“বাৎসল্যরসের সৃষ্টি ও প্রকাশে শাক্তপদকর্তাগণ বৈষ্ণবপদ-কর্তাগণ অপেক্ষা অনেক বেশি কৃতিত্বের অধিকারী।”—উক্তিটি বিচার করো।

'আগমনী' ও 'বিজয়া' বিষয়ক পদগুলির মূল রসটি বুঝিয়ে দাও। এই রস সৃষ্টিতে শাক্তপদকর্তাগণের কৃতিত্ব বৈষ্ণবপদ কর্তাদের চেয়ে অনেক বেশি, এমন মনে করার সঙ্গত কারণগুলি উদ্ধৃতি সহ আলোচনা করো।


আগমনী-বিজয়ার মূল রস বৈষ্ণব পদের সঙ্গে তুলনা

এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলার বৈষ্ণব কবিতার যে জোয়ার দেখা দিয়েছিল, কালক্রমে তা স্তিমিত হয়ে গেলেও ঐ আদর্শকে সামনে রেখে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে শ্যামাসঙ্গীতের উদ্ভব ঘটে। বৈষ্ণব পদাবলীর সাদৃশ্যে আমরা একালে এই শ্যামাসঙ্গীতকে শাক্ত পদাবলীরূপে অভিহিত করে থাকি। বৈষ্ণবের সঙ্গে শাক্ত-উপাসনা ও সাধনার প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকায় উভয়ের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য দেখা যায়, তেমনি বৈসাদৃশ্যও প্রচুর। এই পার্থক্য যেমন কতকাংশে বিষয়গত, তেমনি বহুলাংশে রসগতও বটে।


এই প্রসঙ্গে উভয় জাতীয় পদ সৃষ্টির পটভূমিকা বিচার করলে এতদুভয়ের মূলগত পার্থক্যটি উপলব্ধি করা যাবে। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে রাজশক্তির আগ্রাসী আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই দেখা দিয়েছিল বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ও গোষ্ঠীগত চেতনা এবং ফলত উদ্ভব ঘটেছিল বৈষ্ণব পদের পক্ষাস্তরে অষ্টাদশ শতাব্দীর সার্বিক অবক্ষয়ের যুগে রাজনৈতিক কারণে, পারিবারিক বিপর্যয় প্রতিরোধে ব্যক্তি-চেতনার বিকাশে প্রবর্তিত হয় শাক্ত সাধনা, আত্মশক্তির উদ্বোধন কামনায় ভক্ত মাতৃচরণে শরণ গ্রহণকেই একমাত্র উপায়-রূপে গ্রহণ কাঁরে পদ রচনার মধ্য দিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।


শাক্ত পদাবলীর প্রধান ধারা দুটি; একটি 'উমাসঙ্গীত'— 'আগমনী-বিজয়া' গানে কন্যারূপিণী উমাই এখানে বিষয় এবং অপরটি 'শ্যামাসঙ্গীত'—'ভক্তের আকুতি' ও 'জগজ্জননীর রূপ’ প্রভৃতি পর্যায়ে শ্যামাসাধনায় এর বিস্তার আগমনী বিজয়ার কন্যারাপিনী উমার প্রতি প্রধানত জননী মেনকার অকৃত্রিম বাৎসল্যের যে স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, রসের বিচারে তাকে 'বাৎসল্য রস' বলেই অভিহিত করা হয়। আগমনী-বিজয়ায় কচিৎ দেবীর ঈশ্বরী মূর্তিতে ঐশ্বর্যরসের প্রকাশ ঘটলেও তাকে একান্তভাবে গৌণ বলেই মনে করা হয় এর মূলরস 'বাৎসল্য'‌ অথবা ঐশ্বর্যরসের বিপরীত বলে কেউ কেউ একে ‘মধুর রস' বলেও অভিহিত ক'রে থাকেন।‌ একে ‘মধুর রস'নামে অভিহিত করবার পক্ষে আর একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করা চলে। ‘আগামী-বিজয়া’র পদগুলিতে বাঙালীর গার্হস্থাজীবনে মাতা-কন্যার যে অমৃত মধুর সম্পর্কের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তাকে 'মধুর রস' ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে। এই প্রসঙ্গে বৈষ্ণবপদে ব্যবহৃত ‘মধুর রসে'র সঙ্গে এর পার্থক্যটি স্পষ্ট ক'রে দেখে নেওয়া দরকার।


