বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : চণ্ডীদাস (আনু. ১৪১৭ খ্ৰীঃ – ১৪৪৭ খ্রী:)

বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যযুগ : চণ্ডীদাস


পদাবলী সাহিত্য প্রেমের রাজ্য, নয়নজলের রাজ্য। মরমী কবি চণ্ডীদাসের সুদীর্ঘ কাব্য জীবন ইতিহাস একাস্তভাবে অশ্রুজলের ইতিহাস। এই অশ্রুর উৎস-মূল হল, বাহ্য চেতনাবিহীন গহন মনের গভীরতম অনুভূতি। তার পদাবলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য 'বৈষ্ণবতা' নয়, ভাবগভীরতা। মহাকবি চণ্ডীদাস এই গভীরতম অনুভূতির সহজতম প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম শিল্পী।


চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির মতোই বাঙালীর প্রাণের কবি। মধ্যযুগের সাহিত্যে দীন চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, সহজিয়া চণ্ডীদাস, তরণীরমণ চণ্ডীদাস ইত্যাদি নানা নামের ভণিতায় পদ পাওয়া গেছে। বীরভূম জেলার অন্তর্গত নান্নুর গ্রামে ১৪১৭ খ্রীস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তিরোধান ১৪৪৭ খ্রীস্টাব্দে। তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস বাগচী। এঁরা ছিলেন বর্ণে ব্রাহ্মণ। চণ্ডীদাস ছিলেন বাশুলীদেবীর উপাসক। এই মন্দিরের সেবিকা রামতারা বা রামী নামে রজক কন্যাকে চণ্ডীদাস তার ধর্মের সাধন সঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেন। এই রামীরই আদর্শে তিনি তাঁর কাব্যের রাধা চরিত্রকে রূপ দিয়েছিলেন বলে প্রসিদ্ধ কিংবদন্তী আছে। চণ্ডীদাস-কাব্যের সার্থকতা তার অনন্য নির্ভর ভাবুকতার জন্য, শৈল্পিকতার জন্য নয়। তিনি যত বড় দ্রষ্টা তত বড় স্রষ্টা নন। তিনি যত বড় রূপ-দর্শক তত বড় রূপ-শিল্পী নন। তাঁর কাব্যের অনেক স্থানেই ছন্দ অপরিণত, বাক্য অসম্পূর্ণ, রীতি অসংহত এবং মণ্ডনশিল্পের অভাবদুষ্ট। তবু চণ্ডীদাস প্রেমের অদ্বিতীয় কবি। কারণ ‘না বলা বাণীর নীরব ভাষায়’ তিনি ‘মনে মনে লিপি’ লিখেছেন। এই অনাড়ম্বর বাণীই গহন-মনের ধ্যান-স্বপ্নের শ্রেষ্ঠতম বাহন, যা মর্মমূলে শিহরণ জাগিয়ে অনুভূতির রঙীন আবীর মাখিয়ে দেয়। তার পদ অসজ্ঞান মনের আত্মকথা। তাই তা নিরাবরণ, নিরাভরণ এবং সর্বজন-হৃদয়-দ্রাবী :

“সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো 

আকুল করিল মোর প্রাণ।”

কিংবা,

“বঁধু, কি আর বলিব আমি 

জীবনে মরণে জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি।”


ইত্যাদি পদগুলির চিরপুরাতন অথচ চিরনতুন প্রেম-গীতার অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর।

পূর্বসংস্কার-সঞ্জাত কোন নিয়ম-নীতি চণ্ডীদাস-কাব্যে বেগ সঞ্চার করে নি। কবি আপন মানস সরোবরের স্বর্ণকমল চয়ন করে আপনি দিয়েছেন পুষ্পাঞ্জলি। অন্যান্য বৈষ্ণব কবির কাব্যে আমিত্বের শঙ্কিত সজাগ স্পন্দন ধ্বনিত। কিন্তু চণ্ডীদাসের কাব্য আমিত্বের প্রহরী-বেষ্টনে রচিত হয়নি। তাঁর কাব্যে কবি-ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। এইখানেই তার স্বকীয়তা। বিভিন্ন রসপর্যায় নিয়ে পদ রচনা করলেও পূর্বরাগ, বিরহ ও আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভা সার্থকতার সীমা-স্বর্গে উন্নীত। শ্যাম নাম শুনে রাধার মর্মমূলে পূর্বরাগের উন্মেষ :

