বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : সাহিত্য টীকা : আধুনিক যুগ (প্রবন্ধ)

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : সাহিত্য টীকা : আধুনিক যুগ



প্রবন্ধ


আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)

গ্রন্থকার : টেকচাঁদ ঠাকুর ওরফে প্যারীচাঁদ মিত্র। গ্রন্থরূপ : উপন্যাসোপম গদ্য আখ্যান।

বিষয়ঃ একটি পরিবারের উত্থান পতনের কাহিনিসহ কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জীবন যাত্রার ধরন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধনীর মোসাহেব পরিবৃত অসার জীবনের কৌতুকদীপ্ত চিত্র আঁকা হয়েছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। কলকাতা ও শহরতলী অঞ্চলের বেনিয়া-মুৎসুদ্দী নির্ভর সমকালীন সমাজের যথাযথ বাস্তব উপস্থাপনার জন্য—‘প্রথম সামাজিক উপন্যাস' হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল।

২ । সাধারণ আটপৌরে মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার দুঃসাহসিক অভিনবত্ব প্রদর্শিত হয়েছে।

৩। ঠচাচা, বক্রেশ্বর, মাস্টার, বাঞ্ছারাম কেরানী প্রভৃতি সার্থক টাইপ চরিত্র সৃষ্টি ; ৪। “ঘরের থেকে উপাদান” সংগ্রহের জন্য “বাংলা গদ্য যে উন্নতির পথে” যাচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্র তার জন্য প্যারীচাঁদকে সাধুবাদ জানান।

৫। সুশিক্ষা, সুনীতি এবং ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও ভাবধারার প্রকাশ ঘটেছে। 

৬। সমকালীন জীবনের বিশেষত কাল পরিবেশে মানুষের সামাজিক অবস্থা ও তাদের পারস্পরিক আচার-আচরণের চিত্র এখানে বিধৃত হয়েছে। প্রথম সম্পূর্ণ সামাজিক উপন্যাসের কাহিনি গঠনের দায়িত্ব এখানে পালিত হয়েছে।

৭। ভাষায় তীব্র শ্লেষ ও কৌতুকরস, বাক্যরীতির কথ্য ভঙ্গী : কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের ভাষা ও আরবি-ফার্সীর সুষ্ঠু ব্যবহার, দেশি বিদেশি ও তৎসম শব্দের অবলীলাক্রমে ব্যবহার, ক্রিয়াবিভক্তির, কারকবিভক্তি এবং অব্যয়ের নতুনরূপ প্রবর্তন, সমাস ও সন্ধিবদ্ধ দীর্ঘ বাক্য পরিহার এই ভাষার বৈশিষ্ট্য।

৮। রামগতি ন্যায়রত্ন এই ভাষাকে 'আলালী' নাম দিয়ে বলেছেন : “এই আলালী ভাষার সৃষ্টি হইতে বঙ্গসাহিত্যে গতি ফিরিয়া গেল। ভাষা সম্পূর্ণ আলালী রহিল না বটে, কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রী রহিল না, বঙ্কিমী হইয়া দাড়াইল।”



কথোপকথন (১৮০১)

গ্রন্থকার : উইলিয়াম কেরী।

এই গ্রন্থে এর রচনা বা উপকরণ সংগ্রহে খুব সম্ভবত তিনি দেশীয় পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়েছিলেন। কারণ তাঁর নিজের উক্তি : I have employed some senseble natives to compose dialogues upon Subjects of a domestic nature" এবং ফেলিক্স কেরীর মতে : These (Colloquies) were composed in the original Bengali probaly by a clever natives.” (দ্রষ্টব্য : ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, “উইলিয়াম কেরী,” ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা' প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)।

গ্রন্থরূপ ঃ দ্বিভাষিক গদ্য সংলাপিকা, বাঁ দিকের পাতায় বাংলা, অন্য পাতায় ইংরেজী, সম্পূর্ণ নাম : Dialogues, intended to facilitate the acquiring of the Bengalee Language' বইটি Colloquies নামেও প্রসিদ্ধ ছিল।

