চর্যায় অলঙ্কার প্রয়োগ

চর্যায় অলঙ্কার প্রয়োগ


“ভণ কইসে সহজ বোলবা জায়”—“শুধু কাহ্নপাদ নয়, এ যেন সহজানন্দে বিভোর প্রত্যেক সিদ্ধাচার্যের রূপকারী বিবেকের কাছেই এক অনবদ্য জিজ্ঞাসা। তবু য়ুরোপীয় ক্রবাদুরদের ‘tmobar clus'-এর সঙ্কেতধর্মী কাব্যরীতির মত চর্যাকারেরাও সন্ধ্যাভাষার রূপক-প্রতীকের অবলম্বনে তাকে অনচ্ছ রূপদানে উৎসুক। তাদের ব্যবহৃত অসংখ্য রূপক উপমা-যমক-অনুপ্রাস ইত্যাদি অর্থ ও শব্দালঙ্কার যেন সেই ভাবজগতের পথ নির্দেশরূপী লক্ষ্যভেদী বাণ।

চর্যায় অলঙ্কার প্রয়োগের উদ্দেশ্য ধর্মনৈতিক। কাব্যে অলঙ্কার প্রয়োগের মুখ্য লক্ষ্য— সৌন্দর্যসৃষ্টি। কিন্তু চর্যার সন্ধ্যাভাষা বা সন্ধিক্ষণের ভাষা, যার অন্য নাম আভিপ্রায়িক ভাষা। তারই জন্য অলঙ্কারের অবলম্বন; অর্থাৎ দুর্লভ সহজতত্ত্বকে সংগুপ্ত রাখার চেষ্টায় দ্ব্যর্থবোধক সন্ধ্যাশব্দগুলি এখানে হয়ে উঠেছে সৌন্দর্য-বিধায়ক অলঙ্কারের উপাচার।

নিছক কবিতা রচনার জন্য ব্রতী হয়ে চর্যা-কবিরা কবিতা লেখেননি একথা হয়ত ঠিক, কিন্তু হৃদয়ের সত্যকে কবিতার মত করে প্রকাশের জন্য উপাদান নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারে যে শিক্ষা এঁদের করে নিতে হয়েছিল তার আভ্যন্তরীণ প্রমাণ তাঁদের কাব্যে আছে।


বস্তুতপক্ষে, এঁদের আচরিত ধর্মের অনেকখানি অংশী ও সঙ্গীরূপে ছিল লোকজীবনের প্রসঙ্গ। অবশ্য শেষে অরূপ-চেতনাই হয়ে উঠেছে অন্যতম। তাই চর্যাকবিতার চতুর্দিকে লক্ষণীয় যে দৃশ্যভুবন চিত্র, যেখানে কখনও দুর্দমনীয় জলদস্যু, কখনো খেয়া পারাপারকারী ডোমনী নারী; এরই পাশাপাশি চাঙারি, বণিক, নটনটী, সামাজিক যৌতুকপ্রথার পর অসামাজিক মেয়ের ছবি—সমস্ত রূপচিত্রই শেষপর্যন্ত কবির ‘বাপথাতীত’ অন্তর্জগতের উদ্দীপন বিভাব হয়ে উঠেছে।


শব্দলঙ্কার সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য: সহজতত্ত্বকে সৌন্দর্যময়তায় বৈচিত্র্য দানের প্রবণতা চর্যাকারদের মধ্যে দেখা যায় ব্যাজ, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, বিরোধ ইত্যাদি অলঙ্কার প্রয়োগের কুশল প্রচেষ্টায়। ব্যাজাশ্রিত রূপকের সুন্দর দৃষ্টান্ত—“কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল” (১নং) এবং ৩৮ সংখ্যক গানের “খাঅ নাবড়ি খান্টি মন কেডুআলি” পদটি। ‘ব্যাজ’ শব্দের অভিধেয় অর্থ ছল, অর্থাৎ স্বরূপ আচ্ছাদন বা অভিপ্রায় গোপন করাই এর স্বরূপ লক্ষণ। ব্যাজেবিক্ত, ব্যাজস্তুতি ইত্যাদি অলঙ্কারের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা, তেমনি অর্থশ্লেষের সঙ্গেও আছে ‘ব্যাজে’র একাত্ম সম্বন্ধসমতা।