“জপিতে জপিতে নাম     অবশ করিল গৌ

কেমনে পাইব সই তারে।”


এ পদ সব রকম স্থূলতা, নগ্নতা ও কলুষতা অতিক্রম যেন সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয়লোকের দিকহারা দিগন্ত স্পর্শ করেছে। প্রিয়তমের দর্শন-মানসে চণ্ডীদাসের রাধা,

“ঘরের বাইরে দণ্ডে শতবার

তিলে তিলে আইসে যায়।”


তাঁর রাধা প্রেম-মহাসাগরের তলদেশে নিমজ্জমান ধ্যান-গম্ভীর স্বর্ণপ্রতিমা

“সদাই ধেয়ানে     চাহে মেঘপানে

না চলে নয়ন তারা।

বিরতি আহারে     রাঙাবাস পরে

যেমতি যোগিনী পারা ।”


পূর্বরাগের এই অপূর্ব ধ্যানতন্ময় চিত্র সমগ্র পদাবলী সাহিত্যে বিরলদৃষ্ট। একমাত্র চণ্ডীদাসের রাধাই ‘যৌবনে যোগিনী” এবং “পুলকে আকুল দিক নেহারিতে সব শ্যামময়” দেখেন। আক্ষেপানুরাগের পদেও চণ্ডীদাস প্রমাণ করেছেন যে তিনি গভীরতম প্রাণবেদনার দোসরহীন রূপকার :

“সখি, কি আর বলিব তোরে 

পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর 

এত দুখ দিল মনে”

কিংবা,

“বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ 

দেহ মন আদি তোমারে সঁপেছি

কুল শীল জাতি মান”


প্রভৃতি পদে রাধা যেন কৃষ্ণের চরণপ্রাত্তে ছিঁড়ে দিয়েছেন তাঁর প্রেমপূর্ণ রক্তাক্ত হৃদয়। সুদীর্ঘ বিরহের পর পুনর্মিলনের মহালগ্নে চণ্ডীদাসের রাধার কণ্ঠে শুনি

“দুখিনীর দিন দুখেতে গেল 

মধুরা নগরে ছিলে তো ভাল?”

এতো বাণী নয়, এ যেন রাধার হৃদয়ের বেদনা-উদ্বেল মর্মভেদী জিজ্ঞাসা।


আত্মনিবেদনের পদেও চণ্ডীদাসের জুড়ি নেই। তাঁর একটি পদে শোনা যায়

“বঁধু কি আর বলিব আমি 

জীবনে মরণে     জনমে জনমে 

প্ৰাণনাথ হৈও তুমি”

কিংবা,

“কি দিব তোমা মনে করি আমি 

যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি”


প্রভৃতি অতুলনীয় আত্মনিবেদনের পদে চণ্ডীদাস রেখে গিয়েছেন তার বিস্ময়কর কবি প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু মিলনের এবং আনন্দ-উজ্জ্বল পদ রচনায় তাঁর কৃতিত্ব সামান্যই। আসলে ‘পুঁহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া”—এই সুরই চণ্ডীদাসের কাব্যের ধ্রুবপদ।


ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংযোগ: কবির কথিত বক্তব্য যদি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আয়ত্ত কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে দোলায়িত হয়ে ওঠে, চরিত্রের অনুভবের অংশী ও সঙ্গী হয়ে যদি ধরা দেয় কবি-মন, তবে পাঠকের কাছে তার রসাবেদন গভীরতর এবং প্রত্যক্ষস্পর্শী হয়ে ওঠে। একথা সুবিদিত, বিশাল সংস্কৃত সাহিত্যে প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর ভারতীয় কোন কবির পক্ষে নূতনতর বক্তব্যের সংযোজন ছিল কষ্টসাধ্য কাজ। তবু মনে হয়, এক এই বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যেই কোন কোন পর্যায়ে (যেমন ‘আক্ষেপানুরাগ’) চণ্ডীদাস সেই দুঃসাধ্য কাজ করতে পেরেছেন। একথা সত্য, রজকিনী রামীকে জড়িয়ে চণ্ডীদাসের জীবনের উত্থান-পতনের নানা কাহিনী আজ কিংবদন্তী মাত্র। তবে প্রতিভাকে মানুষের স্বীকৃতির প্রত্ন-স্মৃতিচিহ্ন অন্ততঃ এর মাধ্যমে দেখা যায়। রাধা কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদ রচনার সময় কৃষ্ণের মাধ্যমে নিজের প্রেমিকার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা ও সমাজ-সমালোচনার তাপ ও ভাপ যেন তার সৃষ্ট রাধা চরিত্রের মধ্যে উত্তাপ সঞ্চার করেছে। যদিও, অনেক পরে নরহরি চক্রবর্তীর 'ভক্তিরত্নাকরে’ বলা হয়েছে :

“আভোগেতে কবি নায়কের নাম হয়।”


এই ‘আভোগ’ বা ভণিতাকে চণ্ডীদাসই যথানুপাতী সজাগভঙ্গীতে ব্যবহার করতে পেরেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য বাইবেলের গীতিগুচ্ছ সম্পর্কে সমালোচক (Richard Green Moulton) প্রশ্ন তুলেছেন— “Melodies of experience are given us in the first person. Who is the 'T' that speaks” নিজেই আবার তার ব্যাখ্যা করে বলেছেন এই '‘আমি’ হলো “an ideal sufferer of an idealized experience" ('The Literary Study of Bible, p. 185) বৈষ্ণব পদাবলী আক্ষেপানুরাগের পদে এই “ideal sufferer of an idealized experience” দেখা গেছে বিশেষভাবে চণ্ডীদাসের সৃষ্ট কবিতায়। চণ্ডীদাসের ভণিতা তার সংক্ষিপ্ত পদের সংক্ষিপ্ততর ভাবসার।


পদ বিশ্লেষণ: আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির তুলনা : এখানে প্রথম পদটি বিদ্যাপতির

“কি কহব রে সখি ইহ দুখ ওর’।

বাঁশি-নিশাস-গরলে তনু ভোর

হঠসঞে পৈঠয়ে শ্রবণক মাঝ।

তৈখনে বিগলিত তনু মন লাজ ৷৷”


আলোচ্য এই পঙ্ক্তিতে বাঁশীকে উপলক্ষ্য করে রাধার যে আবেগ লক্ষ্য করা যায় সেটি স্পষ্টতই আক্ষেপ নয়, উল্লাসের। এই উল্লাস যেন প্রথম যৌবনের ভীতিমিশ্রিত কৌতুক, আর অবাধ বাসনার প্রচ্ছন্ন উল্লাস। তাই “গুরুজন সমুখহি ভাব-তরঙ্গ” ফুটে ওঠার আন্তরিক ভয় যেমন আছে, তেমনি আছে “তনু মন বিবশ খসয়ে নিবি-বন্ধ” ইত্যাদি বাহ্যিক প্রকাশ। একদিকে “বাঁশি-নিশাস গরলে” আবেশ আনার মুগ্ধতা, অন্যদিকে, মনের সেই আবেগের সঙ্গে দেহের সহযোগিতা। বিদগ্ধ-চতুর কবি নিজেই তাই সূক্ষ্ম সংশয় হয়ত রসিক-চিত্তে জাগাতে চেয়েছেন–“কি কহব বিদ্যাপতি রহ বন্ধ।” উত্তর নয়, এই প্রশ্নেই পদটির রসাবেদন সৃষ্টি।