বিষয় : এখানে আছে একত্রিশটি বিবিধ বিষয়ক অধ্যায়। বাংলা দেশের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও স্তরের নরনারীর সংলাপের কথ্যরূপ পল্লিরমণীদের ঘরোয়া কথাবার্তা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুখের জীবন্ত পরিচয় ; যেমন—'তিয়ারিয়া কথা' অধ্যায়ের একটি অংশ ঃ “হাড়ে ভেগো মারকে যাবি কিনা আতিথো কোয়াহ করিছে, মুই ফুকরিছি তুই ঘুমাইছিস।”

কেন উল্লেখযোগ্য :

ক) বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মুখের ভাষা সম্বলিত বাংলা ফ্রেজ ও ইডিয়মের বৈচিত্র-সম্পদে পরিপূর্ণ প্রথম এক সংকলন। 

খ) গ্রাম বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আর্থ সামাজিক বিবরণ প্রকাশ পেল। তাদের জীবন যাপনের বাস্তব ও নির্ভরযোগ্য পরিচয় পাওয়া গেল। 

গ) বিদেশি এক পাদ্রীর পক্ষে পল্লিজীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন এবং চলিত ভাষায় দক্ষতা দেখানোর অভিনব প্রয়াস দেখা যায়।




হুতোম প্যাচার নক্সা (১৮৬৪)

গ্রন্থকার : কালীপ্রসন্ন সিংহ।

গ্রন্থরূপ : নকসা জাতীয় কৌতুককর গদ্য গ্রন্থ।

বিষয় : কোনও ধারাবাহিক কাহিনী নেই। তৎকালীন সঙ, যাত্রাগান, চড়ক, রাসলীলা, রেলওয়ের কাজকর্ম, মিউটিনী ও বাঙালি, মাহেশের স্নানযাত্রী, আজব শহর কলকেতার বাবুর উপাখ্যান (বীর কৃষ্ণ দাঁ এবং পদ্মলোচন দত্ত) প্রভৃতি প্রসঙ্গ সরস চলতি বাংলায় বর্ণনা করা হয়েছে। বইটির প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রীঃ, পরে দুই ভাগ একত্রে ১৮৬৪ খ্রীঃ গ্রন্থাগারে দেখা দেয়। বইটির ইংরেজীর নাম : “Sketches by Hootum illustrative of Every Day life and Every day people."

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। কলকাতার খাঁটি ককনি বা কথ্য ভাষায় গ্রন্থটি লেখা হয়। উচ্চারণ অনুসারে বানান রীতি, ইডিয়মের যথেষ্ট ব্যবহার, ক্রিয়াপদের চলতি রীতি গ্রহণ দেখা যায় ; যেমন— “শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙা বাজারে মেচুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা ‘মাছ ও লোনা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের ও গামচা কাঁদে ভালো মাছ নিবি?' 'ও খেংরা গুঁপো মিসে চার আনা দিবি' বলে আদর কচ্চে।” তবে বঙ্কিম চন্দ্র হুতোমের এ ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবু তিনি স্বীকার করেছিলেন : “Hutum was one of the most Successful writers in the style firsts introduced by Tek Chand." 

২। সমকালীন সামাজিক ইতিহাস রচনার উপকরণ গ্রন্থটিতে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। তাছাড়া কোথাও বাস্তব নাম ধাম বজায় রাখা, কোথাও সামান্য আবরণ টেনে অনেক তথাকথিত বিখ্যাত ব্যক্তির মুখোশ খুলে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লেখকের দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তি : “এই নকসায় একটি কথা অলীক ও অমূলক ব্যবহার হয় নাই।”

৩। শ্লেষ কৌতুক ব্যঙ্গের শাণিত দীপ্তি, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, দেশ ও মানুষের প্রতি অকৃপণ মমতা এবং সত্যভাষণ বইটিকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় করেছে। 

৪। বিবেকানন্দ এবং প্রমথ চৌধুরীর চলিত গদ্য রচনায় এ গ্রন্থের ভাষা প্রেরণা যুগিয়েছে।



