বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয়-বৈচিত্র্য

বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয়-বৈচিত্র্য


বৈষ্ণব সাহিত্যের মুখ্য উপজীব্য বিষয় প্রেম এবং তার আশ্রয় রাধা ও কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের নামটাও জড়িয়ে রাখা হয় সত্য, কিন্তু উভয়ের প্রেমের মধ্যে ঐক্যবোধ নেই। কৃষ্ণের প্রেমের মহিমাকে যতই উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করা যাক না কেন, এ প্রেম কখনো দেহসীমার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ভক্তের দৃষ্টিতে কৃষ্ণের প্রেম – যাকে কাম বলেই অভিহিত করা যায়–আধ্যাত্মিকতা দ্বারা মণ্ডিত হয়ে পরিণামরমণীয় হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এ প্রেমের মর্যাদা নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, (কৃষ্ণপ্রেম) আধ্যাত্মিক অর্থে ইহার বিশেষ কোনো গৌরব থাকিতে পারে কিন্তু সাহিত্য হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের এই কামুক ছলনা দ্বারা প্রেমকাব্যের সৌন্দর্য খণ্ডিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” বৈষ্ণব কাব্যে রাধাপ্রেম একান্তভাবেই দেহবোধের ঊর্ধ্বে, দেহমন ও বুদ্ধিকে অতিক্রম করে এ প্রেম আত্মার গভীরে আশ্রয় নিয়েছে।


মূলত রাধাকৃষ্ণের প্রেমে অবলম্বন করে বৈষ্ণব পদাবলী রচিত হলেও রাধাকৃষ্ণের প্রেম বর্ণনাতেই পদাবলী সাহিত্য অবসানপ্রাপ্ত হয়নি। এর বাইরেও পদাবলীর বিকাশ ঘটেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা চৈতন্যদেব কলিযুগে অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই বোধ থেকে চৈতন্যভক্তগণ চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করেও অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। তাই চৈতন্যোত্তর সাহিত্যে 'গৌরাঙ্গ বিষয়ক’ পদাবলীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। ডঃ সুকুমার সেন এই জাতীয় পদগুলোকেও বৈষ্ণব-মহাজনপদাবলীর অন্তর্ভুক্ত করে বৈষ্ণব পদাবলীর চারটি স্থূল বিভাগ করেছেন—

  • (১) গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদাবলী,
  • (২) ভজন পদাবলী,
  • (৩) রাগাত্মিক পদাবলী,
  • (৪) রাধাকৃষ্ণ পদাবলী।

(১) গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলী: রাধাভাব অঙ্গীকার করেই শ্রীকৃষ্ণ নরলোকে গৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এই স্থির বিশ্বাসেই বৈষ্ণবপদকর্তারা রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহের প্রমুর্ত প্রকাশরূপে গৌরাঙ্গদেবের ভজনা করেছেন। বৃন্দাবনের বড়গোস্বামিগণও রাধাকৃষ্ণ-তত্ত্বে চৈতন্যদেবের অস্ত্রজীবনের পরিচয় পেয়েছেন। অন্যান্য বৈষ্ণব ভক্তগণও। গৌরাঙ্গদেবের মধ্যে রাধাভাবের উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছেন। এ স্থলে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা এই– চৈতন্যদেবের পরবর্তী জীবনের সাধনা অপেক্ষাও তার পূর্ব জীবনের তথ্য গৌরাঙ্গ জীবনের যৌবন-সাধনাই কবিদের অধিকতর আকর্ষণ করেছিল। তাই গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলো প্রধানত নবদ্বীপ-লীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব সাহিত্যে গৌরাঙ্গ বিষয়ক এই পদগুলোকে সাধারণভাবে ‘গৌরচন্দ্রিকা' নামে অভিহিত করা হয়। পদাবলী কীর্তনের প্রারম্ভে গৌরচন্দ্রিকা কীর্তনকে বৈষ্ণবগণ অবশ্য-করণীয় বলে মনে করেন। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে যে ধরনের রস বা কাহিনী পরিবেশন করা হবে, গৌরচন্দ্রিকা থেকেও তদনুরূপ পদ বেছে নিয়েই পালাকীর্তন শুরু হয়। রাধাকৃষ্ণের যুগল লীলায় যতপ্রকার ভাববৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গের জীবনেও ততপ্রকার ভাববৈচিত্র্য আরোপ করে পদকর্তারা পদ রচনা করেছেন। বস্তুত রাধাকৃষ্ণের লীলা কাহিনীর ছকে ফেলেই গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলো রচিত হয়েছে বলেই গৌরচন্দ্রিকাতেও পূর্বরাগ, বিরহ, অভিসার-আদি পদের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি অর্থাৎ 'গৌরচন্দ্রিকা' ছাড়াও পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের জীবনের বহু ঘটনাকে অবলম্বন করে বহু কবি বহু পদ রচনা করে গেছেন, তবে উৎকর্ষে এগুলো পূর্ববর্তী পদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাসুদেব ঘোষ ও তদ্‌ভ্রাতা গোবিন্দ ঘোষ, বংশীবদন, শিবানন্দ, নরহরি সরকার, লোচনদাস, রাধামোহন, মুরারি গুপ্ত, রামানন্দ বসু আদি অনেকেই গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করেছেন। বৃন্দাবন দাসের উক্তি থেকে জানা যায় যে মহাপ্রভু অদ্বৈতাচাৰ্যই সর্বপ্রথম গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করে গৌরাঙ্গ কীর্তনের সূচনা করেনঃ