অন্যদিকে, বাঁশীর প্রচণ্ড প্রভাব বর্ণনাতেই রূপমূর্ত হয়েছে চণ্ডীদাসের এই পদটি

“বিষম বাঁশীর কথা কহিল না হয়।

ডাক দিয়া কুলবতী বাহির করয় ৷৷ 

কেশে ধরি লৈয়া যায় শ্যামের নিকটে।

পিয়াসে হরিণী যেন পড়য়ে সঙ্কটে ।”


মাত্র চারটি এই পঙ্ক্তিতে ডাকাতের মতো বাঁশীর ডাক এবং কুলবতী নারীর দেহমনে তার উন্মাদনাময় অবস্থাটুকু এখানে একটি স্পষ্ট চিত্রে দৃশ্যময়। বলা বাহুল্য, এ বাঁশীর সুর জ্ঞানদাসের রোমান্টিক বাঁশী কিংবা গোবিন্দদাসের মুরলী নয়—বিশুদ্ধ বাঁশের বাঁশী, প্রাণের শিকড় ছিঁড়ে অশক্ত অবশ দেহটিকে যা অভিরুচিমত নাচিয়ে ফেরে। বাঁশীর টান যে কত গভীর, তা বোঝাবার জন্য এই পদে সার্থকতার মূলে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়লোকপ্রচলিত প্রবাদের প্রয়োগ— “সতী ভোলে নিজ পতি মুনি ভোলে মন।” প্রত্যহধর্মী শব্দ ব্যবহার—'পিয়াসে হরিণী', 'অবলা জাতি’, ‘নাটের গুরু কালা’ ইত্যাদি। রাধার প্রেমতৃষ্ণার্ত হৃদয়ের সংবাদ আনতে 'পিয়াসে হরিণী'র সংবাদটি সংবেদনা সৃষ্টি করেছে। আর সব কিছুর মধ্য দিয়ে বা ছাড়িয়ে প্রকৃতির অসহযোগিতায় রূপায়িত হয় একটি অশান্ত নারী-হৃদয়— “শুনি পুলকিত হয় তরু-লতাগণ” অবশ্য এই পঙ্ক্তিকে যদি পূর্বাপর দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, তবে দেখা যায় এটি অবাস্তর, বাঁশীর প্রচণ্ড প্রভাবের পাশে যেন এই আনন্দটুকু বেমানান।


পরবর্তী পদে রাধার আর্তি একান্তভাবেই আক্ষেপানুরাগের। প্রথমেই লক্ষণীয় কুলগৌরব থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য ক্ষোভ—“ধরম করম গেল গুরু-গরবিত”, তারপর লোকাপবাদে দণ্ডিত হওয়ার জন্য স্বগত বিক্ষোভ – “ঘরে পরে কি না বলে করিব হাম কি। কে না করয়ে প্রেম আমি কলঙ্কী।” এই বিক্ষোভ আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত, কিন্তু শ্রোতৃনিরপেক্ষ এই আত্মকথনের তিক্ততা পরিণত হয়েছে এক সার্বজনীন রসাবেদনে—অবৈধ প্রেম সম্পর্কে হিন্দুসমাজের নিষ্ঠুরতা, ব্যক্তি-মন সম্পর্কে স্বার্থপর উদাসীনতার কারণে। রাধার ক্ষেত্রে এই যন্ত্রণা গভীরতর হয়ে উঠেছে প্রধানত দুটি উপলক্ষ্যে—“অবশ করিল রাধা কানুর পীরিত” একদিকে, অন্যদিকে “বাহির হৈতে নারি লোক চরচাতে।” আর এই মোহাবেশ ও যন্ত্রণার দ্বৈত তরঙ্গেই তুঙ্গে উঠেছে তার আক্ষেপ—“কানু পরিবাদ হৈল পুড়্যা মরি শোকে।”