উপমা-রূপক প্রভৃতি সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারে শ্লেষ অনেকক্ষেত্রে গুণীভূত হয়ে উপমা রূপকেই প্রাধান্য দেয়। চর্যাগানের এই পদ দুটিতেও ‘কায়া’ এবং ‘মন’ বা ‘চিত্ত’কে যথাক্রমে ‘তরুবর’ ও ‘নাবাড়ি’– নৌজ্যার সঙ্গে, এবং দৃঢ়নিষ্ঠ ও খাঁটি মনকে ‘কেডুআল’ বা দাঁড়ের সঙ্গে অভিন্নরূপে দেখায় ‘ব্যাজ’ হয়েছে রূপকের সহকারী। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ভারতীয় ধর্মসাধনায় ‘নৌকা’ বা তরুর রূপকটির বহুল ব্যবহার আছে। কমলাকান্তের ‘মনপবনের নৌকা বেয়ে, বেয়ে, ‘দে শ্রীদুর্গা বলে' ইত্যাদি পংক্তি বা শ্রীরামকৃষ্ণের “মন যেন অশ্বত্থগাছের ফোকড়ি” ইত্যাদির সঙ্গে যেন একটি ঐতিহ্যগত সংযোগ আছে।


গুঢ়ার্থের দ্যোতনায় সৌন্দর্যদীপ্তি—“গঙ্গা জউনা মাঝেরে বহঈ নাঈ। তাই বুড়িলী মাতঙ্গী যোইআ লীঙ্গে পার করলে।” (১৪ সংখ্যক) পদটি। এখানে ‘নৌকাপ্রবাহ-ব্যাজে’ বা ছলে শুক্রনাড়ির অন্তর্গত বোধিচিত্তকে মহাসুখপারের দিকে বহে নিয়ে যাবার সঙ্কেতটিই অভিপ্রেত। নৌকা বাওয়ার অপদেশে তা গুপ্ত। তাই গঙ্গা-যমুনা নামে যেমন দুই নদী আছে তেমনি আছে চন্দ্র ও সূর্যগ্রাহক দেহের দুই নাড়ী; 'নাঈ' শুধু নৌকা নয়, শুক্র নাড়ীকায় প্রবাহিত বোধিচিত্ত; ‘জিনপুরে’রই অন্য নাম সুখবতীপুর ইত্যাদি ভাবের দ্যোতক।


উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টিতে সার্থকতা : উৎপ্রেক্ষা' শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ, উৎ-ঊৰ্দ্ধ, প্রেক্ষা-দৃষ্টি। অর্থাৎ প্রকৃত বিষয়কে না ভেবে অন্য বিষয়ের ভাবনা। অতিশয়োক্তির মত উপমান উপমেয়কে যেমন এখানে গ্রাস করে না, তেমনি রূপকের মত উপমেয়ের সঙ্গে অভেদ রূপেও থাকে না। অথচ উপমেয় থেকে কিছু পার্থক্য রেখে প্রবল সাদৃশ্যহেতু একটি অবাস্তব সংশয় বা সম্ভাব্য তাদাত্ম্য কল্পনা দেখা যায়। চর্যার যেখানে সাধকের “সোণে ভরিতী করুণা নাবী”কে “বাহতু কামনি গঅণ উবেসে” (৮নং) নিয়ে যাবার প্রয়াসে সেখানে উৎপ্রেক্ষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য বিশেষরূপে স্পষ্টরেখ। এখানে ‘করুণা’ (নৌকা) রূপে উৎপ্রেক্ষিত। উপমেয় 'করুণা’ এবং উপমান ‘নাবী'র (নৌকা) মধ্যে তাদাত্ম্য সত্ত্বেও করুণা ও নৌকা অভিন্ন হয়ে যায়নি, বরং একাত্ম সম্পর্কেই উপমান নৌকা বাস্তব নৌকা থেকে আলাদা হয়ে গগন যাত্রার উদ্দেশ্যে অসম্ভব কল্পনাকে প্রশয় দিয়েছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের সোনার ধানে পূর্ণ সোনার তরী নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার রূপচিত্র যেন এই তাত্ত্বিক যাত্রা দৃশ্যেরই পরিপূর্ণ রূপচ্ছবি, যদিও তা আরো গভীরভাবে জীবন্ত এবং সম্পূর্ণভাবে নান্দনিক বা মানবিক লক্ষণাক্রান্ত। উৎপ্রেক্ষার আরো প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় কাহ্নপাদের “মুক্কউ চিত্ত পপ্রন্দ করু” পদটিতে। এখানে পদকর্তা স্বয়ং চিন্তা-গজেন্দ্রের স্থান অধিকার করায় গজেন্দ্রে’র উৎপ্রেক্ষাটি যেন কিছু ব্যাহত হয়েছে—“কাহ্ন বলসঅ আসব মাতা। সহজ নলিনীবন পইসি নিবিতা ।”


