বাংলা কাব্যে মোহিতলাল মজুমদারের অবদান | বাংলা কাব্যে মোহিতলাল মজুমদারের কৃতিত্ব ও ভূমিকা

বাংলা কাব্যে মোহিতলাল মজুমদারের অবদান কৃতিত্ব


বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এক বড় রকমের বিষ্ময়। এই মহৎ কবির কবিধর্মকে না বুঝে, তার আপাত সহজতার মোহিনীমায়ায় আকৃষ্ট হয়ে সমসাময়িক অনেক প্রতিভাবান কবিও আত্মবিসর্জন দিয়েছেন রবীন্দ্র সলিলে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখ কবিরা রবীন্দ্রানুসরণ করে স্বাতন্ত্র্যতা হারিয়ে বসেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দের ‘যাদুকর’ ‘ছন্দরাজ' হিসাবে নিজেকে আলাদা করেছেন মাত্র। অথচ এঁদেরই প্রায় সমসাময়িককালে তিনকবি নজরুল, মোহিতলাল ও যতীন্দ্রনাথ নিজেদের স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নজরুল তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের উত্তেজনায়, বিদ্রোহী মানসিকতায়, মোহিতলাল দেহবাদের বা ভোগবাদের প্রতিষ্ঠায় এবং যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত দুঃখবাদের প্রকাশে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। মোহিতলাল রবীন্দ্রভক্ত হয়েও ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের ‘দেহহীন চামেলির লাবণ্যবিলাস’ জাতীয় কল্পনার ঐশ্বর্য থেকে সরে এসেছেন ভোগকামনার বলয়ে। যতীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের নির্মোহ দৃষ্টিতে সুখ, সৌন্দর্য, প্রেমকে অলীক মনে করে দুঃখকেই মানবের অনিবার্য পরিণতি বলে ধরেছেন। বস্তুত বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্র বিরোধীতার যে অধ্যায় আছে তার সূচনা এই কবিদের হাতে। নজরুলের অসচেতন বিদ্রোহ থেকে মোহিতলাল ও যতীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে কল্লোলের কবিদের সচেতন রবীন্দ্রবিরোধিতা বাংলা কাব্যে এক দ্বন্দ্বময় অধ্যায়ের সূচনা করে।


বাংলা সাহিত্যে মোহিতলালের পরিচয় কবি ও সমালোচক হিসাবে। বিহারীলাল যেমন রবীন্দ্রনাথের পূর্বসুরী, রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে কবিগুরু বলে আখ্যা দিয়েছেন, তেমনি মোহিতলাল সরাসরি ঘোষণা না করলেও স্বভাবকবি গোবিন্দ দাস ছিলেন কবি মোহিতলালের পূর্বসুরী। রবীন্দ্রনাথ ও ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র সেই সাহিত্যিক যুদ্ধে যোগ দেবার মতো তখনো তার শক্তি না জন্মালেও রবীন্দ্রদলভূক্ত হওয়ার কথা চিন্তা করে পরে অনুতাপ হয়েছিল। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ‘শ্রাবণ সংখ্যা’ প্রগতি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘গোবিন্দদাসের এই ইন্দ্রিয়াসক্তিরই একটি ঘনীভুতরূপ আমরা ‘বিস্মরণী' তে পাই।” এই দুই কবির প্রভাবেই মোহিতলাল রবীন্দ্রভক্ত হয়েও সে মোহ কাটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম কাব্য ‘স্বপ্নপসারী’ থেকেই মোহিতলাল স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রেখে গেছেন। মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থগুলি হল—‘স্বপ্নপসারী' (১৯২২), ‘বিস্মরণী’ (১৯২৭), ‘স্মরগরল' (১৯৩৬), ‘হেমন্ত গোধুলি’ (১৯৪১), এবং ‘ছন্দ চতুদর্শী’ (১৯৪১)।


‘স্বপ্নপসারী’ কাব্য রচনা কালেই কবি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। একাব্যে কবি সত্যই স্বপ্নব্যাপারী। এ কবিতায় কবির স্বপ্ন-সঙ্গিনীর কল্পনা তার অতিপ্রবল সৌন্দর্য তৃষ্ণারই ফলশ্রুতি। এই স্বপ্নসঙ্গিনীকে– “দরশে হইবে পরশ উদয়” বললেও তখনো কবির মধ্যে বাস্তবে পাওয়া কামনা প্রবল হয়ে ওঠেনি। এই কাব্যের কয়েকটি বলিষ্ঠ কবিতা—'অঘোরপন্থী', 'নাদীর শাহের জাগরুণ’, ‘বেদুইন’, ‘পাপ’ ইত্যাদি। 'অঘোরপন্থী'তেই ভোগবাদের জয় ঘোষণা লক্ষণীয়।


‘বিস্মরণী’র কয়েকটি কবিতা কল্লোলের পৃষ্ঠাতেও প্রকাশিত হয়। ভোগই জীবনের চরম লক্ষ্য, তা কবির কাছে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অশরীরী প্রেমকল্পনা অস্বীকার এখানে স্পষ্ট। মোহমুদুগর কবিতায় কবি যেন রবীন্দ্রনাথকেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানান—

‘কল্পনার দ্রাক্ষা বনে মধু চুষি নিরক্তি অধরে।

উপহাসি দুগ্ধধারা ধরিত্রীর পূর্ণ পায়োধরে, 

বুভুক্ষু মানব লাগি রচি ইন্দ্রজাল

আপনা বঞ্চিত করি চির হই কাল

কতদিন ভুলাইবে মর্ত্য জনে বিলাইয়া মোহন আসবে,

কে কবি বাসব?”