কবিতার শেষ চার পক্তিতে দেখা যাচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের চকিত ইঙ্গিত দিয়ে রাধার চিত্তের অস্থির যন্ত্রণার উপস্থাপনা—“খাইতে নারিয়ে কিছু রহিতে নারি ঘরে” আর সেই অস্থিরতার জ্বালা এবং উপায়হীনতার অবসাদে “ভাবিতে ভাবিতে ব্যাধি সামাইল অদ্ভরে”। একটি সময়ের বিস্তার বা অবকাশ এখানে অনুভব করা যায়। বাঁশীর শক্তি যে কি অপ্রতিরোধ্য তা মুসলমান কবি চঁাদ কাজীর নায়িকাও বলেছে

“ওপার হতে বাজাও বাঁশী এ পার হইতে শুনি।

অভাগিয়া নারী হে সাঁতার নাহি জানি ॥”


আর এই পদে আছে— “জারিল সে তনু মন ব্যাপিল শরীর।” শুধু তাই নয়, তারপরেই প্রায় তান্ত্রিক বলিষ্ঠতায় সহজিয়া কবি চণ্ডীদাসের উচ্চারণে শোনা যায় কঠিন ক্ষোভে সমাধানের সিদ্ধান্ত— “চণ্ডীদাস বলে ভাল হইবে সুস্থির।” উক্তি এখানে স্পষ্টতই আভিপ্রায়িক, ‘ভাল’ এবং ‘সুস্থির’ শব্দ দুটি ইঙ্গিত-বঙ্কিম, যা অভ্রান্তভাবে জানিয়ে দেয় সমাজ-বিরুদ্ধ এই প্রেমে নায়িকার মৃত্যু ভিন্ন অন্য কোনো গতি নেই। এইভাবে ব্যাধির যন্ত্রণাকে নিবিড়ভাবে অনুভবেই আছে প্রেমের মুক্তিলাভ।


সহজিয়া বৈষ্ণবদের কাছে ‘পিরিতি' শব্দটি ছিল মন্ত্রের মত। যেহেতু মন্ত্রের পুনঃ পুনঃ উচ্চারণে সাধকের সিদ্ধিলাভ ঘটে, (দ্রষ্টব্য : ১০নং পদ, 'পাঁচশত বৎসরের পদাবলী', শ্রী বিমানবিহারী মজুমদার, পুনর্মুদ্রণ, কার্ত্তিক, ১৩৮১, পৃষ্ঠা ৩৮) চণ্ডীদাসের “পিরিতি পিরিতি কি রীতি মুরতি' ইত্যাদি পদেও দেখা গেছে তার প্রকাশ (সহজিয়াদের মতে, প্রেম-সমুদ্র মন্থন করে 'পি' 'রি' এবং 'তি' এই তিনটি দিব্য অক্ষরের উদ্ভব ও একত্রে আকার ধারণ)। এ পদটির তাই আবেদন যতখানি তাত্ত্বিকভাবে উপলব্ধিময়, ততখানি ‘পিরিতি' শব্দের পুনঃ পুনঃ প্রয়োগে শিল্প-সুষম হয়ে উঠতে পারেনি।


এই তাত্ত্বিক ধারণার অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় 'প্রেম' সম্পর্কে এক নতুন কথা— ঈশ্বর যেমন নিত্য সত্য তেমনি প্রেমও তদনুরূপ, প্রাণ থাকুক বা না থাকুক প্রেম থাকবেই—“পরাণ ছাড়িলে পিরিতি না ছাড়ে” এবং “পিরিতি লাগিয়া পরাণ ছাড়িলে পিরিতি মিলয়ে তথা।” প্রকৃতপক্ষে, রাধার দেহ-আধার ছাড়া যে প্রেম থাকা সম্ভব, গৌড়ীয় বৈষ্ণবের কাছে তা অবিশ্বাস্য, কেননা রাধা নিজেই ‘মহাভাবস্বরূপিণী’ অর্থাৎ 'রাধা' এবং ‘ভাব’ বা প্রেম একই সংযোগে একাত্ম। কিন্তু সহজিয়া বৈষ্ণবদের ধ্যান-ধারণার আড়ালে যেহেতু ছিল তান্ত্রিক মত এবং অদ্বৈতবাদ, তাই তারা মনে করেন, রাধার দেহাধার ভেঙে গেলেও প্রেম চিরনভাবে থাকে। এই প্রেমে লীন হওয়ার জন্য প্রয়োজন চরম আত্মত্যাগ ও কৃচ্ছসাধনা, প্রেমের জন্য দেহের প্রাকার ভেঙে ফেলার আয়োজন।