সমাজচিত্র: চর্যা কবিতাগুলি প্রাচীন বাংলার সমাজচিত্রের এক বিচিত্রসুন্দর সংগ্রহশালা। এর চতুর্দিকেই যেন দৃশ্যভুবন ভর করেছে। এখানে যেমন প্রকাশ পেয়েছে চর্যাকারদের বেদধর্ম বিরোধী মনোভাব

“জাহের বাণচিহ্নরূপ ন জানী।

সো কইসে আগম বেএঁ বখানী ৷”


তেমনি দেখা গেছে যৌন-যৌগিক চিন্তাধারা, তান্ত্রিক কাপালিকদের কথা

“নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ।”


কোথাও আছে শবরী নারীর বর্ণনা

“উঁচা উচা পাৰ্বত তহি বসই শবরী বালি"


কোথাও দেখা গেছে হরিণ শিকার দৃশ্য

“তিন ণ চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পানী”


সেইসঙ্গে আছে ডোম্বীর জীবনযাপন ও তার নৃত্য-গীতের বর্ণনা

“এক সো পদুমা চৌষঠী পাখুড়ী। 

তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী ৷৷”


বীণা-নির্মাণের কথা : “সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী”, নাটক-অভিনয়ের কথা “বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই”। আবার জাতিভেদ-সংস্কার বর্জিত হয়ে কাপালিকদের যোগসঙ্গিনী হওয়া “অন্তে কুলিন জন মাঝে কাবালী”, ডোম্বী ও পাটনী নারীর নদী পারাপার করার বৃত্তিগত পরিচয়ও আছে “কবড়ি ন লেই কোড়ি ন লেই সুচ্ছড়ে পার করেই।” কর্মী শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত পরিচয়ের বৈচিত্র্য যেমন চর্যাপদে দেখা যায়ধুনুরী, “তুলা ধুনি ধুনি আঁসুরে আঁসু” বা ছুতোরের কাজ“জো তরু ছেব ভেবউ ণ জানই”; তেমনি শুঁড়িখানার দৃশ্য : “এক সো শুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধঅ।”


এছাড়া, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে

“সোণে ভরিতী করুণা নাবী। 

রূপা থোই নাহিক ঠাবী ৷৷”


এখানে গৃহজীবনের দৃশ্য যেমন আছে

“সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগা।

কানেট চোরে নিল কা গই মাগতঅ৷৷”


তেমনি আছে অসামাজিক নারীর অভিসারিকা- চিত্র

“দিবসই বহুড়ী কাড়ই ডরে ভাঅ।

রাতি ভইলে কামরু জাঅ ৷”


চুরি, ডাকাতি ও নিরাপত্তার অভাব সেই যুগেও ছিল। যেমন : “দুয়ারে তালা বি দিজ্জই” অথবা “সাসু ঘরে খালি কোঞ্চ তাল।” সামাজিক জীবনের অপরিহার্য পরিচয়রূপে প্রবাদ-প্রবচনের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে : “সুণ গোহলী কিম দুঠ বলন্দে” (“দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল) “অপনা মাংসে হরিণা বৈরী”, “সোণে ভরিতী করুণা নাবী” ইত্যাদি।