ভাগবত অনুবাদ
ভাগবত অনুবাদ
মানুষের অনুভবে কালের দুই মাত্রা— এক চিরায়ত আর এক নির্দিষ্ট দেশ এবং পাত্রের প্রসঙ্গে সীমা চিহ্নিত বা সমকাল সম্পর্কিত। প্রথমটির ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক সাহিত্য এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে দেশজ সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। যেমন, কুরু-পাণ্ডবের গোষ্ঠীগত সংঘাতে স্বজনঘাতী মনুষ্যত্বের মর্মান্তিক পরাভব স্থানিকের ঔরসজাত হয়েও ট্র্যাজিক বেদনায় সর্বকালীন; অন্যদিকে সাময়িকতার আবেদনে ঘুমন্ত ব্রতকথার মত শাস্ত পল্লীবাংলার নিরঙ্গ সময় রূপমূর্ত, কৃত্তিবাসের রামকথায় এক সুপরিচিত অনুভূতির বর্ণ গন্ধ-স্বাদুতায়। শুধু তাই নয়, ধ্রুপদী সাহিত্যের ‘দ্বিরায়তনিক’ সম্ভাবনা অর্থাৎ যুগে যুগে অনুবাদ ও অনুসরণের ফলন্ত-শক্তি দ্বিতীয়টিতে বিরলদৃষ্ট। তাছাড়া, ভাষায় রামায়ণ মহাভারত-ভাগবত অনুবাদে অধিকাংশ অনুবাদক কবিরই লক্ষ্য, ‘লোকত্রাণ’ বা ‘লোকনিস্তার’, সচেতনভাবে সারস্বত বাণী-সিদ্ধি নয়। সেকালীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজের প্রবল বিরোধিতা ও অভিশাপ ছিল এইরকম—
“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি।
ভাষায়ং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ !!”
তবু সেই অভিশাপ উপেক্ষা করে শুধু হৃদয়ের অনুমতি নিয়ে মধ্যযুগের কবির রূপকারী বিবেক জনজীবনের অংশী ও সঙ্গী হতে চেয়েছে।
রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত অনুবাদের পারস্পরিক তুলনা :
ত্রিভুবন উপজীব্য রামায়ণ-মহাভারত ও ভাগবতের কাহিনী অনুসরণে মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যসৃষ্টি কখনো ভাবানুবাদে কখনো ভাষানুবাদে পরিণত হয়েছে। বাল্মীকি-রামায়ণ অথবা বৈয়াসকী-মহাভারতের মূল আখ্যান ছাড়া জৈমিনী-ভারত, যোগবাশিষ্ট, সংস্কৃত ও বাংলা অদ্ভুত রামায়ণের প্রতি মুগ্ধতা সপ্তদশ শতকের রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদকগণের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপভাবে, ভাগবত অনুবাদে কোথাও আদি আখ্যানের সম্পূর্ণতা বা স্কন্দ-অনুবাদ (প্রধানতঃ দশম, একাদশ ও দ্বাদশ স্কন্দ) কোথাও বিষ্ণুপুরাণ অথবা পুরাণ-উপপুরাণের মিশ্রলীলা রতি, কোথাও বা সম্পূর্ণভাবে রাখালিয়া গ্রামীণ কৃষ্ণকথা অথবা 'হরিবংশের' অনুসরণ অনুভব করা যায়। কিন্তু সংখ্যা সমতা এবং গুণগত উৎকর্ষে ভাগবত অনুবাদ রামায়ণ-মহাভারত শাখার সমপর্যায়ী নয়। জনপ্রিয়তার নিরিখে এই শাখাটির অনুন্নতির মূলে আরো কিছু কারণ অনুভব করা যায়।
কাহিনীগত সীমাবদ্ধতা : রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ-সমৃদ্ধির একটি মূল কারণ