গৌড়ীর বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পঞ্চরসকে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে শাস্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর বা শৃঙ্গার অথবা উজ্জ্বল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে অবলম্বন করে প্রায় সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে কাস্তাপ্রেমের যে বহুধা বিস্তার বৈষ্ণবকবিগণ বর্ণনা করেছেন, তাতে প্রধান অথবা বলা চলে, প্রায় একমাত্র রসই ‘মধুর রস'। এ জাতীয় মধুর রসের অর্থাৎ শৃঙ্গার রসের ব্যবহার শাক্তপদে একেবারেই নেই। বৈষ্ণব পদে ‘শাক্ত' ও 'দাস' রস প্রায় অনুপস্থিত; 'সখ্য' রসের অল্প কয়েকটি পদ আছে, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য নয়— এ ছাড়া আছে কিছু ‘বাৎসল্য রসে’র পদ। শাক্ত পদাবলীর উমাসঙ্গীতে তথা আগমনী-বিজয়ার গানে এ জাতীয় ‘বাৎসল্যরসই মুখ্যস্থান অধিকার করেছে। শাক্ত পদাবলীর অপর সমস্ত পর্যায়ের রসকে 'প্রতিবাৎসলা' নামে অভিহিত করা চলে–বৈষ্ণব পদের ‘প্রার্থনা' ও 'নিবেদন' অংশে তার কিছু নিদর্শন থাকলেও তা’ উল্লেখযোগ্য বিবেচিত হয় না। তবে অন্যতম বৈষ্ণব রসশাস্ত্র প্রণেতা শ্রীরূপ গোস্বামী শৃঙ্গার বাৎসল্য আদি পঞ্চরসকেই মূলত 'ভক্তিরস’ নামে অভিহিত করায় বৈষ্ণবপদ এবং শাক্তপদ এসে এক স্থানে দাঁড়িয়েছে—বস্তুত উভয় ক্ষেত্রেই অর্থাৎ বৈষ্ণব পদে যেমন শাক্ত পদেও তেমনি—'ভক্তিই মূল কথা, শুধু ভক্তি-প্রকাশের উপায়ের মধ্যেই পার্থক্য।


'আগমনী-বিজয়া'র গানে যে বাৎসল্য-রস প্রকাশিত হয়েছে, তার সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর বাল্যলীলা পর্যায়োক্ত বাৎসল্য রসেরই তুলনা প্রতিতুলনা সম্ভবপর। আগেই বলা হয়েছে, বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান রস-'মধুর' তথা শৃঙ্গার এ জাতীয় পদ শাক্তসঙ্গীতে নেই। আবার বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসাদি প্রধান বৈষ্ণব মহাজন পদকর্তাগণ কোনো বাল্যলীলার পদ রচনা না করায় তাঁদের রচনায় বাৎসল্য রসেরও কোনো নিদর্শন নেই। অতএব বৈষ্ণব পদে উৎকৃষ্ট বাৎসল্য রসের নিদর্শন পাবার সম্ভাবনা স্বভাবতঃই অনেকটা কমে আসে। তবে চৈতন্য সমকালীন কিছু কবি গৌরাঙ্গদেবের বাল্যলীলা অবলম্বন করে অল্প কিছু পদ রচনা করেন এবং তারই সাদৃশ্যে শ্রীকৃষ্ণেরও বাল্যলীলার পদ রচনায় তারা এবং পরবর্তীরাও উদ্যোগী হন।


সাধক কবি রামপ্রসাদ অবশ্যই বৈষ্ণব পদের আদর্শে উমাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। রামপ্রসাদের কালীকীর্তনে এমন কিছু পদের সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলি স্পষ্টতঃই কৃষ্ণের বাল্যলীলার সাদৃশ্যে রচিত এবং পটভূমি ও বিষয়গত পার্থক্যহেতু উমার ক্ষেত্রে এগুলি অবাস্তবও বটে।


আচার্য সুশীলকুমার দে তার প্রসিদ্ধ History of Bengali Literature in the Nineteenth Century গ্রন্থে লিখেছেন, 'Not only does he (Ramprasad) imitate in places the characteristic diction and imagery of Baisnaba Padabalis, but he deliberately describes, the Gostha, Ras, Milan of Bhagabati in imitation of the Brindaban Lila Srikrisna.''


শাক্তপদেও ভিন্ন পরিবেশে মা মেনকার অনুরূপ বাৎসল্য রসের প্রকাশ ঘটেছে। কৈলাস থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে উমা ক্লাস্তদেহে পিতৃগৃহে উপনীত হয়েছেন, অতএব মা মেনকা বলেন

‘পথশ্রমে দ্বেদে সিক্ত কলেবর,

ক্ষুধায় মলিন হয়েছে অধর 

যত্নে ক্ষীর সর রেখেছি না ধর 

দিব বদন কমলে।'

