প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সাহিত্য

প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সাহিত্য


প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষার সঙ্গে প্রাচীন বাঙালী ও বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ক আদৌ দূরত্বের নয়। ভাষাগত দৃষ্টিকোণে ‘প্রাকৃত’ বা ‘অপভ্রংশ' নামকরণের কারণ, সংস্কৃত বাগ্‌ভঙ্গী থেকে তার বিচ্যুতি : Speech fallen off (from the norm) vulgar speech" (Growth of Gujraite Language', M. R. Majumder, Journal of the University of Bombay. Vol. V.pt. III. November 1934)। এ ধরনের বিচ্যুতি ল্যাটিন ভাষার ক্ষেত্রেও ঘটছে। প্রতিদিনের ব্যবহারের মৌখিক ভাষা যখন সাহিত্য-শীলিত ও সুসংস্কৃত ল্যাটিন ভাষা থেকে পৃথক হয়ে গেল, তখন সেই প্রাত্যহিক ঘরোয়া ভাষাকে ‘popular' বা 'vulgar Latin' বলা হল। এই vulgar Latin-এর ধ্বনিতাত্ত্বিক ভাষাতাত্ত্বিক মনস্তত্ত্ব অনেকটা প্রাকৃত ও অপভ্রংশের অনুরূপ। বস্তুতঃ প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষার উদ্ভবের মূলে ছিল– (ক) সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারকারীর এই ভাষা দ্বয়ের প্রতি উপেক্ষিত মনোভাব। (খ) সংস্কৃত ধ্বনির পৌরুষেয় বা ক্লাসিক গাম্ভীর্য রক্ষার পরিবর্তে প্রাকৃত ভাষায় রমণী বা অপজাত সাধারণ মানুষের মৌখিক রীতির অনুসরণ। (গ) সংস্কৃত ভাষার মননের মার্জিত স্বচ্ছতার প্রতি ঝোক কাটিয়ে প্রাকৃত ভাষাকারের অনির্দেশ্য আবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে কবিতায় সুরের ও তাল-লয়ের সাংগীতিক রূপকে প্রাধান্য দেওয়া প্রভৃতি কারণসমূহ।


উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও দেখা যায়, লোক-হৃদয় ও সমাজ থেকে উপকরণ আহরণ করে প্রাকৃত ভাষার কবিরা কবিতাকে জন-মন-অভিরাম (“জণ মণ অহিরাম হোই”—স্বয়ম্ভু) করে তুলতে চেয়েছিলেন। সেইজন্য লৌকিক ভাবাবেগ, লোক-কবিতার স্মৃতিময় (mnemonics) গীতিধর্ম এবং শ্রবণাভিরাম রীতিরঙ্গে এঁরা কবিতার বরাঙ্গ সাজিয়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তীকালে চর্যার কবিদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ‘চর্যাগীতি’ ছাড়া ‘গাথাসপ্তশতী’ (বা ‘গাহাসত্তসঈ'), ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’, ‘দোহাকোষ’ প্রভৃতি গ্রন্থে সেই যুগের বাঙালী জীবনের অনেক তথ্য-উপাদান ছড়িয়ে আছে। তবে এইগুলি বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল কিনা তা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।


গাথাসপ্তশতী : মহাকবি হাল এই গ্রন্থটির রচয়িতা। এই ‘হাল’ দক্ষিণ ভারতের সাতবাহন বংশের নরপতি হাল, না শালবাহন নামে কোন রাজা এর রচয়িতা, সে সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে সন্দেহ বর্তমান। রচয়িতার নাম-পরিচয়ের সমস্যার জন্য গ্রন্থটির রচনাকালও সঠিকভাবে নির্ণীত হয় নি। তবে ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’, ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, ‘সুভাষিতাবলী’ প্রভৃতি গ্রন্থের বহু শ্লোকের মধ্যে হালের এই কাব্যটির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, বিশেষতঃ রাধার ('রাহী') প্রাচীনতম উল্লেখের জন্য গ্রন্থটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব বেশি। মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত যা সব চাইতে শ্রুতিসুখকর ('prakit per excellence'), এই গ্রন্থটি সেই ভাষাতেই লেখা হয়। প্রায় সাতশ শ্লোক সজ্জিত মানবজীবনের বিরহমিলনের অশ্রু আনন্দ ও কামনার উত্তপ্ত উল্লাসে এই গ্রন্থ আজও পাঠককে আনন্দদান করে।


প্রাকৃতপৈঙ্গলভাব : বিষয়বস্তু ও ভাষা-কৌশলের দিক থেকে এই গ্রন্থটি বাঙালী জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। গ্রন্থটি শৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশে লেখা হয়। বিভিন্ন কবি-রচিত শ্লোকের সঙ্কলন। সঙ্কলকের নাম, পিঙ্গল। ইনি ‘পিঙ্গল ছন্দসূত্র’ গ্রন্থকার নন। পণ্ডিতজনের অনুমান, ১৪শ শতাব্দীতে কাশীধামে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ সঙ্কলিত হয়। এই গ্রন্থেও রাধাকৃষ্ণ ও গোপীলীলার উল্লেখ আছে, আছে বিভিন্ন দেবদেবীর সঙ্গে ‘রাঈ’-এর উল্লেখ এবং শিবের প্রসঙ্গ, আর বাঙালীর জীবনভোগের স্বাদু সংবাদ —

“ওরা ভত্তা, রম্ভঅ পত্তা।

গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সজুক্তা ॥ 

মৌইলি মচ্ছা, নালিতে গচ্ছা।

দিজ্জই কান্তা, খাঅ পুণ্যবন্তা ॥”


অর্থাৎ, ওগরানো ভাত কলা পাতায় ঢালা, গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে শাখ রন্ধন করলেন কান্তা। কান্তা দিচ্ছেন, পুণ্যবান আহার করছেন। 


এই রকম পল্লীবাসী কৃষি-নির্ভর প্রাচীন বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় ‘প্রাকৃত পৈঙ্গলে’র আর একটি পদে পাওয়া যায়—

“পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধণা ভত্তি কুটুম্বিণি সুদ্ধমণা৷

হাক্ক তরাসই ভিচ্চগণা কো কর বব্বর সগ্‌গমণা॥”


অর্থাৎ, পুত্র পবিত্রমনা, প্রচুর ধন, স্ত্রী ও কুটুম্বিনীরা শুদ্ধচিত্তা, হাঁকে ত্রস্ত হয় ভৃত্যগণ—এই সব ছেড়ে কোন্ বর্বর স্বর্গে যেতে চায়।


এইভাবে দেখা যায় কয়েক শতক ধরে আলঙ্করিকদের বহু নিয়মের গণ্ডী পেরিয়ে, অনেক কবির শব্দ-সন্ধানের নিদ্রাহীন রাত ছুঁয়ে মাগধী অপভ্রংশের জঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলা ভাষার ছোট্ট প্রাণ। তারপর আস্তে আস্তে ডানা মেলে একসময় ঝাপিয়ে পড়েছে মধ্যযুগের আকাশে আপনাকে জানতে-বুঝতে-চিনতে।