(ক) কাহিনীর প্রাচীনত্ব ও বৈচিত্র্য : রাম-সীতা লক্ষ্মণের এবং পাণ্ডব-কৌরবের বীরত্ব, প্রেম ও লোকনীতির ধ্রুব আদর্শ জাতির বহুবর্ষী ও বহুস্তরী মানস-কর্ষণার সৃষ্টি, আবার জনমনের বিবিধ আশা-আকাঙক্ষা এবং পৌরাণিক ভাবানুষঙ্গের বহুমিশ্র পঞ্চশস্যেও সমৃদ্ধ হয়েছে এর উর্বর কাহিনী। কিন্তু খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে ভাগবতপুরাণের পূর্ব ভারতে অল্প-স্বল্পভাবে এবং খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতকেই প্রধানতঃ মাধবেন্দ্রপুরীর মাধ্যমে এদেশে হয় প্রচার লাভ। আবার, বিদ্যাপতি, বড়ু চণ্ডীদাস, মালাধর বসু, যশোরাজ খান প্রমুখ, ভক্ত কবি পরিবৃত সুধীসমাজে অথবা সাধারণভাবে বাঙালীর কৃষ্ণকথা-সম্পর্কে কৌতূহল কেন্দ্রীভূত ছিল মূলতঃ ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণের বৃন্দাবনলীলা ও মথুরালীলার মধ্যে। সুতরাং কাহিনীগত প্রাচীনত্ব এবং রামায়ণ-মহাভারতের নানামুখী আখ্যানের জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করা ভাগবতের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
(খ) গল্পাংশ নির্বাচনের সুযোগ : রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদে মূল কাহিনী অংশ ছাড়া অদ্ভুত, অধ্যাত্ম অথবা স্ত্রী-সমাজে প্রচলিত ছড়া-রামায়ণের ব্যাপকতম গল্পানুষঙ্গের সঙ্গে পরিচয়ের অবকাশ ছিল অনুবাদকের। গল্পাংশ নির্বাচনে ও সংযোজনে তাদের অনুবাদে তারই পরিচয় স্পষ্টরেখ। কিন্তু ভাগবতে অনুরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। পৌরাণিক আখ্যানের সমৃদ্ধি সত্ত্বেও সেইসব গল্পের সঙ্গে জনমনের বৃহত্তর স্বরসঙ্গতি দেখা যায় না। জনচিত্ত-বিযুক্ত সেইসব আখ্যান তাই অনুবাদকগণের কাছেও ছিল আবেদনবিহীন। ফলে নান্যোপায় অনুবাদকের পক্ষে ভবানন্দের ‘হরিবংশের’ অনৈতিহাসিক আখ্যান বা গ্রাম্য কৃষ্ণকথার স্মৃতি-রতিতে আসক্ত হওয়া ছিল কিছুটা অনিবার্য।
(গ) বিশালতা ও খণ্ডাংশের জনপ্রিয়তা : ভাগবতের বিশাল কাহিনী (১২টি স্কন্দ, ১৮০০০ শ্লোক ও ৩৩২টি অধ্যায়) অনুবাদে ভাগবতাচার্য রঘুনাথ পণ্ডিত, সনাতন বিদ্যাবাগীশের মত কোনো কোনো দুঃসাহসী কবি সম্পূর্ণভাবে দ্বাদশটি স্কন্দ অনুবাদে সিদ্ধকাম হলেও দ্বিজমাধব, দুঃখী শ্যামদাস, কৃষ্ণকিঙ্কর, দ্বিজ হরিদাস, অভিরাম দত্ত, দুর্লভনন্দ, কবিচন্দ্র প্রমুখ অনুব্রাজক কবিগণের পক্ষে দু-একটি স্কন্দের অনুবাদের দ্বারা বিশাল ভাগবত-অনুবাদের গাল্পিক সাফল্যলাভ সম্ভব ছিল না। অথচ কৃত্তিবাস, অদ্ভুত আচার্য, নিত্যানন্দ-কাশীদাসের মত সম্পূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদক বাদে দ্বিজ গঙ্গানারায়ণ, গুণরাজ খান, ঘনশ্যামদাস, ভবানীদাস, দ্বিজ লক্ষ্মণ, রামকিঙ্কর, কৈলাস বসু, চন্দ্রাবতী প্রমুখ রামায়ণ অনুবাদকগণের খণ্ড বা পালা অনুবাদ করেও লোকসমাজে সহজে স্বীকৃতি লাভ ঘটেছিল। মহাভারতেও কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, দৈবকীনন্দন, ষষ্ঠীবর দত্ত, রামচন্দ্র খাঁ প্রমুখ কবিরা গণপৃষ্ঠপোষণ লাভ করেছিলেন। এরা পয়ার-ত্রিপদীতে মহাভারতের দুই-এক পর্বের ভাবার্থ অনুবাদেই ছিলেন নিষ্ঠাবান।
(ঘ) কবিসিদ্ধি: কাব্য বা অনুবাদ শাখার সমৃদ্ধির মূলে প্রথম শ্রেণীর কবি প্রতিভার আবির্ভাব প্রয়োজন। কেননা প্রথমতঃ রামায়ণ-মহাভারত বা ভাগবতের সুপরিচিত গল্পের মধ্যে ‘নবোহৰ্থঃ’ নিয়ে আসা তখনই সম্ভব। সৃষ্টির মত কাব্যেও যে-কোনো সময়ে নববসস্তু বা অকালবসন্ত সঞ্চারের দুর্লভ ক্ষমতা তার আছে—
“দৃষ্টপূর্বা অপি হ্যর্থাঃ কাব্যে রসপরিগ্রহাৎ।
সর্বে নবা ইভাভাস্তি মধুমাস ইব দ্রুমাঃ ।।"
দ্বিতীয়তঃ শক্তিশালী কবির মাধ্যমেই তুচ্ছ বিষয়ের স্মরণীয় প্রতিষ্ঠা এবং বৃহত্তমক্ষেত্রে জনপরিচয় লাভ সম্ভব। কিন্তু ভাগবত অনুবাদে কৃত্তিবাস বা কাশীদাসের মত একক কোনো কবি-ব্যক্তিত্ব অনুপস্থিত। স্বল্পতম অনুবাদকদের মধ্যে বিরলতম হয়ত মালাধর বসুর কবিখ্যাতি। তাই পরচৈতন্যযুগের ভাগবত অনুবাদকগণের সার্থকতার মূলে কোনো পূর্বসূরীর প্রেরণা বা পথনির্দেশ ছিল না।
(ঙ) ঐশ্বর্যময় কৃষ্ণের প্রকাশ : ভাগবতে সৃষ্টির রণক্ষেত্রে বিচিত্রবীর্য কৃষ্ণের ঐশ্বর্য লীলা যতখানি ভয়-মিশ্র ভক্তিভাবের উদ্বোধক, ততখানি রসতৃপ্তিদায়ক নয়। এমন কি বৃন্দাবনে তার রাস ও বসন্তলীলার আদিরসের লীলাও ঐশ্বর্যলীলার আর একটি দিক মাত্র। ভাগবতের অনুবাদক তারই অনুসারী। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে বৈষ্ণব ধর্মসাধনা, দর্শন ও সাহিত্যে রাধাকৃষ্ণের মধুররসের নিভৃত নিধুবন লীলাই ছিল পদাবলীতে একমাত্র স্মরণীয়, তাই ভাগবতের অনুবাদ বা অনুসরণে রচিত কাব্যগুলি বৈষ্ণবসমাজে ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
(চ) বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাধান্য বিস্তার: ভাগবতপুরাণ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে উপনিষদরূপে স্বীকৃত, তবু তার মূল রস ও বক্তব্য জনচিত্তে ও ভক্তহৃদয়ে পদাবলী কীর্তনের বিধুর রেখাবে এবং ছন্দ ও শব্দের নৃত্যতালে উপস্থাপিত। সেখানে ভাগবতের মৌল কাহিনীর সঙ্গে দানলীলা, নৌকালীলা, বড়াইয়ের চরিত্র-সংক্রান্ত, গ্রাম্য আখ্যানের মিলন-মিশ্রণে হরণপুরণলীলা ‘অনুবাদে’ আদৌ সুষ্ঠ বা বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতিস্পর্ধী রূপলাভ করেনি। বরং তা ছিল মলূতঃ বৈষ্ণব পদশাখারই যেন অনুবর্তী। এই সমস্ত কারণে ভাগবত অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করেনি।