনো কবি প্রার্থনার পদে শাস্তরসের পরিচয় দিয়েছেন। বৈষ্ণব মতে দ্বিতীয় রস দাস্য – দাস্যভাবের মূল কথা সেবা। দাস্যভাবে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য-ভাবই প্রকটিত হয় বলে তাও গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে অনুমোদিত হয় না। তৎসত্ত্বেও নরোত্তমের কোনো পদে এবং কচিং অন্যত্র দাস্যভাবের পদও একাস্ত দুর্লভ নয়। রসশাস্ত্রোক্ত তৃতীয় রস 'সখ্য'। কবিরাজ গোস্বামী ব্রজজনের ভাব নিয়ে কৃষ্ণোপাসনাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন। গোষ্ঠলীলা আদি বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক কবিই এই সখ্য রসের পরিচয় দিয়েছেন। চতুর্থ ‘বাৎসল্য রস'-এও ব্রজলীলার ভাব বর্তমান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার যাবতীয় পদ এবং গোষ্ঠলীলারও অনেক পদে বাৎসল্য রসের উত্তম উত্তম দৃষ্টান্ত রয়েছে। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ‘মধুর রস কেই সর্বোত্তম রস বলে অভিহিত করা হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনা মধুর রসেরই সাধনা। এই সাধনায় ভগবানকে কাস্তরূপে গ্রহণ করা হয়। রাধাকৃষ্ণ-সম্পর্কিত যাবতীয় পদই মধুর-রসাশ্রিত। মধুর রসের দুটি ভাগ–বিপ্রলম্ভ এবং সম্ভোগ। বিপ্রলস্তের চারটি ভাগ— পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্র্য বা আক্ষেপানুরাগ এবং প্রবাস যাবতীয় বৈষ্ণব কবিতাই এই চারটি এবং সম্ভোগ বা ভাবসম্মেলন – এই পাঁচটা পর্যায়ের কোনো না কোনো একটা পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। রাধা এবং কৃষ্ণকেই অবলম্বন করেই বৈষ্ণব পদাবলী –শ্রীকৃষ্ণ রাধা-প্রেমের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যেই ভূতলে আবির্ভূত হয়েছিলেন -

'কৃষ্ণের যতেক লীলা      সর্বোত্তম নরলীলা

নর বপুঃ তাহার স্বরূপ।'


অতএব বৈষ্ণবগণ এই রাধাপ্রেমেরই বিচিত্র রূপ রচনা করেছেন বিভিন্ন পদে। শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি তাঁর নিত্যপ্রিয়া রাধাই বৈষ্ণব কাব্যের নায়িকা। 'উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থে নায়িকার অষ্টাবস্থা বর্ণনা করেছেন—অভিসারিকা, বাসকসজ্জিকা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা, কলহাস্তুরিতা, প্রোষিতভর্তৃকা ও স্বাধীনভর্তৃকা। বৈষ্ণব কবিতায় রাধার এই বিভিন্ন অবস্থার চিত্র অঙ্কন করেছেন বিভিন্ন কবি বিভিন্ন পদে। অতএব বৈষ্ণব পদাবলীর এই সমস্ত পদও বৈষ্ণব তত্ত্বেরই রসভাষ্য।


সর্বশেষে বলতে হয়, 'গৌরচন্দ্রিকা'র কথা। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের একটা প্রধান অংশ অধিকার করে রয়েছে 'গৌরচন্দ্রিকা'। পূর্বেই বলা হয়েছে যে রাধাপ্রেমের স্বরূপ উপলব্ধির জন্যেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন -

রাধাকৃষ্ণ প্রণয় বিকৃতিহ্লাদিনী শক্তিরশ্মা

দেকাত্মনারণি ভবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।

চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা অদ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং

রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।।


অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রায়বিকৃতি হ্লাদিনী শক্তিই বাধা, এইজন্য তারা একান্ত একারা হয়েও পৃথিবীতে দেহভেদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অধুনা সেই দুই আবার ঐক্য লাভ করেছেন, রাধাভাবদ্যুতি-সুবলিত চৈতন্য নামে আখ্যায়িত সেই প্রকট কৃষ্ণস্বরূপকে প্রণাম করি।


অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণভক্তের চক্ষে রাধা কৃষ্ণের মিলিত রূপ গৌরচন্দ্র- বহিরঙ্গে তিনি রাধা, অস্তরঙ্গে কৃষ্ণ। অতএব তার যাবতীয় লীলাই রাধা কৃষ্ণলীলার অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণবতত্ত্বসম্মত। বিশেষত গৌরলীলাতেও আমরা এই লীলার সদৃশ বাল্যলীলা, অভিসার, মান, মাথুর-আদি পর্যায় লক্ষ করি। অতএব গৌরচন্দ্রিকাসহ যাবতীয় বৈষ্ণব পদকেই বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য বলে মেনে নিতে কোনো বাধা নেই।