রাধাকৃষ্ণের লীলা-দর্শন তথা অনুভূতির সাহায্য গ্রহণ বৈষ্ণব সাধনার অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। অপ্রাকৃত জগতে রাধাকৃষ্ণের যে নিত্যলীলা সাধিত হচ্ছে বৈষ্ণব মহাজন পদকর্তাগণ সেই লীলার প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা। এতদতিরিক্ত বৈষ্ণবপদকে ভক্তিসাধনার অঙ্গ বলে মনে করা চলে না। বৈষ্ণব কবিতায় বাল্যলীলার বাৎসল্য রসাত্মক পদগুলির সঙ্গে তাই ভক্তি-সাধনা যোগ না থাকায় ঐগুলি বৈষ্ণব সমাজে কৃষ্ণলীলাত্মক পদের তুল্য বিবেচিত হয় না। যে অস্তরবেদনায় উদ্বেল হয়ে বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণ লীলারসাত্মক পদ রচনা করেছেন, বাল্যলীলার পদের সেই অস্তরের স্পর্শ অনুভব করা যায় না। পক্ষান্তরে আগমনী-বিজয়ার পদে যে বাৎসল্য রসের প্রকাশ তা শাক্তসাধনারই ফলশ্রুতি রূপে গণ্য হয়ে থাকে। জগন্মাতাকে যেমন মাতৃরূপে ভজনা করা যায়, শাক্তসাধনায় তেমনি কন্যা রূপেও ভজনা করা চলে। ভগবানকে দয়িতরূপে সাধনা পরিচয় পৃথিবীর অপর কোনো কোনো ধর্মমতে সম্ভব হলেও তাকে স্নেহাস্পদা কন্যারূপে সাধনার দৃষ্টাত্ত একমাত্র শাক্তপদেই বর্তমান।

রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অপ্রাকৃত জগতের বস্তু

‘অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম যেন জাম্বুনদ হেম

সেই প্রেম নৃলোকে না হয়।'


সেই লীলা দর্শন বা লীলা রসের আস্বাদন বৈষ্ণব ভক্তের জীবনের চরম লক্ষ্য অতএব এর সঙ্গে পারিবারিক জীবনের কোনো যোগ নেই। পক্ষান্তরে শাক্তসাধক উপাস্যাদেবীর সঙ্গে নিজের অভিন্নত্ব উপলব্ধি করেই তার উপাসনা করেন বলে দেবী আমাদের পরিবারেরই একজন হ'য়ে যান। আগমনী-বিজয়ার পদে জননী মেনকার অন্তর্গুঢ় বেদনার যে রসরূপ প্রতিফলিত হয়, তাতে আমাদের পারিবারিক জীবনের সুখদুঃখ আনন্দ-বেদনার প্রতিচ্ছবিই লক্ষিত হয়,—পক্ষান্তরে বৈষ্ণব পদে মাতা যশোদার উৎকন্ঠাকে একটা আতিশয্য বা বিলাসের অতিরিক্ত কিছু ভাবা যায় না।


শাক্ত কবিগণ হিমালয়মেনকার গার্হস্থ্য জীবন-বর্ণনায় বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের চিত্রকেই গ্রহণ করেছেন। আগমনী-বিজয়ার পদগুলিতে নিরাভরণ প্রাণের কথা মানবীয় আধারে পরিবেশিত হওয়ায় তা সাধারণ মানুষকে অতি সহজেই আকর্ষণ করবার ক্ষমতা রাখে। পদগুলির মধ্যে বাঙালী মায়ের অস্তরের কথা বড় আন্তরিক করুণ সুরে ধরা পড়ে। এতে চেষ্টাসাধ্য কাব্যসৌন্দর্য সংযোজনার কোনো পরিচয় নেই –কবি-সাধকদের লেখনীতে সহজ সরল ভাবেই প্রাণের কথা আত্মপ্রকাশ করেছে। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেন, শাক্তপদাবলীর বাৎসল্য রসের তুলনায় বৈষ্ণব পদাবলীর সমপর্যায়ের পদ ভাবের ঐকান্তিকতা ও আবেগের গভীরতায় ঈষৎ নিষ্প্রভ মনে হয় তাহার কারণ শাক্ত পদাবলীকারগণের বাৎসল্যরস একান্তভাবে বাস্তব মায়ের তীব্র চেতনায় পূর্ণ বাস্তব বলিয়াই সে আবেগ এখনও এমন প্রত্যক্ষভাবে শ্রোতার চিত্ত আকর্ষণ করে। নিম্নোক্ত পদটিতে বাৎসল্যরসের যে প্রকাশ ঘটেছে, তার তুলনা কোথায়?


'গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না, 

বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।

যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয়-

এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানবো না।'


বৈষ্ণবপদে মা যশোদার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বা ভালবাসার মধ্যে কিন্তু এমন আন্তরিকতা ও প্রত্যক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় না। তাই বলা চলে, সামগ্রিক কাব্যোৎকর্ষের বিচারে তুলনামূলকভাবে বৈষ্ণব কবিতা যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন, অন্তত বাৎসল্য রসের বিচারে শাক্তপদের তুলনায় বৈষ্ণবপদ কিন্তু অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।