‘স্বরগরল’ কাব্যে এই দেহাত্মবাদই আরো উচ্চৈস্বরে ঘোষিত হয়েছে—

“মোর কামকলা-কেলি উল্লাস 

নহে মিলনের মিথুন বিলাস”


মোহিতলালের কাব্যকবিতা প্রসঙ্গে ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন “কোথাও বা দেহকে অবলম্বন করেও দেহাতীতের জন্য বিলাপ করেছেন। কোন্ কবির কাব্যে রাধা ম্যাডোনা একাকার হয়ে গেছেন?” রবীন্দ্রনাথও এ কবির মধ্যে এক বলিষ্ট পৌরুষের সাহসিকতাকে লক্ষ্য করেছিলেন—

‘পৌরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই। 

শক্তির মর্যাদা আছে, সাহস আছে।

বাহাদুরি নেই।”


অতি আধুনিক কবিদের পুরোধায় ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। কবি রবীন্দ্র-উত্তরণের দুটি পথের সন্ধান দিয়েছেন। যতীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথে চলেছেন নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও জীবনানন্দ দাশ। আর মোহিতলালের পথে কাব্য রচনা করেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে (প্রথম দিকে) এবং পরবর্তিকালে আরো অনেকে। ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকলম’ কে অবলম্বন করে রবীন্দ্র-উত্তরণের যে সহজ প্লাবন শুরু হয়েছিল তাতে মোহিতলালের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। প্রথমদিকে কবির ভোগবাদের রূপপিপাসা। সমকালে এই দেহাশ্রিত ভোগবাদ তথা রূপপিপাসা অবলম্বন করেই রবীন্দ্রোত্তর কাব্যের দিক্‌দর্শনের প্রচেষ্টা চলে। সে যা হোক মোহিতলাল শেষের দিকে ইহার সঙ্গে বৈষ্ণব, তান্ত্রিক ও বেদান্তের জীবনদর্শনের কিছুটা সমন্বয় করে বলিষ্ঠ ক্লাসিকাল ভঙ্গিতে কবিতা রচনা করেছেন। প্রথম দিকে তাঁর কাব্যে রবীন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবও যথেষ্ট ছিল; ক্রমে কবি তা অতিক্রম করেছিলেন। “বস্তুত মোহিতলালের ক্লাসিকাল গঠনশিল্প, সুবিন্যস্ত ভাবসজ্জা, জীবনসত্য প্রকাশের বলিষ্ঠ ভঙ্গি ও ছন্দের ভাবনা নিয়ন্ত্রিত, অলক্ষ্য প্রায় প্রবাহ এই যুগের অন্যান্য কবির আঙ্গিক শিথিলতা, ভাবের অজস্র উৎসার ও ছন্দোবিলাসের আতিশয্যের এক অসাধারণ ব্যতিক্রম ও মননদৃপ্ত প্রতিবাদ।” কবির ভাষ্য স্পষ্ট করার জন্য দুটি উদ্ধৃতি দেওয়া গেল—

যে স্বপ্ন হরণ তুমি করিবারে চাও, স্বপ্নহর।

তারি মায়া-মুগ্ধ আমি, দেহে মোর আকণ্ঠ পিপাস!

মৃত্যুর মোহন-মন্ত্রে জীবনের প্রতিটি প্রহর

জপিছে আমার কানে সকরুণ মিনতির ভাষা!

নিষ্ফল কামনা মোরে করিয়াছে কল্প-নিশাচর।

চক্ষু বুজি অদৃষ্টের সাথে আমি খেলিতিছি পাশা-

হেরে যাই বার বার, প্রাণে মোর জাগে তবু দুরস্ত দুরাশা!

এস কবি, এস বীর, নির্মম সাধক এস, এস হে সন্ন্যাসী! 

ছিঁড়ে ফেল অদৃষ্টে ফাসী।

দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা,

ধূলা মাখি’ খুঁড়ি লও কামনার কাচ মণি-হীরা!


পৃথিবীর প্রতি কতকটা নাস্তিক্যবাদী ধারণা প্রকাশ করলেও কবি সর্বত্রই জীবনবাদী, কবি দেহাশ্রিত প্রেমকে স্বীকার করেও বৈষ্ণব-শাক্ত সাধনার তত্ত্বটি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। কবি রোমান্টিক দৃষ্টিতে বলিষ্ঠ জীবনবোধকে আশ্রয় করে ক্লাসিকাল বাক্‌নির্মিতি ও নিটোল ছন্দোপ্রকরণে অনন্য সাধারণ কবিপ্রাণের পরিচয় রেখেছেন।


সমালোচক প্রাবন্ধিকরূপে মোহিতলালের স্থান অতি উচ্চে। এইরূপ রচনায় তাঁর আত্মবিশ্বাসের সুর যথার্থ একান্ত হয়ে উঠেছে।