বিষাদ সিন্ধু

গ্রন্থকার : মীর মশাররফ হোসেন। 

গ্রন্থরূপ : উপন্যাস ধর্মী রচনা। এটি যথাক্রমে মহরম পর্ব ১৮৮৫, উদ্ধার পর্ব ১৮৮৭, এজিদ পর্ব ১৮৯১ নামে বিভক্ত।

বিষয় : হিজরী ৬১ সালে ৮ই মহরম তারিখে মদিনাধিপতি হোসেন ঘটনাক্রমে সপরিবারে কারবালা ভূমিতে উপস্থিত হন এবং এজিদ কর্তৃক প্রেরিত সৈন্য দ্বারা রণক্ষেত্রে নিহিত হন। এই ঘটনার মূল সারাংশ নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচিত। জনৈক সমালোচক এই গ্রন্থ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন : “প্রসিদ্ধ মহরম এর আমূল বৃত্তান্তে বিষাদ সিন্ধুর গর্ভ পূর্ণ হইয়া বিষাদ সিন্ধু নামের সার্থকতা সম্পাদন করিয়াছে। ইহার এক একটি স্থান এরূপ করুণ রসে পূর্ণ যে, পাঠকালে চোখের জল রাখা যায় না।” বলতে গেলে এই গ্রন্থটি মহরমের একটি ইতিহাস। হোসেনের মৃত্যুতে যুদ্ধের অবসান হলেও যে সব অর্থলোভী স্বার্থপর মানুষ এই যুদ্ধের জন্য দায়ী, সেই সব মানুষের চারিত্রিক রূপগুলি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। যুদ্ধ শেষে যদি লেখক এই গ্রন্থের সমাপ্তি ঘোষণা করতেন, তাহলে আমরা কখনোই দেখতে পেতাম না অর্থলোভী সীসারকে। অপরদিকে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর পরিবারের চরিত্র গুলি। হোসেনের খণ্ডিত শির রক্ষার্থে তাঁদের আত্মত্যাগ আমরা কখনোই ভুলবো না।

কেন উল্লেখযোগ্য : 

‘বিষাদ সিন্ধু' গ্রন্থের ভাষা যেমন সরল, ঘটনাগুলি, যেমন পরিস্ফুট, নায়ক নায়িকার চরিত্রও তেমনি সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে। এর পূর্বে একজন মুসলমান লেখকের এত পরিপাটি বাংলা রচনা ছিল বলে মনে হয় না। এই গ্রন্থটি লেখককে অমরতা দান করেছে।



বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২)

গ্রন্থকার : মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।

গ্রন্থরূপ : অনুবাদমূলক গদ্য আখ্যান।

বিষয় : মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনধারী বত্রিশটি পুতুল বা পরীর কাহিনি। এটি সংস্কৃত 'দ্বাত্রিংশ পুত্তলিকার অনুবাদ। কাহিনিটি সংক্ষেপে এইরকম : মহারাজা বিক্রমাদিত্যের অধিষ্ঠিত সিংহাসন কালের নিয়মে ভূপ্রোথিত হয়। এক রাখাল বালক খেলাচ্ছলে সেই মাটির ঢিবিতে বসে সুক্ষ্ম নিরপেক্ষ বিচার করে তার প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। কৌতূহলী হয়ে এক রাজা বা জমিদার সেটি সময় করে উদ্ধার করে এবং দখল নেয়, কিন্তু সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না কারণ বত্রিশ পুতুল বাধা দেয়, নানাবিধ প্রশ্ন করে। রাজা ভুল বুঝতে পারে, পুতুলেরা সিংহাসন নিয়ে অন্তর্হিত হয়।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। বিক্রমাদিত্য উপকথার প্রথম বাংলা লিখিত সংস্কারণ রূপে এই গদ্যগ্রন্থটি খ্যাতি অর্জন করে। ইংরেজী গদ্যকাহিনির ইতিহাসে ম্যালরির 'Morte Darthur'-এর মতো এই বিক্রমাদিত্য উপকথা খুব সহজেই গল্পগুণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

২। এই অনুবাদ গ্রন্থটির অনেকগুলি সংস্করণ শ্রীরামপুর এবং লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। প্যারী নগরী থেকেও এর একটি ফরাসি অনুবাদ প্রচারিত হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, গ্রন্থটি বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

৩। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণায় বিক্রমাদিত্যের আর একটি ধারার কাহিনির বঙ্গানুবাদ করে (বেতাল পঞ্চবিংশতি) তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন। সিস্টার নিবেদিতা Cradle Tales of Hinduism গ্রন্থে The judgement Seat of vikramaditya' নামক আখ্যান অনুবাদ করেন।



প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮৩৩)

গ্রন্থকার : মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। 

গ্রন্থরূপ : গদ্যপ্রবন্ধ।

বিষয় : সংস্কৃত বিদ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচয়, সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলঙ্কার, স্মৃতি, ব্যবহার, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা আছে। এছাড়া আছে কতকগুলি লৌকিক গল্প এবং কথ্য, সাধু ও সংস্কৃতানুগ বাংলা রচনা-রীতি।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। ফোর্ট উইলিয়ম গ্রন্থমালার মধ্যে প্রকাশিত সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্য রচনা। গদ্যের সরল এবং অলঙ্কৃত পদ্ধতির দুই রূপই দেখা যায়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন ঃ “তিনি এক দিকে যেমন সাধুভাষার আদি লেখক–অপরদিকে তিনি তেমনি চলতি ভাষারও আদর্শ লেখক।”

২। বাংলা গদ্যের স্বচ্ছন্দ প্রকাশভঙ্গী, যা পরবর্তী কালের লেখকদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে ; যেমন—বিশ্ববকের উপখ্যানের ভাষা : ‘মোরা চাষ করিব ফসল পাবো, রাজার রাজস্ব দিয়া যা থাকে, তাহাতেই বছর শুদ্ধ অন্ন করিয়া খাবো, ছেলেপিলা গুলি পুষিব।” 

৩। এটি প্রায় বিশ্বকোষ জাতীয় রচনা। মার্শম্যান এই গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ঃ ".....any person who can comprehend the present work and enter into the sprit of its beauties, may Justify Consider himself master of the language.” বিষয় বৈচিত্রের জন্য এই গ্রন্থটি একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। এছাড়া গ্রাম্য জীবনের এক অনাবৃত মূর্তি অঙ্কনের নাটকীয় কলাকৌশল এখানে ফুটে উঠেছে।



সীতার বনবাস (১৮৬০)

গ্রন্থকার : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। 

গ্রন্থরূপ : অনূদিত গদ্য গ্রন্থ।

বিষয় : রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজসিংহাসনে সমাসীন। তাঁর সুশাসনে প্রজাগণ সুখী ও সমৃদ্ধিশালী। সীতা সন্তানসম্ভবা এই সংবাদে চারিদিকে আনন্দ মুখর। দুর্মুখ নামে চর ছিল, যার কাজ হল রাজার সম্পর্কে দেশবাসীর মনোভাব জানানো, প্রতিদিনই সে রামচন্দ্রকে প্রজাদের প্রশংসাবাদের কথা জানিয়েছে। কথাচ্ছলে রামচন্দ্র জানতে চাইলেন, প্রজাদের নিন্দার কথা যদি কিছু থাকতো জানাতে। দুর্মুখ তখন সেই নিদারুণ সংবাদ জানালো যে, সীতা দীর্ঘকাল রাক্ষস রাজ রাবণের গৃহে বন্দিনী ছিলেন, তাঁকে রাজপুরীতে গ্রহণ না করে পরিত্যাগ করাই সমীচীন। এই দুঃসংবাদে রামচন্দ্র শুধু কাতর নয় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কিন্তু প্রজাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে সব সুখ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। তাই তিনি লক্ষ্মণের কাছে সীতাকে বিসর্জনের অভিপ্রায় জানালেন। রামচন্দ্রকে লক্ষ্মণ বোঝানোর চেষ্টা করলেন, এবং অগ্নিপরীক্ষার কথা উল্লেখ করলেন। কিন্তু রামচন্দ্রের বক্তব্য, সেই অগ্নি পরীক্ষা যদি অযোধ্যায় হত, তাহলে সীতাদেবী লোকাপবাদ হতে মুক্ত হতো। রামচন্দ্রের নির্দেশে সীতাকে বনবাসে দেবার জন্যে লক্ষ্মণ তাঁকে নিয়ে বাল্মীকির তপোবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এখানে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