শিল্পগত সাফল্য : চণ্ডীদাসের কবিচিত্ত পরিবেশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে তাঁকে আপাত সরল মনে হতে পারে, কিন্তু তার কবিতায় নিরলঙ্কার বিরলতা, অনুভূতির রূপায়ণ সহজ হলেও সরল নয়। তাঁর কবিতায় ব্যালাডের ধর্ম আছে 'The Poetic arta which conceals art' সেখানে লক্ষ্য করা যায়। কবি নিজেও ব্যালাডসুলভ নৈর্ব্যক্তিকতা আশ্রয় করতে পেরেছিলেন। কবির নৈর্ব্যক্তিকতা প্রকৃতপক্ষে তার সুনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি স্বভাবেরই একটি ধর্ম। তাঁর যে সব কবিতায় নিরভিযোগ সহিষ্ণুতা দেখা যায় তাদের আড়ালে কবির একটি সংকল্প, কিছুটা পিছুটান হয়ত বেজে উঠেছে, তবু একথাও ঠিক, প্রেমের গাঢ় মুহূর্তে ব্যক্তিগত ভাবনার সম্ভাবনা যখন দেখা দিয়েছে, পরক্ষণেই কবির সচেতন আত্মসংবরণে তা প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার কুশল প্রশ্ন বা আত্মদহনে সমাপ্ত হয়েছে। অন্তর্মুখী স্বগতোক্তিকে এই কবি সার্বজনীন উত্তরাধিকারে পরিণত করতে পেরেছিলেন, চণ্ডীদাসের কবিতার শিল্পসাফল্যের কারণ এখানেই নিহিত। সাধারণভাবে দেখা যায়, আক্ষেপানুরাগে পদে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ তাঁর ব্যক্তি জীবনের প্রভাব, সমাজসচেতন স্বতন্ত্র রসদৃষ্টি ও ধর্মবোধ। আর বিশেষভাবে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের কারণটি নির্দেশ করলে বলতে হয়, তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি সমাজ-প্রাধান্য। অপর বৈষ্ণব কবির অপেক্ষা চণ্ডীদাস অনেক বেশি মান্য করেছেন লোকগঞ্জনা ও সামাজিক সংস্কারকে। বাঙালীর গৃহসংস্কারের প্রাধান্য অর্থাৎ সংস্কারবশে সমাজভীতি ও সতীত্ববোধ তার রাধার জীবনে দৃঢ়মূল হয়েছে। ভণিতায় ঘটেছে কবির ব্যক্তিস্বভাবের বিচ্ছুরণ।


চণ্ডীদাসের রাধা ব্যথার গরল পান করে নীলকণ্ঠ। ‘বিরহ’-ই চণ্ডীদাসের কবি-মানসের স্বভাবজ। তাই বিরহের পদে তার কৃতিত্ব সর্বজনস্বীকৃত। “ও দুটি নয়নে বহিছে সঘনে। শ্রাবণে মেঘেরি ধারা”— তার রাধার এটাই হল বাস্তবালেখ্য, বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের করুণ রেশে তাঁর পদাবলী সঙ্গীতায়িত। দুঃখের দহনে, বেদনার উত্তাপে, বিরহের ছটায় কামান্ধ প্রেমকে বিগলিত করে তাকে স্বর্ণময় কান্তি দান করেছেন কবি।