'আপনে অদ্বৈত চৈতন্যের গীত করি। 

বলিয়া নাচেন প্রভু জগত নিস্তারি।।'


গৌরাঙ্গবিষয়ক প্রাচীনতম পদগুলোর মধ্যে মুরারি গুপ্ত রচিত 'সখি হে, ফিরিয়া আপন ঘরে যাও’অন্যতম। চৈতন্য-সমকালীন অপর কবি বাসুদেব ঘোষ যতগুলো পদ রচনা করেছেন, তাদের সবগুলোই গৌরাঙ্গ-বিষয়ক বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দ দাসের নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পদটিও গৌরচন্দ্রিকার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ পদরূপে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়, যে সকল পদ রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গদেবকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে, শুধু সেই পদগুলোকেই 'গৌরচন্দ্রিকা' বলা হয়, গৌরাঙ্গ বিষয়ে হলেও অপর পদ গৌরচন্দ্রিকা নয়।


(২) ভজন পদাবলী: ভজন পদাবলী বা প্রার্থনা-গীতগুলোতে ঈশ্বর বন্দনা, চৈতনোেতর ভক্ত বৈষ্ণবদের বন্দনা কিংবা গুরুবন্দনার পদগুলোই স্থানলাভ করেছে। বিদ্যাপতির প্রার্থনা-বিষয়ক পদগুলো অপূর্ব। তার রচিত 'মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়' এবং 'তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম সুতমিত-রমণী-সমাজে' পদ দুটি ব্যঞ্জনায় এবং কবিকৃতি হিসেবে অনবদ্য। নরোত্তম দাস, চন্দ্রশেখর দাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস প্রমুখ অল্প কয়েকজন কবিও কিছু কিছু ভজন পদাবলী রচনা করেছেন।


(৩) রাগাত্মিক পদাবলী: রাগাত্মিক পদাবলীতে ‘সহজিয়া সাধন পদ্ধতিরই আভাস পাওয়া যায়। এই ধরনের রাগাত্মিক পদ অনেক পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষায় প্রচলিত ছিল। সম্ভবত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদেরই 'চর্যাপদে' এর শুরু এবং 'বাউল'-এ এর বিস্তার। বৈষ্ণব সহজিয়াগণের সাধনপস্থা ছিল সহজ; মহাভাবরূপে সহজ বস্তুকে লাভ করাই ছিল তাদের চরম উদ্দেশ্য। প্রচলিত কিংবদন্তী এই যে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসই বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বের সাধন ও প্রচারক, তিনি রজকিনী রামী বা রামতারার সঙ্গে এই সহজ-সাধনা করেছিলেন। “বৈষ্ণব সহজিয়াগণ কামকেই প্রেমে পরিণত করিতে চাহেন। এইজন্য তাঁহারা যে সাধনা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা হইল আরোপ-সাধনা, রূপে স্বরূপের আরোপ, নরনারীতে কৃষ্ণ রাধার আরোপ।” বৈষ্ণব সহজিয়াদের পদাবলীতে সাধন প্রণালীর বর্ণনায় অনেক রূপক আরোপিত হয়েছে। এগুলোকে প্রকৃত বৈষ্ণবপদ না বলাই সঙ্গত, যদিচ এদের ওপর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য আরোপের জন্য ভণিতায় বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, বৃন্দাবন দাস আদির নামও ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য নিছক কবিত্বের বিচারে এজাতীয় অনেক পদই রসোত্তীর্ণ হয়েছে।


(৪) রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদাবলী: রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদগুলোই প্রকৃত বৈষ্ণব পদাবলী, এবং সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে এরূপ পদেরই প্রাচুর্য দেখা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উপজীব্য বিষয় প্রেম। রাধাপ্রেমের স্বাদগ্রহণ করবার উদ্দেশ্যেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গৌরাঙ্গ রূপে মর্ত্যলোকে দেহ ধারণ করেছিলেন—গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই মতবাদে বিশ্বাসী। প্রেমের বিচিত্র গতি, বিচিত্র ভাব—বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রেমের এই বৈচিত্র্যই দেখানো হয়েছে। রসশাস্ত্রের অনুসরণে বৈষ্ণব পদকর্তারা সকল রসের পদই রচনা করেছেন শাস্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য এবং মধুর।


গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় শান্তরসের উপাসক নন-চৈতন্যোত্তর কালে এরূপ পদও রচিত হয়নি বললেই চলে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে দাস্যভাবের উপাসনা একেবারেই প্রচলিত নেই, ভারতের অন্যত্র অবশ্য দাস্যভাবের প্রচলন রয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীতে তাই দাস্যরসের পদেরও একাস্ত অসদ্ভাব। বাৎসল্য এবং সখ্য রসের পরিচয় পাওয়া যায় প্রধানত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায়। রাধাকৃষ্ণের মিলিত লীলাই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাধনার ধন, তাই মধুর রসের পদই প্রায় সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য জুড়ে রয়েছে। সাধারণভাবে 'মহাজন পদাবলী' বলতে এগুলোকেই বোঝায়।