কেন উল্লেখযোগ্য :

ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত' আর বাল্মীকির রামায়ণের বর্ণিত কাহিনি আশ্রয়ে এই গ্রন্থটি রচিত। সহজ সরল বাংলা ভাষায় এ কাহিনি পরম উপভোগ্য।

‘সীতার বনবাস ‘বিয়োগান্তক আখ্যায়িকা। বিদ্যাসাগরের যুক্তিনিষ্ঠ মন পাতাল প্রবেশ' বৃত্তান্তকে অলৌকিক ও আকস্মিক কাহিনি হিসাবে বর্জন করেছেন। সীতার দৈহিক মৃত্যুই তিনি বর্ণনা করেছেন। ভবভূতির ছায়া-সীতার দৃশ্যটি তিনি বর্জন করেছেন। এখানে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগরের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। রাম-সীতা চরিত্রকে তিনি রক্ত মাংসের মানব মানবীর চরিত্রে পরিণত করতে চেয়েছেন। শকুন্তলার তুলনায় 'সীতার বনবাস’-এর ভাষা অনেক বেশি গুরুগম্ভীর।



চার ইয়ারীর কথা (১৯০৬)

গ্রন্থকার : প্রমথ চৌধুরী।

গ্রন্থরূপ : সরস বুদ্ধিপ্রধান গল্প সংকলন।

বিষয় : মেঘাচ্ছন্ন এক জমজমাট রাত্তিরে চার বাঙালি বন্ধু পরস্পরের কাছে ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি বলেছে। চারটি গল্পেরই নায়িকা বিদেশিনী আর তিনটি গল্পের পটভূমি ইংল্যাণ্ড। গল্পের শেষে দেখা গেছে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার উদ্ঘাটন।

কেন উল্লেখযোগ্য :

চার-ইয়ারীর গল্পের অন্যতম আকর্ষণ এর শেষাংশে প্রেমিকার পরিচয় প্রকাশ ; যেমন প্রথম গল্পের প্রেমিকা পাগল, দ্বিতীয় গল্পে চোর, তৃতীয়জন প্রবঞ্ঝক, আর শেষ, গল্পের নায়িকা টেলিফোনে প্রেম নিবেদন করলেও নায়ক পরে জেনেছে সে পরলোকের বাসিন্দা। প্রত্যেক গল্পের শেষে এই চমক, ব্যঙ্গের ঝলক লেগে পাঠকের চিত্ত ঝলমল করে ওঠে। গল্পকারের বাকভঙ্গী পাঠককে শুধু হাসায় না, ভাবিয়ে তোলে মাঝে মাঝে : যেমন—পাগল প্রেমিকা সম্বন্ধে সেনের কথাঃ “এই আমার প্রথম ভালোবাসা, আর এই আমার শেষ ভালোবাসা। এর পরে ইউরোপে কত ফুলের মতো কোমল, কত তারার মতো উজ্জ্বল স্ত্রীলোক দেখেছি, ক্ষণিকের জন্য আকৃষ্ট হয়েছি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমার মন নরম হবার উপক্রম হয়েছে সেই মুহূর্তে ওই অট্টহাসি আমার কানে বেজেছে, অমনি আমার মন পাথর হয়ে গেছে।”

‘চার ইয়ারী কথা’র ভাব কল্পনার মধ্যে হয়তো দণ্ডীর লেখা সংস্কৃতে 'দশকুমার চরিতে’র ভাবগত প্রেরণা আছে। তবু এই চারটি চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য বিশেষভাবে দর্শনীয় এরা সকলেই আধুনিক চিন্তাক্ষম ব্যক্তি। লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত বক্রোক্তি ভাষণ ও বস্তুতন্ত্রের দ্বারা দীক্ষিত। অসামান্য এ সঙ্কলন সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেনঃ “ওর অনেক খানি হয়তো কাল্পনিক বা পড়ে পাওয়া, কিন্তু ও যেটুকু শাঁস সেটুকু একটি রক্তিম হৃদয়ের পদ্মরাগমণি যেমন উজ্জ্বল তেমনি করুণ।”



মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত (১৮৮৪)

গ্রন্থকার : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

গ্রন্থরূপ : ব্যঙ্গাত্মক গল্প।

বিষয় : বঙ্কিমচন্দ্র এই গ্রন্থে মুচিরাম গুড়ের মতো অযোগ্য ব্যক্তিরা মোসাহেবী ও তদবিরের দৌলতে যে কীরূপ উন্নতি করেছিল এবং তার অর্থ ও প্রতিপত্তি মূর্খ সমাজে স্বীকৃতি লাভ করেছিল তার হাস্যকর চিত্র এঁকেছেন। মুচিরাম নিম্নশ্রেণির মানুষ, যাত্রা দলে গান গেয়ে বেড়াত। কিন্তু এই মুচিরাম ক্রমশ উচ্চরাজপদ লাভ করে সাহেব সুবোর মন যুগিয়ে এক সময় রায় বাহাদুর খেতাব পায়। এই মুচিরামের জীবন কথার মধ্য দিয়ে বঙ্কিম তৎকালীন ইংরাজ শাসকের রূপ এবং মূর্খ বাঙালি জনতার চিত্র উপস্থিত করেছেন দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশীতে ঘটিরাম ডেপুটির অনুকরণে খুব সম্ভবত এই ডেপুটি মুচিরাম চরিত্রটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সমগ্র রচনাটি চোদ্দটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত হয়।

কেন উল্লেখযোগ্য :

১। ১২৮৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার কৌতুক ও রহস্য বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গল্পটি প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র ASSISTANT SECRETARY পদ লাভের অনতিপূর্বে এটি লেখেন। চাকুরীক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তির সম্মান লাভের অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের ঘটিরাম ডেপুটির দৃষ্টান্ত দেখে মুচিরাম গুড়ের এই সম্পূর্ণ জীবন চরিত রচিত হয়।

২। এই রচনার মধ্যে বর্ণনা, সংলাপ দুই-ই আছে। সাধুভাষায় এই ব্যঙ্গমূলক উপন্যাসে মুচিরাম, যশোদা, সফলরাম, অধিকারী মহাশয়, ঈশান বাবু হেম. সাহেব, রীড সাহেব প্রমুখ একাধিক চরিত্র উপস্থিত। প্রত্যেকটি চরিত্রই সু-পরিকল্পিত। মুচিরামের পদমর্যাদা বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে এরা স্ব-স্ব ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছে।

৩। এখানে ব্যঙ্গ এবং বিশুদ্ধ হাস্যরসের যুগপৎ প্রকাশ ঘটেছে; যেমন—“গ্রন্থকার জানে এবার যখন বাঁক উঠিতে দেখিবে, পিঠ পাতিয়া দিও।...এ সুসভ্য জগতের অধিকারীরা মুচিরাম দেখিলে বাঁক পেটাই করিয়া থাকে মুচিরামেয়া পিঠ পাতিয়াই দেয়।” অথবা লিপিকরকে দিয়ে দরখাস্ত লেখাবার সময় মুচিরামের নির্দেশ “দেখিও যেন ভাল ইংরেজী না হয়। আর যা হৌক না হৌক, দরখাস্তের ভিতর যেন গোটাকুড়ি মাইলর্ড, আর 'ইওর লার্ডিশপ' থাকে।” 

৪। মুচিরাম চরিত্রের রূপায়ণে যুগন্ধর লেখক বঙ্কিমচন্দ্র অর্ধশিক্ষিত চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজ তোষণ এবং চাটুকার বৃত্তির এক ঐতিহাসিক ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেছেন। সেই অর্থে এই জীবনচরিতকে একটি সামাজিক দলিল বলা চলে।